তুরস্ক-পাকিস্তান জোট ভারতের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে

সীমান্ত এলাকায় শত্রুপক্ষ উন্নত প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার শুরু করলে বা আকাশসীমায় প্রবেশ করলেও ভারত তা প্রতিহত করতে পারবে না - ইন্টারনেট

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৯ নভেম্বর ২০২০, ১৩:৪৫

নাগরনো কারাবাখের যুদ্ধে আজারি সেনাদের ব্যবহৃত সশস্ত্র ড্রোনের কারসাজি বিশ্ববাসী অবাক চোখে প্রত্যক্ষ করেছে। মূলত এ ড্রোন দিয়েই আজারবাইজান প্রতিপক্ষ আর্মেনিয়ার আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

পাশাপাশি ট্যাংকসহ নানা ধরনের আর্টিলারি অস্ত্রের আজারি সেনাদের পারদর্শিতাই সাত সপ্তাহের যুদ্ধে তাদের চুড়ান্ত সফলতা এনে দেয়। ভারতীয় সমর বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন যে, যদি ভবিষ্যতে ভারত কাশ্মির ইস্যুতে কোনো ধরনের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় তাহলে তুরস্ক ও চীন উভয়রাষ্ট্রই পাকিস্তানকে ড্রোনসহ অন্যন্য সামরিক সুবিধাদি সরবরাহ করার প্রস্তাব দিয়ে বসতে পারে।

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যুদ্ধ চলা অবস্থায় আজারিরা প্রায়ই নানা ধরনের ভিডিও প্রকাশ করতো যাতে দেখা গেছে তুর্কী বেরাকতার ড্রোনগুলো সফলতার সাথে শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুতে এবং ট্রেঞ্চে হামলা করছে। আর্মেনিয়ার সেনারা ড্রোনের এ বিরতিহীন আক্রমনের মুখে সে অর্থে কার্যকর কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি।

এ যুদ্ধে আর্মেনিয়ার ১৮৫টি টি-সেভেনটি টু ট্যাংক, ৯০টি সশস্ত্র যান, ১৮২ টি আর্টিলারি অস্ত্র, ৭৩টি মাল্টিপল রকেট লাঞ্চার, ২৬টি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য মিসাইল, একটি টর সিস্টেম, ৫টি এস-থ্রি হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ১৪টি রাডার ও জ্যামার, একটি এসইউ টোয়েন্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান এবং ৪৫১ টি সামরিক যানবাহন সম্পুর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে গেছে। সেইসাথে আর্মেনিয়া হারিয়েছে তাদের ২৩০০ সেনাকে।

আর্মেনিয়ার তুলনায় আজারবাইজানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমান অনেকটাই কম। সার্বিকভাবে হিসেব করলে আর্মেনিয়া যে পরিমান সম্পদ হারিয়েছে আজারিদের লোকসানের পরিমান তার ৬ ভাগের একভাগ। এ যুদ্ধ প্রমাণ করেছে কমদামী ড্রোন দিয়েই যুদ্ধের মোড় ঘরিয়ে দেয়া যায় প্রতিপক্ষের চড়া মূল্যের ক্ষতিও করা সম্ভব হয়।

২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানের যুদ্ধে প্রথম প্রিডেটর ড্রোনের ব্যবহার শুরু করে। এরপর থেকে বিশ্বের যে প্রান্তেই যতগুলো যুদ্ধ বা সশস্ত্র লড়াই সংঘটিত হয়েছে, সবকটিতেই ড্রোনের ব্যবহার ও কার্যকারিতা নিরন্তরভাবে শুধু বৃদ্ধিই পেয়েছে। তাই আজকের সময়ে এসে যে দেশ যত বেশি ড্রোনের মতো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তৈরি বা ব্যবহার করতে পারবে সে দেশ প্রতিপক্ষের তুলনায় অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যাবে।

বেরাকতার টিবি-টু ড্রোনগুলো আজারবাইজানকে যুদ্ধের ময়দানে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছে। আর আজরিদের কাছে এ ড্রোনগুলো সরবরাহ করেছে তুরস্ক। মার্কিনীদের এম-কিউ নাইন রিপার ড্রোনের তুলনায় বেরাকতারের ওজন ৮ ভাগের একভাগ আর এর গতিও অনেক বেশি। টিবি-টু ড্রোনে ৪টি এমএএম বা স্মার্ট মাইক্রো মিউনিশন ধরনের মিসাইল বহণ করা যায়।

বেরাকতার টিবি-টু ড্রোনগুলো মাঝারি উচ্চতায় চলে এবং এদের স্থায়ীত্ব অনেক বেশি। এগুলো মনুষ্যবিহীন হলেও এর মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তা, কৌশল, নজরদারি এবং আক্রমন সবগুলো কাজই সফলভাবে করা যায়।

তুরস্কের বেরাকতার ড্রোন দিয়েই এ বছরে সিরিয়ায় রাশিয়ার তৈরি বেশ কয়েকটি এ্যান্টি এয়ারক্রাফট যানও ধ্বংস করা হয়েছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ক্রাসনায়া ভেজদা স্বীকারও করেছিলেন যে, টিবি-টু ড্রোনের কার্যক্রম ও পারদর্শিতার কাছে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা ধরা পড়েছে। রাশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকেও এ ড্রোনগুলো নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। বেরাকতার ড্রোনগুলো পান্টসির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলা চালিয়েছে। তুরস্ক দাবি করেছে রাশিয়ার আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের আবিস্কৃত বেরাকতার ড্রোনকে সনাক্ত ও ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়েছে।

ন্যাটোভুক্ত দেশ হিসেবে তুরস্ক এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী এমনকী ইসরাইল থেকেও নিয়মিত ড্রোন আমদানি করেছে। কানাডা থেকেও তারা কয়েকবার ড্রোনের যন্ত্রাংশ নিয়ে এসেছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে এবং আশপাশের এলাকায় তুরস্ক তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা শুরু করার পর থেকে এ দেশগুলোকে তুরস্কতে ড্রোন রফতানি বন্ধ করে দেয়। তুরস্ক তখন নিজ উদ্যেগে ড্রোন বানানোর উদ্যেগ নেয় এবং ২০১৪ সালে প্রথম তুরস্কের তৈরি বেরাকতার ট্যাকটিক ব্লক টু বা টিবি-টু ড্রোনগুলোর সফল পরীক্ষা চালানো হয়।

প্রথমবার উড্ডয়ন করার পরই ড্রোনগুলো ২৪ ঘন্টা ৩৪ মিনিট ধরে একটানা উড়তে সক্ষম হয় এবং সর্বোচ্চ ২৭ হাজার ফিট উচ্চতায় গিয়েও ড্রোনগুলো কার্যকারিতা প্রমাণ করে। যা ছিলো তুরস্কের সামরিক ইতিহাসের জন্য বড়ো আকারের টার্নিং পয়েন্ট।

যেহেতু সিরিয়া ও আজারবাইজানে এ ড্রোন খুবই কার্যকর ভূমিকা রেখেছে তাই ধারনা করা হচ্ছে ভবিষ্যতে অনেক দেশই তুরস্কের এ ড্রোনের বিষয়ে আগ্রহ দেখাবে। ইতোমধ্যেই তুরস্ক কাতার ও ইউক্রেনের কাছে বেরাকতার ড্রোন বিক্রি শুরু করেছে। আরো কয়েকটি দেশ তুরস্কের কাছে এ ড্রোন কেনার জন্য ক্রয় প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। পাকিস্তানের সাথে তুরস্কের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ক্রমশ উন্নত হচ্ছে যা ভারতকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ভারত আশংকা করছে, তুরস্ক হয়তো যে কোনো সময় পাকিস্তানের কাছে বেরাকতার ড্রোন বিক্রি করবে।

বিগত কয়েক বছর তুরস্ক আর পাকিস্তানের যৌথ সামরিক কার্যক্রমও অনেক বেশি স¤প্রসারিত হয়েছে। পাকিস্তানের সাথে ভারতের যে বৈরিতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে সে স‚ত্র ধরেই পাকিস্তান তার ঘনিষ্ট মিত্র তুরস্কের কাছ থেকে ড্রোন নেয়ার কথা ভাবতে পারে।

এ ক্ষেত্রে টিবি-টু ড্রোনগুলো খুব সহজেই রাশিয়ান পান্টসির এবং এস-থ্রি হান্ড্রেডের মতো নিরাপত্তা ব্যবস্থাকেও গুড়িয়ে দিতে পারে। পাকিস্তান এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও ভারতীয় আর্টিলারি অস্ত্রকে ক্ষতি করার জন্য এ প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহীও হয়ে উঠতে পারে। ভারত পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় দীর্ঘদিন থেকেই আর্টিলারি গান, ট্যাংক ও অন্যন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা সক্রিয় অবস্থায় রেখেছে। প্রথাগত অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তান তার মোকাবেলা করতে পারবে না। তাই ড্রোনের মতো উন্নত প্রযুক্তি এক্ষেত্রে পাকিস্তানের জন্য সহায়ক হতে পারে।

ভারতের জন্য এখন দুটি দেশ হুমকি হিসেবে কাজ করছে। চীন ও পাকিস্তান। আর এ দুটো দেশই ড্রোন উন্নয়ন এবং ড্রোন মোতায়েনে সক্ষম হতে পারে। আর তেমনটা হলে তাদের সাথে পাল্লা দেয়া ভারতের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে। এখনো পর্যন্ত ভারত ইসরাইল থেকে সার্চার ও হারোপ ড্রোন আমদানি করেছে যা দিয়ে ম‚লত নজরদারি ও প্রতিপক্ষের গতিবিধি মনিটর করা যায়। হারোপ হলো এক ধরনের আত্মঘাতী ড্রোন- যা দিয়ে শত্রুপক্ষের আকাশ নিরাপত্তা ব্যবস্থায় প্রবেশ করা যায়।

ভারতের নৌ বাহিনীও এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৩০টি মনুষ্যবিহীন গার্ডিয়ান ড্রোন পাওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ভারতের জন্য সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো এখনো পর্যন্ত তারা স্থানীয়ভাবে ড্রোন তৈরি শুরু করতে পারেনি। অথচ তেমনটি হলে ভারত বেশ কিছু সুবিধা পেতো এবং সেইসাথে বাইরের দেশ থেকে আমদানি করা ড্রোনগুলোর ঘাটতিও পূরণ করতে পারতো।

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে আরো বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় শত্রুপক্ষ উন্নত প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার শুরু করলে বা আকাশসীমায় প্রবেশ করলেও ভারত তা প্রতিহত করতে পারবে না। সাম্প্রতিক যুদ্ধগুলোতে প্রমাণ হয়েছে , ব্যয়বহুল বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার তুলনায় কমদামী আক্রমনাত্মক ড্রোন এবং নীচু উচ্চতায় যাওয়া মিসাইলগুলো অনেক বেশি কার্যকর।

সিরিয়া সরকার ড্রোনের আক্রমন থেকে বাঁচার জন্য রাশিয়ার তৈরি এস-ফোর হান্ড্রেড নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু করেছিল। তবে ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার, এন্টি রেডিয়েশন মিসাইল এবং মিউনিশনের কাছে এ নিরাপত্তা ব্যবস্থা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

সিরিয়ায় রাশিয়ার তৈরি কয়েকটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ছিল যার মধ্যে আছে এস থ্রি হান্ড্রেড, এস-ফোর হান্ড্রেড ছাড়াও বুক-এম ওয়ান মাঝারি দূরত্বের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপনযোগ্য মিসাইল সিস্টেম এবং পান্টসির সিস্টেম। তবে ইসরাইল ও তুরস্কের আক্রমণের কাছে সবগুলো নিরাপত্তা ব্যবস্থাই টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকী সৌদি আরবের হাতে থাকা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও ২০১৯ সালে হুথি বিদ্রোহীদের ড্রোন আক্রমনের মুখে অকার্যকর হয়ে যায়।

বেরাকতারের মতো ছোট ড্রোনগুলোকে সহজে গুলি করেও ধ্বংস করা যায় না। পাশাপাশি এ ড্রোনগুলোর সক্রিয়তা ও পারদর্শিতা এ প্রযুক্তিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। পাকিস্তান যদি তুরস্ক ও চীন থেকে ড্রোনের মতো উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসতে পারে তাহলে তা ভারতের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। পাকিস্তানের দুই ঘনিষ্ঠ মিত্র চীন ও তুরস্ক। আর এ দুটো দেশই বিশ্বমানের ড্রোন উৎপাদনে সক্ষম। ভারতকে তাই সম্ভাব্য এ ড্রোন আক্রমন থেকে বাঁচতে হলে অবিলম্বে বিকল্প নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরিতে জোর দিতে হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে