ভারতে মুসলিম ঐতিহ্য মুছে ফেলার মিশনে মোদি


  • মোতালেব জামালী
  • ২১ জুন ২০২১, ১৩:৫৫

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ‘একটি ভালো সংকটকে কখনও নষ্ট করতে নেই। কেননা, সংকট সব সময়ই একটি কঠোর সরকারের অশুভ উদ্দেশ্যকে আড়াল করে রাখার বিরাট সুযোগ এনে দেয়। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্ভবত চার্চিলের এ কথাটি তার অন্তরে গেঁথে নিয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানা ছল-ছুতোয় মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে ভারতের ২০ কোটির বেশি মুসলমানকে সব সময়ই হয়রানি ও নির্যাতন-নিপীড়ন করে চলেছেন। মুসলমানদের নাগরিকত্ব পর্যন্ত কেড়ে নিচ্ছেন। এখানেই শেষ নয়, সুলতানি ও মোগল আমলসহ ভারতে বিভিন্ন মুসলিম শাসকের শাসনামলে যেসব স্থাপত্য ও ভবন নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোও নানা কারণ দেখিয়ে ভেঙে ফেলছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। কীভাবে মোদি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছেন, দ্য গার্ডিয়ানে তা তুলে ধরেছেন পুরস্কার-বিজয়ী বিখ্যাত ভাস্কর অনিশ কাপুর।

ভারতে করোনা ভাইরাস মহামারির দোহাই দিয়ে মোগল আমলের স্থাপত্যকলার অনুকরণে নির্মিত পার্লামেন্ট ভবনও ভেঙে ফেলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, করোনার কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বর্তমান পার্লামেন্টে স্থান সংকুলান করা সম্ভব হচ্ছে না। এভাবে কট্টর হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার নানা অজুহাতে ভারতে মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্যকে চিরতরে মুছে ফেলতে চাইছে। তাদের অন্তরে দীর্ঘ দিন ধরে লালিত মুসলিম ও ইসলামবিদ্বেষী পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করে চলেছে।

অযোধ্যায় সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত বাবরি মসজিদ ১৯৯২ সালে কংগ্রেস সরকারের আমলে ভেঙে ফেলার মধ্য দিয়ে ভারতে মুসলিম ও ইসলামি স্থাপনা ভাঙার যাত্রা শুরু হয়। নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে এসে তা চরম আকার ধারণ করেছে।

গত বছর সারা ভারতে যখন করোনা ভাইরাস মহামারি ছড়িয়ে পড়ায় দেশের মানুষ চরম আতঙ্কিত, সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অযোধ্যায় উড়ে যান এবং বাবরি মসজিদের জায়গায় রাম মন্দির নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০২৪ সালে পার্লামেন্ট নির্বাচনের আগে এই মন্দির উদ্বোধন করা হবে। অর্থাৎ, এই মন্দির হবে মোদি ও তার দল বিজেপির হিন্দুত্ববাদী নির্বাচনি ট্রাম্পকার্ড।

বাবরি মসজিদ ও রাম মন্দির নিয়ে বিরোধের মতো একই ঘটনা ঘটেছে উত্তর প্রদেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নির্বাচনি এলাকা বারানসীতে। সেখানের একটি উগ্র হিন্দু সংগঠন দাবি করে যে, মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে তিনি বহু প্রাচীন বিশ্বনাথ মন্দিরের একটি অংশ ভেঙে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছেন।

মসজিদটি এলাকায় জ্ঞানবাপি মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদ ভেঙে ফেলার অনুমতি চেয়ে আদালতে মামলা করে সংগঠনটি। আদালত গত এপ্রিল মাসে হিন্দুদের পক্ষেই রায় দিয়েছে। স্থানীয় মুসলমানরা আশঙ্কা করছেন যে, এই মসজিদটির পরিণতিও বাবরি মসজিদের মতোই হতে পারে ।

সম্প্রতি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বারাবানকি জেলায় শত বছরের পুরনো একটি মসজিদকে ‘অবৈধ স্থাপনা’ হিসেবে উল্লেখ করে সেটি ভেঙে ফেলা হয়েছে। মসজিদটি ভাঙায় আদালতের নিষোজ্ঞা থাকলেও তা গ্রাহ্য করেনি স্থানীয় প্রশাসন। স্থানীয় মুসলমানরা যাতে মসজিদ ভেঙে ফেলার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ করতে না পারেন সেজন্য কয়েকশ পুলিশ দিয়ে এলাকাটি ঘিরে রাখা হয়।

স্থানীয় মুসলমানরা জানান, গরীবে নেওয়াজ আল মারুফ মসজিদ নামে পরিচিত এই মসজিদটি ভাঙার মাস খানেক আগে থেকেই সেখানে নামাজ পড়া বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। বারাবানকি জেলার এই মসজিদটি অযোধ্যার বাবরি মসজিদ থেকে ৬২ মাইল দূরে অবস্থিত।

বারবানকি জেলার মুসলমানদের প্রধান নেতা মাওলানা আব্দুল মোস্তফা বলেন, গরীবে নেওয়াজ আল মারুফ মসজিদটি ব্রিটিশ শাসনামলে নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারের রাজস্ব বিভাগে এর দালিলিক তথ্য-প্রমান রয়েছে। এটি একটি বৈধ স্থাপনা। যুগ যুগ ধরে মুসলমানরা এই মসজিদে নামাজ আদায় করে আসছে। মসজিদটি ভেঙে ফেলায় এলাকার মুসলমানরা মনে বিরাট আঘাত পেয়েছেন। আমাদের ধর্মীয় সেন্টিমেন্টে আঘাত করা হয়েছে। তিনি বলেন, এটা মুসলিম নির্যাতন ছাড়া আর কিছুই নয়।

ভারতের বিভিন্ন স্থানে এভাবে মসজিদ ভাঙার পাশাপাশি সরকারি ভাবেই প্রাচনী স্থাপত্য ভাঙার কাজ চলছে। পুনঃউন্নয়নের নামে শুধু পার্লামেন্ট ভবনই নয়, ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ নামে ২০ হাজার কোটি রুপির একটি বড় প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর আওতায় আরো ১২টি পুরনো ভবন ভেঙে সেখানে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। সরকারের চাপের মুখে ভারতের হাই কোর্টও কোন রকম শুনানী বা এ অভিজ্ঞ মহলের পরামর্শ ছাড়াই কয়েক সপ্তাহ আগে প্রকল্পটি সামনে এগিয়ে নেয়ার অনুমতি প্রদান করেছে।

ব্রিটিশ স্থপতি এডউইন লুটেনস ১৯১১ সাল থেকে ১৯৩১ সালের মধ্যে দিল্লির পার্লামেন্ট ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। ইরানের মুসলিম শাসকরা এবং মধ্য এশিয়ার তৎকালীন সমরখন্দ রাজ্যের শাসকরা ইসলামী স্থাúত্য রীতি অনুসরণ করে যে ধরণের ভবন ও স্থাপনা নির্মাণ করতেন। ভারতের পার্লামেন্ট ভবন ও অন্যান্য স্থাপনাতেও প্রায় একই ধরণের নির্মাণশৈলী অনুসরণ করা হয়েছে। মোগল সম্রাটরা লাল পাথর দিয়ে তাদের প্রাসাদ ও বিভিন্ন দুর্গ নির্মাণ করতেন। বিখ্যাত লাল কেল্লা এমন একটি স্থাপনা। পার্লামেন্ট ভবনও নির্মাণেও তেমনিভাবে লাল পাথর ব্যবহার করা হয়েছে।

লুটেনসের ডিজাইন করা এসব স্থাপনা আধুনিক সময়ে ইসলামি চিন্তাধারা প্রসুত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শণ। এ কারণে বিশ্বের যে কোন দেশের সরকারি ভবনগুলোর তুলনায় অনন্য হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব স্থাপনা কট্টর ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী মোদি সরকার ও তার দল বিজেপির নেতাদের প্রতিহিংসার কবলে পড়েছে। সেজন্যই ত্রাা এগুলো ধ্বংস করছে। বিশ্বমানের এসব স্থাপনা ধ্বংসের মাধ্যমে মোদি সরকার ও তার দল বিজেপি ভারতকে ইসলামি নিদর্শন ও চিন্তাধারার প্রভাবমুক্ত করার নিরন্তর অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

মোদি সরকার সারা ভারতেই উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। এক্ষেত্রে তারা ভারতে মুসলিম শাসনের প্রতীক হয়ে থাকা বিখ্যাত সব স্থাপনা ও সৌধগুলোকে বেছে নিয়েছে ধ্বংস করার জন্য। একইসঙ্গে হিন্দুত্ববাদী চেতনাকে সব কিছুর উপরে তুলে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে একজন ভারতীয় হিন্দু স্থপতিকে ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়েছে মোদি সরকার।

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ভারতে ঐতিহ্যবাহী ভবন ও স্থাপনাগুলো ধ্বংস করার ব্যাপারে জাতিসংঘ ঐতিহ্য ফোরাম সম্পূর্ণ চুপ করে রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংস্থাগুলোও তাদের মুখে কুলুপ এটে রেখেছে। ভারতে ঐতিহ্য ধ্বংস করা নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই।

অন্য সময় হলে হয়তো ২০ হাজার কোটি রুপির এই ‘সেন্ট্রাল ভিস্তা’ প্রকল্প নিয়ে এত প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু করোনা মহামারীর সময় এত টাকা খরচ করে নতুন পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণের জন্য দেশে ও বিদেশে প্রশ্নের মুখে পড়েছে মোদি সরকার। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, এই প্রকল্প লকডাউনের আগে থেকে শুরু হয়েছে। করোনা বিধি মেনেই এই প্রকল্পে শ্রমিকরা কাজ করছেন। কিন্তু তার পরও কিছুতেই সরকারের এই প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা থামছে না।

যেখানে ভারতের কোটি কোটি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করছে, দিনে একবেলাও ঠিকমতো খেতে পারছেনা সেখানে ২০ হাজার কোটি রুপি ব্যয় করে নতুন পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণসহ বিরাট প্রকল্প বাস্তবায়ন করা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয় বলে সমালোচকরা বলছেন।

আন্তর্জাতিক সাময়িকী নেচার নরেন্দ্র মোদি সরকারের এই প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা করেছে। এর আগে নেচার পত্রিকা জানিয়েছিল, ভারতে করোনা পরিস্থিতির অবণতি রাজনৈতিক ব্যর্থতার ফল। এবার তাদের টার্গেট সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প। মহামারীর সময় এত টাকা খরচ করে এমন প্রকল্পের দরকার কি ছিল এমন প্রশ্ন তুলেছে পত্রিকাটি।

একথা হয়ত অনেকেই বলতে পারেন যে, ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতে একটি আধুনিক পার্লামেন্ট ভবন নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কিন্তু সেই কাজটি দিল্লির একটি ঐত্যিবাহী স্থাপনা ধবংস করে করার কতটুকু যৌক্তিকতা রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

দিল্লি বর্তমানে পরিবেশ দূষণের শীর্ষে থাকা একটি নগরী। আধুনিক ভারতের রাজধানী হবার যোগ্যতা হারিয়েছে দিল্লি। অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, মোদি সরকারের চিন্তা-চেতনাও আধুনিক হওয়া উচিত ছিলো। দিল্লির পরিবর্তে অন্য কোথাও নতুন ও আধুনিক রাজধানী গড়ে তোলার চিন্তা করা যেতে পারে।

কিন্তু, তা না করে মোদি সরকার দিল্লির পুরনো আমলের মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক-বাহক স্থাপনাগুলো ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতের সব শ্রেণি ও ধর্মের মানুষের ওপর বিজেপির উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনাকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা কার্যত হিন্দু ভারত গড়ে তোলারই একটি পদক্ষেপ। মোদি নিজেকে সেই উদ্যোগের জনক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে চান বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।