ট্রাম্পের পরাজয়ে বেকায়দায় মোদি

মোদির ট্রাম্পপ্রীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ভারতের মানবাধিকারের দ্রুত ক্ষয় দুই নেতার ব্যক্তিগত উষ্ণ সম্পর্কের পথে বড় কাটা হয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে - রেডিফ ডটকম

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৫ নভেম্বর ২০২০, ১৫:৪০

ভারতের হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে উষ্ণ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের আরেক উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্প। দুজনেরই রাজনৈতিক বিশ্বাসে আছে পূর্নমাত্রায় কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠার নানামুখী প্রচেষ্টা। ট্রাম্পের পতনের পর বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে কেমন সম্পর্ক হবে মোদির, তা নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই। টাইম ম্যাগাজিন, ফরেন পলিসি ও বিবিসিসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে দুই সরকারের ভবিষ্যত সম্পর্কের পথরেখা।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে হাজার হাজার মানুষের সামনে ‘হাউডি মোদি’ অনুষ্ঠানে ট্রাম্পের হাত ধরে মোদি ‘আপ কি বার ট্রাম্প সরকার’ বলে স্লোগান দিয়েছিলেন। বিশাল জমায়েত দেখে আপ্লুত মোদি হয়তো ক্ষণিকের জন্য ভুলে গিয়েছিলেন, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী। ট্রাম্পের ক্যাম্পেইন ম্যানেজার নন। তার আচরণে কূটনৈতিক বিশ্ব হতবাক হয়ে গিয়েছিল। এ নিয়ে মোদির তীব্র সমালোচনাও হয়।

এরপর এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে গুজরাটের আহমেদাবাদে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ আসরেও একই উন্মাদনা দেখান মোদি। দুই নেতার এই মাখামাখি এই ধারণাই দিয়েছে যে ট্রাম্পকে দ্বিতীয় দফায়ও ক্ষমতায় দেখতে চান মোদি।

বিনিময়ে ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিতর্কিত নীতি নিয়ে সরাসরি কোনা কথা বলেননি ট্রাম্প। কিন্তু বাইডেন হয়তো এ ব্যাপারে সরব হবেন। বাইডেনের নির্বাচনী প্রচারণা সম্পর্কিত ওয়েবসাইটে ভারতের বিতর্কিত নাগরিকপঞ্জী এবং নাগরিকত্ব আইনের সমালোচনা রয়েছে। এছাড়া, কাশ্মিরিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে।

ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, যেভাবে আসামে এনআরসি করা হয়, তারপর সিএএ চালু হয়, তা ‘হতাশার কারণ’। নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার পর কাশ্মীর প্রসঙ্গে বাইডেন বলেছিলেন, ‘জনতাকে ক্ষোভ প্রকাশ করতে না দেওয়া, শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভে বাধা দেওয়া, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে রাখা গণতন্ত্রকে দুর্বল করে।’ এমনকি আধা-ভারতীয় কমলা হ্যারিসও ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী ক্ষমতাসীন দলের অনেক নীতির খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন।

গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার পর ওই রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদির ভিসা নাকচ করে দেয় জর্জ বুশের প্রশাসন। তবে মোদি ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও তাকে উষ্ণ আলিঙ্গন করেন। অবশ্য মোদির সঙ্গে মাখামাখি চরমে পৌঁছায় ট্রাম্পের আমলে।

বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরও ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত উষ্ণ সম্পর্ক অটুট থাকবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে মোদির ট্রাম্পপ্রীতি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, ভারতের মানবাধিকারের দ্রুত ক্ষয় দুই নেতার ব্যক্তিগত উষ্ণ সম্পর্কের পথে বড় কাটা হয়ে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক গড়লেও মোদির পরোক্ষ সমালোচনা করতে ছাড়েননি। ভারত সফরে এসে তিনি মোদিকে কটাক্ষ করে বলেছিলেন, প্রত্যেকেরই স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালনের অধিকার রয়েছে। ধর্ম পালনের জন্য নিপীড়নের শিকার হওয়ার মেনে নেওয়া যায় না।

অবশ্য ট্রাম্প ভারতের হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকারের মুসলিম নিপীড়নের কোনো সমালোচনা করেননি। গত ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্প যখন ভারত সফরে আসেন তখন নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দিল্লিতে রাষ্ট্রীয় মদদে মুসলিমদের ওপর হত্যাকান্ড চালানো হয়। এ সময় এক বিবৃতিতে ট্রাম্প পরোক্ষভাবে মোদির পক্ষ নিয়ে বলেন, বিষয়টি আমি ভারত সরকারের ওপর ছেড়ে দিতে চাই।

তবে ট্রাম্পের আমলেও এসব ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র একেবারেই সমালোচনা করেনি এমন নয়। তবে ট্রাম্প বা তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নীরব ছিলেন। কিস্তু বাইডেন ও কমলা হ্যারিস মুখ বুঝে থাকবেন না বলে মনে হচ্ছে। কাশ্মিরের স্বায়ত্বশাসন কেড়ে নেওয়ার পর কমলা হ্যারিস মোদি সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন ‘আমরা কাশ্মীরিদের জানিয়ে দিতে চাই যে তারা বিশ্বে নিঃসঙ্গ নয়। আমরা নজর রাখছি। প্রয়োজন হলে হস্তক্ষেপ করতে হবে।’ বাইডেন ও কমলা এসব ইস্যুতে যে কথা বলবেন তা খুবই স্বাভাবিক।

কাশ্মিরিরা আশা করছেন, বাইডেন-কমলার প্রশাসন তাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাশ্মির সংকট সমাধানে ভূমিকা রাখবেন। ওয়ার্ল্ড কাশ্মির অ্যওয়ারনেস ফোরামের সভাপতি গুলাম এন মির টাইম ম্যাগাজিনকে বলেন, বাইডেন ও কমলা স্বীকার করেছেন যে কাশ্মীর সংকটের কোনো সামরিক সমাধান নেই। ভারত ও পাকিস্তানের নেতাদের সংলাপের মাধ্যমে এ সংকটের সমাধান করতে হবে। তাই সাত দশকের মানবাধিকার লংঘনের সমাপ্তি টেনে কাশ্মীরে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

মুসলিম বিদ্বেষ ও উগ্র জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিলেন মোদি। এর দুই বছর পর কার্যত একই ধারার রাজনীতির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট হন ট্রাম্প। বাইডেনের বিজয়ের মাধ্যমে তারা উভয়ই যে বার্তা পেলেন তা হলো এ ধারার রাজনীতি বিশ্বে এখন ক্ষয়িষ্ণু। মোদি শুধু মুসলিমবিরোধী নীতি অনুসরণ করছেন, তা নয়। তার আমলে ভারতে খ্রিস্টানসহ অন্যান্য সংখ্যালঘুরাও নিপীড়নের শিকার। বিরোধী দলকেও তিনি দমন করে চলেছেন। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশালকেও ভারতে কার্যক্রম বন্ধ করতে হয়েছে সরকারের চাপে। এসব ইস্যুতে আমেরিকা চুপ থাকবে না।

বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতিতে গুরুত্ব পাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। ফলে ট্রাম্পের মতো মোদি যে বছরে তিনবার বাইডেনের আলিঙ্গন পাবেন না, তা একপ্রকার নিশ্চিত করেই বলা যায়।

ট্রাম্পের সঙ্গে মাখামাখির মাধ্যমে মোদি আমেরিকার রাজনীতিতেও প্রভাব সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। আমেরিকার রাজনীতিতেও হিন্দু মৌলবাদী কণ্ঠ জাগাতে চেয়েছিলেন। ডেমোক্র্যাটরা এটা ভালোভাবে নেয়নি। মোদির জন্য এটা খারাপ সংবাদই বটে।

অবশ্য মোদি ট্রাম্পকে রাষ্ট্রাচারবেহির্ভূত মহব্বত দেখালেও বিনিময়ে ভারত তেমন কিছুই পায়নি। মোদির সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন নিয়ে ট্রাম্প কথা না বললেও অন্যান্য ইস্যুতে কিন্তু প্রচন্ড চাপে রেখেছেন। ব্যবসায়ী ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতির মাশুল চরমভাবে গুণতে হয়েছে ভারতকেও।

ভারত কোনো বাণিজ্য সুবিধা পায়নি ট্রাম্পের আমলে। ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির সবচেয়ে বড় শিকার ভারতীয়রা। সারা বিশ্ব থেকে যত মুসলিম আমেরিকায় অভিবাসী হন, ভারতীয়দের মোট সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। এইচ-ওয়ানবি ভিসায় ভারতীয়দের নিয়োগও কঠিন করে তুলেছেন ট্রাম্প।

ট্রাম্প ভারতকে ইরান ও ভেনিজুয়েলার সস্তা তেল কেনা বাতিল করতে বাধ্য করেছেন। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উচ্চমূল্যে তেল ও গ্যাস কিনতে বাধ্য করেছেন। চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাত সত্ত্বেও ট্রাম্প ভারতকে রাশিয়ার অস্ত্র কেনায় কোনো ছাড় দেননি। যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়ে রেখেছে যে রাশিয়ার অস্ত্র কিনলে নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে।

ভারতের বিভিন্ন পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে এক ধরনের ছোট যুদ্ধ চালিয়েছেন ট্রাম্প। এতে ভারতের অর্থনীতির ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া সুযোগ পেলেই ভারতকে কটাক্ষ করতে ভুলতেন না ট্রাম্প। ভারতের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বেশ কয়েকবার বিদ্রæপ করার পর ভোটের প্রাক্কালেও তিনি ভারতের বায়ু দূষণ নিয়ে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি।

অনেকে মনে করেন, বাইডেনের রানিং মেট বা পরবর্তী ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায় মোদি বাড়তি সুবিধা পাবেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে মোদির মুসলিমবিরোধী নীতির এবং বিজেপির কট্টর সমালোচক তিনি। কাশ্মীরে মোদির নিপীড়নের বিরুদ্ধে কমলা ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। সিনেট সদস্য হিসেবে কমলা হ্যারিস এ নিয়ে কড়া কথা বলেছেনে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করেরও সমালোচনা করেছেন । ফলে বাইডেন জয়ী হওয়ার পর বিজেপি শিবিরে কোনো উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি।

কমলা হ্যারিসের মা ভারতের তামিলনাড়ুর বাসিন্দা ছিলেন। ভারতের এই রাজ্যটির বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশ হিন্দু হলেও তারা হিন্দিভাষী নয়। এর বাসিন্দারা প্রচন্ড বিজেপি বিরোধী। গত বছরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে বিজেপি বিশাল জয় পেলেও এই রাজ্যে একটি আসনও পায়নি।

তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না ভারত বেশ অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত সহযোগী। ভারত ও প্রশান্ত-মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল বাস্তবায়নে এবং সন্ত্রাস দমনে প্রধান সহযোগী দেশ হিসাবেই থাকবে। এই অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। তবে বাইডেন ট্রাম্পের মত কট্টর চীনবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসতে পারেন। সেক্ষেত্রে ভারতও কিছুটা বিপাকে পড়তে পারে।

এরপরও যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার পালাবদলে ভারত বেশ কিছু বিষয়ে আশার আলো দেখতে পারে। বাইডেন বলেছেন, এইচওয়ানবিসহ অন্যান্য জরুরি ভিসার সংখ্যা বাড়ানো চিন্তা রয়েছে। ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতি বাইডেনের জমানায় অনেকাংশেই শিথিল হবে বলে আশা করা হচ্ছে। যা হবে ভারতের জন্য স্বস্তিদায়ক।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে