কেমন হবে ঈদ

ইন্টারনেটে পাওয়া একটি ঈদকার্ড - সংগ্রহ

  • সাইমা আকন্দ
  • ২৩ মে ২০২০, ২৩:৫৪

ঈদ এসেছে। তবে ঘরে ঘরে আনন্দ আসেনি। এ বছর করোনা ভাইরাস মানুষের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছে লাশের কফিন।

প্রতিদিন বাড়ছে কফিনের সংখ্যা। বাড়ছে উদ্বেগ। মানুষ বন্দি ঘরে। বাইরে ঘুরছে মৃত্যুর শঙ্কা। এই শঙ্কার মধ্য দিয়েই মুসলমানরা রোজা রেখেছেন। এখন তাদের সামনে ঈদের আনন্দ।

কিন্তু কতটা উদযাপন করা যাবে এই খুশির দিন?
এর জবাব সবার জানা। লাশের কফিন মাথায় নিয়ে আনন্দ করা যায় না। যেখানে অর্থনীতির চাকা স্থবির হয়ে গেছে, সেখানে ফিকে হয়ে এসেছে ঈদের প্রস্তুতিও। উৎসবের এই দিনটি হাজির হয়েছে সাদামাটা আয়োজনেই।

হ্যাঁ, অন্য বছরের মতো এই ঈদেও মুসলমানদের ঘুম ভাঙবে সকালে। অন্য ঈদের মতো ফিন্নি-সেমাইও জুটবে অনেকের। কিন্তু দলে দলে ঈদগাহে যাওয়ার সুযোগ হবে না বাংলাদেশে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঘোষণা করেছে, এ বছর স্বাস্থ্যবিধি মেনে মসজিদে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করতে হবে। ঈদগাহে জামাত হবে না।

ঈদকে কেন্দ্র করে করোনা ভাইরাসের প্রকোপ যেন না ছড়ায় এ কারণে নানামুখী সতর্কতা নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। রমজানের দিনগুলোতে সারা দেশে লকডাউন অনেকটা শিথিল হয়ে এলেও ঈদের আগে আগে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এতে যে যেখানে অবস্থান করছেন, সেখানেই করতে হচ্ছে ঈদ। অন্য বছরের মতো এবার দেখা যাচ্ছে না ঘরেফেরা মানুষের ঢল। ঈদের মৌসুমে গণপরিবহনে মানুষের এই ঢল বাংলাদেশের পরিচিত চিত্র। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সেই চিত্রকে। এখন ‘যাত্রীতে টইটম্বুর একটি ট্রেন’ কল্পনা করা তো দূরের কথা, ঠিক কবে ট্রেন চলাচল শুরু করা যাবে এ নিয়েই রয়েছে শঙ্কা।
এই শঙ্কা কেবল বাংলাদেশের নয়, গোটা বিশ্বের। করোনার প্রকোপ থামিয়ে দিয়েছে মানুষের কোলাহল। ঈদকে ঘিরে মুসলিম বিশ্বে খুশির যে ঢেউ তৈরি হয়, এবার সেখানেও দেখা দিয়েছে ভাটা। এমনকি বন্ধ রয়েছে মুসলমানদের সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান পবিত্র কাবা। সংক্রমণের শুরুর দিকেই সৌদি সরকার কাবা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে রমজানেও বন্ধ রাখা হয়। সম্প্রতি দেশটির সরকার জানিয়েছে ঈদের দিনেও খোলা হবে না কাবা। বরং ঈদ-আনন্দের তিনদিনসহ মোট পাঁচদিনের কারফিউ ঘোষণা করেছে সৌদি সরকার।


সৌদিতে ঈদের তিন দিন সরকারি ছুটি থাকে। এই দিনগুলোতে দেশটিতে প্রচুর খাবার ও উপহার বিতরণ করা হয়। ঘরে ঘরে তৈরি করা হয় মিষ্টিজাতীয় খাবার। আত্মীয়রা কেশ-কুটুম্বের বাড়ি-বাড়ি ঘুরেন। অমুসলিমদেরকেও উপহার দেন মুসলিমরা। আর ঈদের কোলাকুলি তো থাকেই। কিন্তু এ বছর একজন থেকে অন্যজনকে থাকতে হচ্ছে নিরাপদ দূরত্বে।

এই দূরত্ব মানুষকে দূরে রাখছে অনেক ঐতিহ্যবাহী রীতি থেকেও। ঈদকে কেন্দ্র নানা দেশে রয়েছে নিজস্ব কিছু রীতিও। তবে সব দেশেই উৎসবের সকাল শুরু হয় মিষ্টিমুখ করে। এ কারণে তুরস্কে এই উৎসবের নাম ‘চিনি উৎসব’। স্থানীয় ভাষায় ডাকা হয় ‘সেকার বাইরাম’। তুর্কীরা ঈদের সকালে পুডিং, ক্যান্ডি, কেক খান। বাকালাভা নামে পেস্ট্রির মতো একটি খাবারও তৈরি করা হয়। ইস্তাম্বুলের মসজিদে মসজিদে জ্বলে উঠে আলো।

এ বছর আলো জ্বলবে কি না, এই প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত জানা যায়নি। যদি ঈদের আনন্দকে কিছুটা হলেও উদযাপন করতে জ্বলেও উঠে ইস্তানবুল। তবে সেই আলো থেকে দ্যুতি ঠিকরাবে না। আলোকোজ্জ্বল আনন্দের দ্যুতি ঠিকরাতে হলে চাই উচ্ছ¡ল মানুষের উপস্থিতি।

যে শহরের সড়কে মানুষ নেই, কোলাহল নেই। সেই শহরে আলোর উজ্জ্বলতা অর্থহীন।
করোনার প্রকোপে রঙ হারিয়েছে মিশরের ঈদ। রঙিন আয়োজনের এই দেশটিতে এ বছর ঈদ এসেছে ধূসর রঙ নিয়ে। ঈদের সকালে কায়রোর পথে পথে দেখা যাবে না শিশুদের। অথচ পিরামিডের এই দেশে ঈদের সকালটা বরাবরই থাকে রঙিন বেলুনে ভরপুর। কেবল ছোটরাই বেলুন নিয়ে ঘুরে এমন নয়, কায়রোতে আল-সেদ্দিক মসজিদের জামাতের ওপর সারি করে ঝুলানো থাকে বেলুন। নামাজ শেষ হলেই ওগুলো উড়িয়ে দেওয়া হয়।

এ বছর হয়তো আল-সেদ্দিক মসজিদে এই আয়োজন নাও থাকতে পারে। যদি থাকেও, তবে কায়রোর সড়কে নিশ্চয় নামবে না শিশুদের ঢল। সেইসঙ্গে আনন্দের জোয়ার। করোনার প্রকোপে কায়রোর সড়ক প্রাণহীন। ঈদের সকালের দৃশ্যটাও থাকতে পারে এমনই।

এই দৃশ্য একেবারেই বেমানান, এমনকি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর জন্যও। আফগানিস্তানের মতো দেশে ঈদের দিনেও শুনা যায় বোমার আওয়াজ। বাতাসে ভাসে বারুদের গন্ধ। তবুও থেমে থাকে না ওই দেশের ঈদ আনন্দ। আফগান কাবুলিওয়ালাদের বসতি সংগ্রামকে সঙ্গে নিয়ে। এরা লড়াই করছে, অস্থিতিশীল এক বিশ্বের সঙ্গে। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই প্রতিবছর দেশটিতে ঈদ আসে। আনন্দও হয়। একদিকে রক্তের ¯্রােত বয়ে যায়। অন্যদিকে চলে রঙিন আয়োজন।

কিন্তু এ বছর?
এ বছর থমকে গেছে কাবুলিওয়ালারাও। তারাও এখন লড়াই করছে করোনার বিরুদ্ধে। এই লড়াই ফিকে করে দিচ্ছে সকল আনন্দ।

ফিকে হয়ে আসছে সিরিয়ার আনন্দও। ওখানেও ঈদের নামাজ শেষ হওয়ার পর গুলি চলার রেকর্ড আছে। আরসারা বছর গুলি ঝরে বৃষ্টির মতো। পৃথিবীর বড় শক্তিগুলোর লড়াই এই ভ’মিতে। সিরিয়া এখন লড়াইয়ের মাঠ। এই মাঠে একদিকে সাম্রাজ্যবাদি শক্তির লড়াই, অন্যদিকে চলেছে ঈদের আনন্দও। এমনকি ঈদের দিনে ঝুঁকি মাথায় নিয়ে দেশটির অনেক নেতাকে দেখা যায় প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে। এ বছর সেটা অনেকটাই দুঃসপ্নের মতো।

একই অবস্থা ইরাকের। আমেরিকার চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের পর ইরাকের মাটি পরিণত হয়েছে বৈশ্বিক রণক্ষেত্রে। এই ক্ষেত্রে চাষ হয় হিংসা ও নৃশংসতা। এর মধ্য দিয়েই দেশটির মুসলমানরা ঈদগাহে যান। ওই দিনেও ঘটে যায় গাড়িবোমার হামলার মতো ঘটনা। তাতেও ঈদে মানুষের সমাগম ঠেকানো যায়নি। তবে এবার মানুষকে ঘরবন্দি করে রেখেছে করোনা ভাইরাস।

এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়েছে ইরান। দেশটিতে করোনার ব্যাপক প্রকোপ থাকলেও তারা ঈদের নামাজ ঈদগাহে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশটির সরকার জানিয়েছে সবগুলো শহরে খোলা মাঠে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হবে। তবে এ ক্ষেত্রেও নেওয়া হবে সাবধানতা। ইরান জানিয়েছে, যেসব মাঠে মানুষের সমাগম বেশি হতে পারে, সেসব মাঠে আয়োজন বন্ধ রাখা হবে। স্বাস্থ্যবিধির দিকেও থাকবে দেশটির বিশেষ নজর।
করোনা ভাইরাসের প্রকোপ কম হলেও সতর্কব্যবস্থা রেখেছে মধ্য এশিয়ার দেশ কিরগিজস্তান। পাহাড়ঘেরা সবুজ এই দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিলো। দীর্ঘদিন কমিউনিস্ট শাসন চলে সেখানে। এতে ইসলামি সংস্কৃতির চর্চা অনেকটাই কমে যায় সেখানে। ইউনিয়নের পতনের পর ধর্মচর্চা সেখানে বাড়তে থাকে। এর ধারাবাহিকতায় দেশটিতে বিশাল এক মসজিদ নির্মাণ করে দিয়েছে তুরস্ক। একাদশ শতকের ইসলামিক ব্যক্তিত্ব ইমাম সেরাহসির নামে রাখা হয় মসজিদটির নাম।

কিরগিজস্তানেও ঈদ নিয়ে আসে আনন্দ। এই করোনা ভাইরাসের প্রকোপেও সেখানকার আনন্দে অন্য দেশগুলোর মতো এতোটা ভাটা পড়বে না। এই প্রতিবেদন তৈরি করা পর্যন্ত কিরগিজস্তানে আক্রান্তর সংখ্যা মাত্র ১১৩৮। মৃত্যু হয়েছে ১৪ জনের। সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন ৮০৪ জন। তবুও বৈশ্বিক এই সঙ্কটের মধ্যে সতর্ক রয়েছে দেশটির সরকার। খুব দরকার ছাড়া বাইরে বের হচ্ছে না নাগরিকেরা।

একই অবস্থা উজবেকিস্তানে। সেখানে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১২। মোট দুই হাজার ৭৫৩ জন আক্রান্তর মধ্যে দুই হাজার ২৪৭ জনই সুস্থ্য হয়ে উঠেছেন। সে হিসাবে দেশটির অবস্থা ভালো। তারপরও ঈদকে ঘিরে বাড়তি সতর্কতা রয়েছে দেশটির।

শুরুর দিকে যেভাবে জেঁকে বসেছিলো, সেই অবস্থা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে মালয়েশিয়া। দেশটিতে এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ১১৩। ব্যাপক পরীক্ষা চালানোর কারণে আক্রান্ত এবং মৃত্যু কমানো গেছে। দেশটিতে এখন যেমন বিধিনিষেধ চলছে, ঈদেও তেমন চলবে। ওখানে ঈদের আগের রাতকে বিশেষভাবে উদযাপন করা হয়। মসজিদ ও সড়ক তাকবির ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে উঠে বলে চাঁদরাতকে ডাকা হয় ‘তাকবিরান’। এইরাতে মালয়েশিয়ার সড়কে জ্বলে মশাল, ফুটানো হয় আতশবাজি। চলে ঐতিহ্যবাহী নানা খাবারের আয়োজন। তবে এবার সব আয়োজন থামিয়ে দিয়েছে প্রাণঘাতী ভাইরাস।

ইন্দোনেশিয়ার ঈদের আয়োজনগুলোও থাকে অনেকটা মালয়েশিয়ার মতো। তারা এই উৎসবকে ডাকে ‘লেবারান’। চাঁদরাতেই শুরু হয়ে যায় লেবারানের জৌলুস। মসজিদে মসজিদে শুরু হয় বয়ান। জ্বলে উঠে আলো। নারিকেল পাতার ভাঁপে বানানো হয় চালের পিঠা। ঈদের দিন আত্মীয়দের বাড়ি-বাড়ি ঘুরে ক্ষমা চাওয়া তাদের রীতি। অনেক সময় ক্ষমা চাওয়ার এই তালিকা শেষ করতে কয়েক দিন লেগে যায়। এ বছর তাদের রীতি মেনে ক্ষমা চাওয়া হবে না।

মোটাদাগে বলা যায় যেসব দেশে করোনার প্রকোপ বেশি সেসব এলাকায় ঈদের আয়োজনে ততবেশি কাটছাট করা হচ্ছে। যেসব দেশে মুসলমানদের সংখ্যা কম, সেসব এলাকায় থাকছে না ঈদকে ঘিরে রাষ্ট্রীয় বিশেষ বিধি-বিধান। সেক্ষেত্রে করোনাকে কেন্দ্র করে দেশের জারি করা বিধান মেনে মুসলমানদেরকে আয়োজন করতে হচ্ছে ঈদ উৎসব। ভারতের কাশ্মিরসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম এলাকা রয়েছে, যাদের কাছে ঈদের আনন্দটা নানা কারণেই ফিকে। এমন একটি এলাকা চীনের উইঘুর। ওখানকার মুসলমানরা বরাবরই নির্যাতিত। অভিযোগ রয়েছে দেশটির সরকার উইঘুরদের ওপর পীড়ন চালায়। তারপরও এলাকাগুলোতে ঈদের জমকালো আয়োজন থাকে। তবে এ বছর করোনা ভাইরাস পন্ড করে দিয়েছে সব।

উইঘুর ছাড়া চীনের অন্য এলাকার মুসলিমরা অনেকটাই ভালো দিন কাটাচ্ছেন। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জিনজিয়ান ও নিংজিয়া প্রদেশে ঈদে থাকে তিন দিনের সরকারি ছুটি। ওইসব এলাকায় সরকারিভাবে বিতরণ করা হয় ভেড়ার গোশত। ইউনান প্রদেশের মুসলমানদের ঈদকে ঘিরে থাকে বিশেষ আয়োজন। রাজধানী বেইজিংয়ে মুসলমান পাড়াগুলোতে থাকে ঈদের আয়োজন। এ বছর থাকছে না তেমন কিছুই। যা হবে, সবই সীমিত পরিসরে।

চীনের উহান একবার ভাইরাস থেকে মুক্তি পেলেও নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন অনেকে। এতে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

এই শঙ্কা অন্যদেশগুলোতেও। অস্ট্রেলিয়ার মুসলমানদেরও ঈদ করতে হচ্ছে সীমিত পরিসরে। সিডনিতে একটি ঈদফেয়ার হয়। সেখানে লাখের বেশি মানুষের সমাগম হয়। মেলবোর্নে সরকারি ছুটির দিনে বড় করে ঈদ উদযাপন হয়। অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরায় পুলিশ ফেডারেশন ঈদ উৎসবের জন্য স্পন্সর করে। এসব উৎসবে বিভিন্ন রাইড, স্টল থাকে ও নানা দেশের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। এ বছর বন্ধ থাকছে সব অনুষ্ঠান।

প্রতি বছর চাঁদরাত থেকে ঈদের আনন্দ শুরু হয় দক্ষিণ আফ্রিকার মুসলিম কমিউনিটিতে। মাগরিবের নামাজের পর চাঁদ দেখার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। এবারও ঘোষণা আসবে। কিন্তু সামাজিক দূরত্ব মানুষকে নিয়ে যাবে আনন্দ থেকে দূরে।

তবে সেই দূরত্ব সাময়িক। আশা করা হচ্ছে, খুব দ্রুত কেটে যাবে সংকট। আবার চঞ্চল হবে পৃথিবী। করোনাকালের এই ঈদ আরো দৃঢ় করবে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ব।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে