ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ

-

  • মোতালেব জামালী
  • ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৩:১২

ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। এক্ষেত্রে দেশটি ৫ শতাধিক মিডিয়া ও ডজনখানেক এনজিও’র নাম ব্যবহার করেছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের এই অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য প্রচারকেই আধুনিক যুগে ‘পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।

ব্রাসেলসভিত্তিক সংগঠন ইইউ ডিসইনফোল্যাব সম্প্রতি তাদের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলছে, ভারত গত ১৫ বছর ধরে বিশ্বের ১১৬টি দেশে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালিয়েছে। তাদের এই নেটওয়ার্কটি জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নেও ভারতের পক্ষে ও পাকিস্তানের বিপক্ষে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েছে। ইইউ ডিসইনফোল্যাব হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি সহযোগী সংগঠন। তারা তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের নাম দিয়েছে ইন্ডিয়ান ক্রনিকলস।

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, ভারতীয় সংবাদ সংস্থা এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল এই নেটওয়ার্কটির পাকিস্তানবিরোধী মিথ্যা সংবাদ প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। তবে প্রতিবেদনে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণায় জড়িত এই নেটওয়ার্কটির সাথে ভারত সরকারের কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতার বিষযটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা বা সমর্থন ছাড়া যে এত বড় একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করা সম্ভব নয় তা বলাই বাহুল্য।

প্রায় ১৫ বছর ধরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের পাকিস্তানবিরোধী এই অপপ্রচার ও মিথ্যা প্রচারণা কি করে বাধাহীনভাবে চলল,পাকিস্তান সরকার ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এতদিন ঘুমিয়ে ছিল কিনা তা নিয়ে পাকিস্তানের জনগণ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন তুলতে পারেন।

সরকারের বিরোধীপক্ষ ও সমালোচকরা এই ব্যর্থতার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বিলুপ্ত করার দাবি করতেই পারেন। পাকিস্তান যে কি ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তা ভারতের এই কর্মকান্ড থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ ঘটনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, শুধু সেনাবাহিনী বা গেরিলা বাহিনী দিয়েই যুদ্ধ করা যায় না, বরং মিথ্যা তথ্য ছড়ানো এবং অপপ্রচার চালিয়েও একটি দেশ তার প্রতিপক্ষ বা শত্রুদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে। ভারত সেটা সফলভাবে প্রমাণ করেছে।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের এই অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য প্রচারকেই আধুনিক যুগে ‘পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এই যুদ্ধে কোন সেনাবহিনী বা কোন ধরণের সমরাস্ত্রের প্রয়োজন নেই। এই যুদ্ধটি করতে হয় সাধারণ জনগণের মন-মগজে মিথ্যা তথ্য ঢুকিয়ে দিয়ে তার চিন্তা-ভাবনাকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে।

ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধই গত ১৫ বছর ধরে চালিয়ে গেছে। আধুনিক এই যুদ্ধের উপকরণ হচ্ছে ধারণা, তথ্য, অপপ্রচার ও ‘ভূয়া খবর’ ইত্যাদি। এগুলোই হচ্ছে আধুনিক এই যুদ্ধের কৌশল বা হাতিয়ার। ইইউ ডিসইনফোল্যাব যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে, পাকিস্তান ভারতের এই নতুন ধরণের যুদ্ধের মোকাবেলা করছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, “পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ” ব্যাপকভাবে স্বীকৃত কোন ধারণা নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আন্তর্জাতিক নিরপত্তা বিষয়ক ইস্যু নিয়ে লেখালেখি করে এমন ৫টি জার্নাল বা সাময়িকী হচ্ছে- ইন্টারন্যানাল সিকিউরিটি, জার্নাল অব কনফ্লিক্ট রেজুল্যুশন, জার্নাল অব পিস রিসার্চ, জার্নাল অব ষ্ট্র্যাটেজিক ষ্টাডিজ ও সিকিউরিটি ষ্টাডিজ। এই ৫টি জার্নালে গত ৫ বছর ধরে যে সব নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে তাতে “পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ” সম্পর্কে কোন লেখা ছাপা বা প্রকাশিত হয়নি। এ ধরণের একটি বিপ্লবী ধারণা এই ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের চোখ এড়িয়ে যাবে সেটাও কল্পনা করা যায়না।

পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ সম্পর্কিত ধারণাটির প্রতি বিশেষজ্ঞদের মনোযোগ না দেয়ার একটা কারণ হতে পারে, নতুন এই ধারণাটির বৈধতা খুবই সীমিত। অনেক বিশেষজ্ঞই এটাকে ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। আটলান্টিকের উভয় পাড়ের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা রাশিয়ার পররাষ্ট্র নীতিকে এবং তাদের গোয়েন্দাদের অন্তর্ঘাতমূলক ও অনৈতিক কর্মকান্ডকে হাইব্রিড যুদ্ধ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।

‘পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধের’ সমালোচকরা বলে থাকেন যে, ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ অনেক দিক থেকই একটি অর্থহীন টার্ম। মূলত এটি হচ্ছে যুদ্ধের অসম বা সামঞ্জস্যহীন কিছু উপাদানের সাথে কূটনীতি মিশিয়ে যে যুদ্ধটা করা হয় সেটাই হ”েছ হাইব্রিড যুদ্ধ।

সত্যিকারভাবে বলতে গেলে, ‘পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধ’ ও ‘হাইব্রিড যুদ্ধ’ টার্ম দু‘টির প্রচলন হয়েছে বিংশ শতাদ্বীর শুরুর দিকে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে তাকে বিভ্রান্ত ও ঘায়েল করে নিজের স্বার্থ হাসিলের একটি কৌশলগত অস্ত্র হিসেবেই এ টার্ম দু’টির প্রচলন হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এসব কৌশল ব্যবহার করাটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিয়মিত কার্যক্রমের অংশে পরিণত হয়েছিল। সে সময় মিথ্যা তথ্য প্রচার ও অপপ্রচারের মাধ্যমে প্রতিপক্ষের উপর মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টির জন্য উভয়পক্ষই বিভিন্ন ধরণের মিডিয়া প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছিল। এটাকে স্বাভাবিক রাজনীতি ও কূটনীতির অংশ হিসেবেই ব্যবহার করা হয়েছিল।

প্রতিপক্ষকে মুখে হুমকি দেয়ার চেয়ে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে হুমকি দেয়া একটি কার্যকর কৌশল হিসেবে নেয়া হয়েছিল। সেকারণেই প্রুশিয়ার সামরিক তাত্ত্বিক কার্ল ভন ক্লজেইটস বলেছিলেন- সব যুদ্ধই রাজনীতি, কিন্তু সব রাজনীতিই যুদ্ধ নয়।

ভারত যখন জঙ্গি বিমান, ক্ষেপনাস্ত্র ও ফ্রিগেট কেনে, তখন পাকিস্তানের সামনে এর বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহন করা ছাড়া আর কোন উপায় খোলা থাকেনা। পাকিস্তানও তার নিজের নিরাপত্তার জন্য একইধরণের সমরাস্ত্র সংগ্রহ করে। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের প্রোপাগান্ডা যুদ্ধের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ইসলামাবাদ কি ধরণের পদক্ষেপ গ্রহন করেছে সে বিষয়ে অবশ্য তেমন কোন কিছু জানা যায়না।

বাস্তবতা হচ্ছে পাকিস্তান নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের দিক থেকে শুধু সামরিক হুমকি নয়, প্রোপাগান্ডা যুদ্ধের হুমকির মুখেও রয়েছে। কারণ ভারতের পাকিস্তানবিরোধী সর্বাত্মক প্রোপাগান্ডা যুদ্ধের মোকাবেলায় ইসলামাবাদ তেমনভাবে প্রস্তত আছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন না।

ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গত ৫ বছরের শাসনামলে তাদের আগ্রাসী পররাষ্ট্র নীতির কারণে এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে। মোদি সরকার একদিকে অধিকৃত কাশ্মীরের স্বায়ত্বশাসন হরণ করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে। সেখানে নানা ধরণের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে মদদ দিচ্ছে। এতে উত্তেজনা বাড়ছে এবং অস্থিতিশীল দক্ষিন এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটছে।

ইইউ ডিসইনফোল্যাবের প্রতিবেদনে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক আচরণ নিয়ে গভীর বা বিস্তারিত কোন আলোচনা করা হয়নি। এতে কেবলমাত্র ভারতের মিডিয়াগুলো কিভাবে সরকারের সাথে সংশ্লিষ্ট বিশেষ করে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে সরকারের সহযোগি হয়ে কাজ করে তাই তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য ইইউ ডিসইনফোল্যাবের এই প্রতিবেদন পাকিস্তানের কূটনীতির জন্য খুবই কাজে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ভারত সরকার ও তাদের মিডিয়াগুলোর মধ্যে এ ধরণের নীতিহীন সম্পর্ক নতুন কিছু নয়। মাত্র দেড় বছর আগে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সম্পর্কের এত মারাত্মক অবনতি ঘটেছিল যে পরিস্থিতি পারমানবিক যুদ্ধের দিকে মোড় নিতে যাচ্ছিলো। সেই উত্তেজনাকর মুহুর্তেও ভারতের মিডিয়াগুলো দেশটির সরকারের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানবিরোধী প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত ছিল বলে পোলিশ প্রজেক্ট ষ্টাডির এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতের এসব মিডিয়া তাদের সরকারের পাকিস্তান বিরোধী প্রোপাগান্ডায় মাইক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এসময় তারা তারা ভারতে উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা উস্কে দিতে নানা রকম ভিত্তিহীন দাবি করা ও উস্কানীমূলক বক্তব্য প্রচারে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছে।

ইইউ ডিসইনফোল্যাবের প্রতিবেদেনে এটা আরো স্পষ্টভাবে প্রমানিত হয়েছে যে, ভারতের বেসরকারি মেইনষ্ট্রিম মিডিয়া নানা উপায়ে সরকারের হাত হিসেবে কাজ করে। কিন্তু এসব করতে গিয়ে তারা বাস্তবে পাকিস্তানের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী এবং ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মর্যাদা নষ্ট করেছে। মোদি সরকারের আমলে একটি গনতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভারতের অবস্থান ও মর্যাদা আরো ক্ষুন্ন হয়েছে।

পশ্চিমা দেশগুলো ভারতের সাথে ভাল সম্পর্ক বজায় রাখে তার গনতান্ত্রিক মর্যাদার জন্য নয়। তারা এটা করে একদিকে দেশটির অর্র্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন ও অন্যদিকে চীনকে মোকাবেলায় ভারতকে ব্যবহারের জন্য। ইমরান খানের সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের আগ্রাসী আচরণ ও পাকিস্তানবিরোধী প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে কূটনীতিকেই প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। কিন্ত তাতে পাকিস্তান কতটুকু সফল হবে তা নিয়ে বিশ্লেষকদের সন্দেহ রয়েছে।