ভারত-পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে ড্রোন যুদ্ধ কেমন হবে

একটি পাকিস্তানী ড্রোনকে ভূপাতিত করে ভারত - এএনআই

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:৪৫

পদাতিক সেনারা যেখানে জীবনের ঝুঁকি নিয়েও যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে দুর্বল করতে নাজেহাল হয়ে যায়। সেখানে ড্রোন দিয়ে বহুদূর থেকেই সুইচ টিপে যেকোনো সময় শত্রুক্ষের সীমানার ভেতরে ঢুকে তাদেরকে বিপর্যস্ত করে ফেলা সম্ভব হয়। এ বাস্তবতা নতুন যুগের যুদ্ধকৌশল সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করছে। সামরিক বাহিনীগুলো এখন মানুষের পরিবর্তে যন্ত্র দিয়ে আকাশ থেকেই শত্রুকে সনাক্ত করতে এবং তাদের ওপর গোলা বর্ষন করে ধ্বংস করে দিতে বরং বেশি আগ্রহী।

নাগারনো-কারাবাখের যুদ্ধে আর্মেনিয়ার ভয়াবহ বিপর্যয়ের পর সব দেশই এ যুদ্ধ থেকে কম বেশি শিক্ষা নিয়েছে। আজারবাইজানের এ যুদ্ধে সফল হওয়ার মূল কারণই ছিল ড্রোনের ব্যবহার। ভারতও এ যুদ্ধ থেকে অনেক কিছু শিখেছে। ভারতের জন্য এ মুহুর্তে এ শিক্ষা নেয়া জরুরি কেননা দেশটি এখন তার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী ও আধুনিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। গ্রহণ করছে নানামুখী পরিকল্পনা ।

আজারবাইজানের সফলতার নেপথ্যে সামরিক বিশ্লেষকরা বেশ কিছু কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন নিয়মিতভাবে ড্রোনের ব্যবহার ও দ্রুত আনা-নেয়া সম্ভব এমন ধরনের সমরাস্ত্রের ব্যবহার। আজারবাইজান এসব অস্ত্র কিনেছিল তুরস্ক ও ইসরাইল থেকে। এসব সমরাস্ত্র দিয়েই আজারবাইজান শত্রুপক্ষের ট্যাংক, সামরিক যান, সেনাদের ট্রেঞ্চ, রাডার এবং অন্যন্য প্রযুক্তি ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। আর্মেনিয়ার কাছে রাশিয়ার থেকে আমদানি করা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ছিল। সেনাদের হাতেও নানা ধরনের অস্ত্র ছিল। কিন্তু আকাশ দিয়ে উড়ন্ত ড্রোনের কাছে এসব কিছু কোনো পাত্তা পায়নি।

১৯৯০ সালের যুদ্ধের শুরুর দিকে, সামরিক অস্ত্র, শক্তিমত্তা ও প্রযুক্তির দিক থেকে আর্মেনিয়া আজারবাইজানের চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল। কিন্তু এখন সে পরিস্থিতি একেবারেই পাল্টে গেছে। আজারবাইজান বিগত কয়েক বছরে বড়ো আকারের অর্থ বিনিয়োগ করে সামরিক বাহিনীতে নতুন নতুন প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে। ফলে, এবারের যুদ্ধে তারা দৃশ্যমান জয় লাভ করেছে। এভাবে ড্রোনের ব্যবহার বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে ট্যাংকের কার্যকারিতাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধ ইতিহাসে এমনটা আগেও ঘটছে। যেমন, মোঘল যুগের আগে হাতির অনেক ব্যবহার ছিল। কিন্তু স¤্রাট বাবর গানপাউডার ব্যবহার শুরু করার পর থেকে হাতির কার্যকারিতা ও উপযোগিতা একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়।

সামরিক বিশ্লেষক মাইক এককেল মনে করেন, ড্রোন এখন অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেকটাই ব্যাপকভাবে প্রয়োগ ও ব্যবহার হচ্ছে। যুদ্ধের ময়দানের চিত্রই পাল্টে দিচ্ছে ড্রোন। এর মধ্য দিয়ে ভবিষ্যতের যুদ্ধের চিত্র কেমন হতে পারে তাও আমরা আভাস পাচ্ছি। ওয়াশিংটন পোস্টের এক বিশ্লেষনে বলা হয়েছে, নাগারনো কারাবাখ খুব সম্ভবত বড়ো একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে যার মধ্য দিয়ে আমরা দেখতে পেলাম যে, অল্প বিনিয়োগের ছোট ছোট ড্রোন হামলা কীভাবে যুদ্ধের ডাইমেনশনকেই পালটে দেয়।

একসময় যুদ্ধক্ষেত্রে পদাতিক বাহিনীর যুদ্ধ এবং প্রথাগত আকাশ প্রতিরোধ মুখ্য ভ‚মিকা রাখলেও বর্তমানে সেই ধারায় অনেকটাই পরিবর্তন এসে গেছে। ওয়াশিংটন পোস্ট আরো বলছে, ড্রোন চলে আসার পর উন্নত ও স্পর্শকাতর অস্ত্রগুলোর দুর্বলতা, ট্যাংক, রাডার, ভ‚মি থেকে আকাশে নিক্ষেপনযোগ্য মিসাইলের সীমাবদ্ধতা ধরা পড়ছে। এগুলো সবই কাজে লাগবে যদি একটি বাহিনীর হাতে পর্যাপ্ত ড্রোন ডিফেন্স থাকে।

পাকিস্তান ও চীনের সা¤প্রতিক কর্মকান্ড ও তার বিপরীতে ভারতের প্রস্তুতিতে এখন বড় পরিবর্তন আনতে হবে। ভারত বর্তমানে তার সামরিক বাহিনীতে ব্যাপকভাবে আধুনিকায়নের কাজ করছে। ফলে আজারবাইজান আর্মেনিয়ার যুদ্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতের এখন নতুন করে রণকৌশল নিয়ে ভাবা উচিত এবং সেনাবাহিনীতে সর্বশেষ ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের বিষয়ে মনোনিবেশ করা উচিত বলে মনে করেন দেশটির সমর বিশ্লেষকরা। এ পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরিচালনা নীতিতে মনে হয়েছে যে, তারা সংখ্যাধিক্যের দিকেই বেশি আগ্রহী, উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে তাদের খুব বেশি বিনিয়োগ কোনো কালেই ছিল না।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বর্ণযুগ বলা হয় ৭০ এর দশকের শেষ থেকে ৮০’র দশক অবধি সময়টিকে। এ সময়েই ভারতীয় সামরিক বাহিনী প্রথমবারের মতো স্টেট অব দ্য আর্ট টেকনোলোজি এবং ফায়ার পাওয়ার অর্জন করে। সা¤প্রতিক সময়ে ভারত যে কয়টি দেশের সাথেই সামরিক সহযোগিতাম‚লক চুক্তি করেছে, ভারত এর বিনিময়ে কিছু নতুন অস্ত্র পেলেও তার পরিমান খুবই সামান্য। অথচ ৮০’র দশকেই ভারতের হাতে প্রথম বিপুল পরিমানে সমরাস্ত্র আসে। মিরেজ টু থাউজেন্ট জেট বিমান- যা দিয়ে ভারত গত বছর বালাকোটে অভিযান চালায়, কিংবা মিগ টুয়েন্টি নাইন যুদ্ধ বিমান যা দিয়ে ভারত এখনো লাদাখে টহল দিয়ে যাচ্ছে। চীনের সাথে লড়াইয়ে ব্যবহৃত টি-সেভেন্টি টু ট্যাংক- এ সবগুলোই ভারত কিনেছে ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে।

ভারতের বিশ্লেষকরাও মনে করছেন, এমন কোনো খাতে আর অর্থ ব্যয় করা ঠিক হবে না যা দিয়ে ভবিষ্যতের যুদ্ধে তেমন কোনো সফলতা পাওয়া যাবেনা। প্রথাগত চিন্তা ও প্রথাগত কৌশল-উভয়ের পেছনেই বেশি অর্থ ব্যয় করা এখন এক ধরনের অপচয়।

যদিও একথা সত্য যে, ড্রোন দিয়ে আর্মেনিয়া আজারবাইজান যুদ্ধে যতটা সফলতা পাওয়া গেছে, ভারত পাকিস্তানের ভৌগলিক প্রেক্ষাপটে তেমনটা নাও হতে পারে।

ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই এরই মধ্যে উন্নত মানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করেছে। কোনো দেশ যদি ড্রোন দিয়ে সফলতা পেতে চায় তাহলে তাকে প্রতিপক্ষের চেয়েও প্রতাপের সাথে আকাশপথে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। ভারতীয় ও পাকিস্তানী এয়ারফোর্স কেউই এখন এরকম কোনো মানে নেই। এ দুটো দেশের বিমান বাহিনী যদি অপর দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তার করতেও পারে তবে তা হবে সাময়িক। এ আধিপত্যকে দীর্ঘ সময় ধরে রাখার মতো সক্ষমতা কোনো দেশেরই হয়নি। যদি একই সময়ে অনেকগুলো স্থান থেকে ড্রোন নিক্ষেপ করা হয়, তাহলে কী পরিস্থিতি হবে তা নিয়ে অবশ্য কোনো পর্যালোচনা করা হয়নি। ভারত ও পাকিস্তান এ জাতীয় কোনো হামলা বা আক্রমন করতে সক্ষম হবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে।

ড্রোন ভীতি কতটা মারাত্মক অবস্থায় পৌছেছে তা বোঝা যায় একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে। ২০১৯ সালের ২৭ ফেব্রæয়ারী ভারতীয় বিমান বাহিনী একটি এমআই সেভেনটিন ভিএইচ চপারকে তার আকাশসীমায় দেখতে পেয়ে শত্রুপক্ষের ড্রোন মনে করে ভ‚মি থেকে গোলা নিক্ষেপ করে ভূপাতিত করে। পরবর্তীতে দেখা যায় এ চপারটি তাদেরই বাহিনীর। ভারতীয় বিমান বাহিনী পরবর্তীতে এটিকে দুর্ঘটনা এবং ফ্রেন্ডলি ফায়ার হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করে।

ভারতের আরেক প্রতিবেশি রাষ্ট্র হলো চীন যারা এরই মধ্যে মনুষ্যবিহীন এরিয়াল ভেইকল বা ইউএভি পরিচালনায় যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করেছে। চীন শুধুমাত্র ড্রোনের উন্নয়নে অর্থই ব্যয় করেনি বরং সশস্ত্র ড্রোন নির্মান এবং এন্টি ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণাতেও অনেকদূর এগিয়ে গেছে।

এশিয়া টাইমসের এক খবরে বলা হয়েছে, চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চায়না এরোস্পেস সাইন্স এন্ড ইন্ড্রাস্ট্রি কর্পোরেশন এরই মধ্যে একটি কাউন্টার ড্রোন সিস্টেম তৈরি করেছে। যার আওতায় বেশ কিছু অস্ত্র ও সরঞ্জামও রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ভূমিভিত্তিক রকেট এবং শিকারী ড্রোন।

গ্লোবাল টাইমসের তথ্য অনুযায়ী চীন রাইফেল আকৃতির বেশ কিছু ড্রোন প্রতিরোধক ডিভাইস তৈরি করেছে যা জ্যামিং সিগনাল তৈরি করে ড্রোনের যাতায়াতকে ব্যহত করবে। চীনের আকাশসীমায় যদি শত্রুপক্ষের কোনো ড্রোন প্রবেশ করে তাহলেও তাকে হয় বাধ্য হয়েই অবতরণ করতে হবে অথবা নতুন পথ পাল্টে আবার বেরিয়ে যেতে হবে। চীনের এসব অগ্রগতির তুলনায় ভারত এ খাতে অনেকটাই পিছিয়ে।

মিসাইলের ব্যবহার নিয়ে এসব দেশের মধ্যে ভিন্নতা আছে। ভারত আবারও ব্রা² নামে সুপারসনিক ক্রূজ মিসাইলের সফল পরীক্ষণ চালিয়েছে। এ মিসাইলটি দুরপাল্লার একটি মিসাইল যা দিয়ে ৪শ কিলোমিটারের দ‚রত্বেও লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত হানা যায়। এর আগে যে ব্রাঞ্চ মিসাইলগুলো ছিল, তা দিয়ে ২৯৮ কিলোমিটারের পথ অতিক্রম করা যেতো। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে এখন ব্রা² ছাড়াও আরো অনেকগুলো ডিআরডিও প্রযুক্তির মিসাইল সিস্টেম রয়েছে।


এইসব পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভারত গত সাত মাস জুড়ে লাদাখে চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির সাথে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দিতায় লিপ্ত হয়ে আছে। ইতোমধ্যেই এ অঞ্চলে ভারত ব্রা² মোতায়েনও করেছে। আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জের কর্তৃপক্ষ ভারতীয় সেনাবাহিনীকে তাদের ভূখন্ডে অনেকটাই কর্তৃত্ব দিয়ে রেখেছে। আর এ কারণেই, ভারতের হাতে সুযোগ আছে, পরিবর্তিত যে কোনো পরিস্থিতিতেই তারা কৌশলগতভাবে মালাক্কা প্রনালী বন্ধ করে দিয়ে চীনসহ প্রতিবেশি দেশগুলোকে বিপদেও ফেলে দিতে পারে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে