মালয়েশিয়ায় ভোটবিহীন সরকার কেমন চলছে

রাজধানী কুয়ালালামপুরে নতুন প্রধানমন্ত্রী মহিউদ্দীন ইয়াসিন এর ক্যারিক্যাচার নিয়ে মুখোশধারীদের প্রতিবাদ - ইপিএ

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৭ জুন ২০২০, ১৯:৫৫

মালয়েশিয়ার রাজনীতি আবারও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। ভোটবিহীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দীন ইয়াসিন নিজের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে মালয়েশিয়ার নন্দিত নেতা মাহাথির মোহাম্মদকে আকস্মিকভাবে দল থেকে বহিস্কার করেছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, মালয়েশিয়ায় গণতন্ত্রের যে সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল তা আবার উল্টে গেছে। মালয়েশিয়ায় কার্যত গণতন্ত্রহীন হয়ে পড়েছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের মত অগণতান্ত্রিক সরকার আবার চেপে বসেছে দেশটিতে। মালয়েশিয়ার রাজনীতি নানা দিক নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।

ক্ষমতায় থাকার পথ নিষ্কণ্টক করতে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দীন ইয়াসিন গত ২৮ মে মাহাথিরকে তার নিজের গড়া দল বারসাতু থেকে বহিস্কার করেছেন। শুধু মাহাথির একা নন, তার ছেলে এবং আরও তিনজন শীর্ষস্থানীয় নেতাকে বহিস্কার করেছেন মহিউদ্দীন।

তবে মাহাথির বলেছেন, তিনি এই বহিস্কারাদেশকে চ্যালেঞ্জ করবেন। মাহাথির এবং বহিস্কৃত অন্য নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেছেন, কোনো বৈধ কারণ ছাড়াই এই একতরফা বহিস্কার। কারণ মুহিউদ্দীন দলীয় নির্বাচনে পরাজয়ের আশংকা করছেন। তিনি মালয়েশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে নড়বড়ে ও অস্থিতিশীল প্রধানমন্ত্রী। তারা বহিস্কারদেশের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

মালয়েশিয়ায় চলতি সর্বশেষ যে পার্লামেন্ট অধিবেশন বসে তার মেয়াদ ছিল মাত্র দুই ঘণ্টা। নিয়ম অনুযায়ী সেখানে মুহিউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হওয়া নিয়ে আস্থা ভোট হওয়ার কথা। তবে তা হয়নি। সংক্ষিপ্ততম অধিবেশন শেষে জুলাই পর্যন্ত সংসদ স্থগিত করা হয়।

দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত নাজিব রাজাক সরকারকে বিস্ময়করভাবে হটিয়ে দিয়ে ২০১৮ সালে ক্ষমতায় আসেন মাহাথির। মালয়েশিয়ার স্বাধীনতার পর এই প্রথম সরকারের পরিবর্তন হয়, ক্ষমতায় আসে বিরোধী জোট। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঐতিহাসিক সেই রায় পাল্টে গেছে নতুন কোনো ভোট ছাড়াই, এমনকিং সংসদেও কোনো ভোটাভুটি ছাড়াই। মুহিউদ্দীন ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নন, সংসদও তাকে মনোনীত করেনি।

এ ক্ষেত্রে ক্রীড়নকের ভূমিকা রাখছেন দেশটির রাজা । নতুন জোট সরকারে ফির আসতে শুরু করেছে নাজিব রাজাকের লোকেররা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বৈরাচারের মতই মুহিউদ্দীন করোনাভাইরাসের অজুহাতে গণতন্ত্রকে বলি দিয়েছেন, আইনের শাসন নির্বাসনে পাঠিয়েছেন আর ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছেন। মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল পাকাতান হারাপান ক্ষমতায় থাকার সময় মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন মুহিউদ্দীন। প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাকের সময়ে ছয় বছর উপ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।

গত ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতাসীন বারসাতুতে ভাঙন দেখা যায়। এর জেরে মাহাথির পদত্যাগ করেন। এরপর রাজা মাহাথিরের আপত্তি উপেক্ষা করেই মুহিউদ্দীনকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দেন। মাহাথির বলেছেন, তিনি এখনও সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন পাচ্ছেন। ফলে তারই আবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা। কিন্তু রাজা নিয়োগ দিয়েছেন মহিউদ্দীনকে।

মহিউদ্দীন পার্লামেন্ট মেম্বারদের আস্থা ভোটে জেতার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একারণ পার্লামেন্টে ভোটাভুটির আয়োজন করার সাহস দেখাতে পারেননি মুহিউদ্দীন। মালয়েশিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে যে ধারার রাজনীতি চলে আসছে তাতে ধীরে ধীরে বহু এমপিকে কিনে তারপরই হয়তো আস্থা ভোটের ব্যবস্থা করবেন মুহিউদ্দীন। অপরদিকে দলীয় ফোরামে মুহিউদ্দীনের প্রতিদ্ব›দ্বী হচ্ছেন মাহাথিরের ছেলে মুখরিজ মাহাথির। এজন্য তাকেও দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।

২০১৬ সালে বারসাতু গঠন করেছিলেন মাহাথির ও মহিউদ্দীন। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে এই দলের নেতৃত্বাধীন জোট বিশাল জয় পায়। গত ফেবুুুয়ারিতে ক্ষমতায় বসার পর মহিউদ্দীন মাহাথিরের সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।

করোনারোধে কড়াকড়ি আরোপকে নিজের স্বার্থে কাজে লাগিয়েছেন মুহিউদ্দীন। এতে তার বিরোধীরা তাকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পায়নি। মাহাথিরের বিদায় ও নতুন সরকারের আগমনে লাভবান হয়েছেন দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিত নাজিব রাজাক। সরকারির তহবিলের কোটি কোটি ডলার গ্রাস করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে দুনীতির বহু মামলা রয়েছে।

নতুন সরকার তার বিচার করবে কিনা তা এখন বড় প্রশ্ন। সম্প্রতি নাজিবের পালিতপুত্র হলিউডের প্রযোজক রিজা আজিজের বিরুদ্ধে মামলা খারিজ করে দিয়েছে সরকার। তার বিরুদ্ধে ২৫ কোটি ডলার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সরকার সম্ভবত সেই সম্পদ তাকে ভোগ করতে দিতে যাচ্ছে।

রিজার বিরুদ্ধে মামলা খারিজের তীব্র সমালোচনা করে মাহাথির বলেছেন, চুরি করা টাকা রিজা ভোগ করতে যাচ্ছে। তাকে সরকার ছেড়ে দেবে। জনগণ এখন বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ। মালয়েশিয়ায় এটা কেমন ন্যায়বিচার?

মুহিউদ্দীনের সরকার যে ভোটে নির্বাচিত নয় তা তিনি নিজেও স্বীকার করেছেন। মাহাথির ক্ষমতা ছেড়ে দিলে দেশটির প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল মালয়েশিয়ার বিরোধী দলীয় নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের। তিনি মুহিউদ্দীনের সরকারকে পেছনের দরজার সরকার বলে মন্তব্য করেছে এবং বলেছেন তিনি ক্যু করে ক্ষমতা দখল করেছেন। তারা বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ। জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের সাহসও তারা দেখাতে পারছে না।

মহিউদ্দীন ক্ষমতা নেওয়ার পরপরই মালয়েশিয়ায় করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। এরপর সামাজিক দূরত্ব আরোপ করার অজুহাতে তিনি বিরোধী দলকে তার বিরুদ্ধে সভাসমাবেশ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি পার্লামেন্টের অধিবেশন বাতিল করেন। এরপর তিনি সংসদ সদস্যদের তার পক্ষে ভেড়ানো শুরু করেন। তিনি ৭৩ জন এমপিকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও বিশেষ দূত নিয়োগ দেন। আরও ১৯ এমপিকে তিনি সরকারি কোম্পানিতে লোভনীয় পদে; নিয়োগ দেন। এসবের উদ্দেশ্য সংসদে ভোটাভুটিতে তাদের সমর্থন আদায়। ২২৪ সদস্য বিশিষ্ট সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য দরকার ১১৩ এমপির সমর্থন।

তাসমানিয়া ইউনিভার্সিটির এশিয়ান স্টাডিস বিভাগের অধ্যাপক জেমন চিন বলেন, কভিড-১৯ এসব এমপিকে এই ধরনের ধূর্ত ব্যবসায়ের সুযোগ এনে দিয়েছে। তারা সব গ্রাস করতে চায়।

শপথের আগে সুলতান আব্দুল্লাহর কাছ থেকে কাগজপত্র বুঝে নিচ্ছেন মহিউদ্দীন ইয়াসিন- এএফপি
শপথের আগে সুলতান আব্দুল্লাহর কাছ থেকে কাগজপত্র বুঝে নিচ্ছেন মহিউদ্দীন ইয়াসিন- এএফপি

 

মহিউদ্দীনের সরকার রাজিব নাজাকের পালিতপুত্র রিজার বিরুদ্ধে দায়ের করা পাচটি মামলা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। রিজার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার বাবা নাজিব রাষ্ট্রীয় ওয়ানএমবিডি তহবিল থেকে ১২০ কোটি ডলার চুরি করে ছেলেকে ২৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র সরকার তার ৫ কোটি ৭০ লাখ ডলার বাজেয়াপ্ত করেছে। তার মালয়েশিয়া সরকারকে ১০ কোটি ৮ লাখ ডলার ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও তাকে তা দিতে হচ্ছে না বলেই জানা গেছে।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন মালয়েশিয়ার আজকের সংকটের জন্য মাহাথিরও কম দায়ী নয়। ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে নাজিব রাজাকের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন বারিসান ন্যাশনাল সরকারকে বিদায় করার জন্য মাহাথির সব বিরোধী দলকে নিয়ে এক মহা-ঐক্যজোট গঠন করেছিলেন। সে জোটের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বিরোধী পাকাতান হারাপানের নেতৃত্ব দেন মাহাথির। তার নেতৃত্বে জোটটি অবিশ্বাস্যভাবে জয় লাভ করে।

এই জোট গঠনের আগে মাহাথিরের সাথে দেশটির ক্যারিশম্যাটিকে নেতা আনোয়ার ইব্রাহিমের লিখিত চুক্তি হয় যে, পাকাতান জয়ী হলে পরবর্তী সরকারের দুই বছরের জন্য নেতৃত্ব দেবেন মাহাথির মোহাম্মদ। এরপর আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এই সমঝোতা অনুসারে মাহাথিরের নেতৃত্বে পাকাতান হারাপান সরকার চলে আসছিল। এই মে মাসে এই সরকারের দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ করার কথা ছিল। ঠিক এ সময়ে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে জটিল এক উত্তাল অবস্থা তৈরি হয়।

মাহাথির পূর্ব সমঝোতা অনুসারে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে অনির্দিষ্ট কথাবার্তা বলতে থাকেন। কোনো সময় তিনি বলেন, অঙ্গীকার অনুসারে আনোয়ারের কাছেই সময়মতো ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন। আবার কখনো বলেন, কখন কাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এ বিষয় সুনির্দিষ্ট নয়। এ সময়ে মাহাথিরের দলের নেতারা দাবি করতে থাকেন যে, মাহাথিরকে পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে।

চুক্তি অনুসারে দু’বছর পর প্রধানমন্ত্রিত্ব আনোয়ারের কাছে হস্তান্তরের কথা থাকলেও মাহাথির আগামী নভেম্বরে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় এপেক সম্মেলনের আগে দায়িত্ব হস্তান্তর না করার কথা ঘোষণা করেন। হারাপান জোটের সর্বোচ্চ ফোরামে এই বিষয়ে একমত হয়েই অন্য নেতারা মাহাথিরকে নভেম্বরের পরে হলেও একটি সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ করার জন্য চাপ দেন। সেটি করতে অস্বীকার করে মাহাথির ও তার দলের অন্য নেতারা পাকাতান হারাপান জোট ত্যাগ করার হুঁশিয়ারি দেন। আসলে এসবের মূলে ছিল ডানঘেঁষা আনোয়ারকে কিছুতেই প্রধানমন্ত্রী হতে না-দেওয়া।

মালয়েশিয়ার এই রাজনীতিতে সৌদি আমিরাত বলয় কতটা কাজ করেছে তা এখনো স্পষ্ট নয়। মাহাথির এবার ক্ষমতায় আসার পর সৌদি নেতৃত্বাধীন অকার্যকর ওআইসির বদলে একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক মুসলিম জোট গঠনের উদ্যোগ নেন। তাতে শরিক হয় তুরস্ক, কাতার, ইরান ও পাকিস্তান। আর এ দেশগুলো দুনিয়ায় রাজনৈতিক ইসলামের মদতদাতা হিসেবে পরিচিত।

সৌদি আরব ও আমিরাতের অবস্থান ঠিক এর বিপরীতে। মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক ইসলামের বিকাশ ঠেকাতে তারা মরিয়া। মালয়েশিয়ার রাজা এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দীন এই জোটের ক্রীড়নক কিনা তা সময়ই বলে দেবে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে