গিলগিট বালতিস্তানে কি চীনের ঘাটি হচ্ছে

বলা হচ্ছে, এটি যেমন আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াবে, তেমনি মহামারী-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য আশার আলোও জ্বালাবে - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৩ অক্টোবর ২০২০, ১৪:৫০

চীন-পাকিস্তান বন্ধুত্ব যেন সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। জিনজিয়াং-এর উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনের নজিরবিহীন নিপীড়ন সত্ত্বেও সেই বন্ধুত্বে ফাটল ধরেনি। একইভাবে চীন-ভারত বৈরিতাও সুবিদিত। তাই ৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয়সাপেক্ষ চায়না-পাকিস্তান ইকনমিক করিডোর বা সিপিইসি যেমন পাকিস্তানের জন্য বিশাল অর্থনৈতিক দিগন্ত খুলে দিচ্ছে, তেমনি তা ভারতকে করছে ক্ষুব্ধ ও হতাশ।

চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর প্রকল্পের অধীনে নির্মিত হবে একাধিক সমুদ্রবন্দর, অনেক সড়ক, রেলপথ ও বিদ্যুতকেন্দ্র। এতে উভয় দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের সুবিধা হবে, প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাসমূহের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আর জোরদার হবে।

এদিকে গত কয়েক মাস যাবত করোনা মহামারীর কারনে বিশ্ব অর্থনীতির জেরবার অবস্থা দেখে চীন ওই প্রকল্পে অতিরিক্ত আরো ১১ বিলিয়ন ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। এমনিতে ভূরাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বেশ-কিছু এলাকা নিয়ে চীন ও ভারত মুখোমুখি অবস্থানে আছে, তার ওপর সিপিইসি প্রকল্পে চীনের অতিরিক্ত বরাদ্দ সেই আগুনে ঘৃতাহুতি হবে, এতে আর সন্দেহ কী।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, সিপিইসি প্রকল্প ও পাকিস্তানকে নিয়ে চীনের একটা বড় পরিকল্পনা আছে। চীন যে পাকিস্তানের গোলযোগপূর্ণ বেলুচিস্তান প্রদেশে গোয়াদর বন্দর নির্মাণে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে, তার পেছনে বড় একটা কারণ হলো, এর ফলে চীন সহজে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করতে পারবে। এ প্রবেশাধিকার পেলে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে চীনের ব্যবসাবাণিজ্য এবং তেল আমদানি সহজ হবে।

স্থানীয় কিছু পত্রপত্রিকায় এমন খবরও বেরিয়েছে যে, চীনকে গোয়াদর বন্দর এবং গিলগিট বালতিস্তানে সামরিক ঘাঁটি করতে দিতেও রাজি হয়েছে পাকিস্তান। খবরটি অবশ্য অস্বীকার করেছে পাকিস্তান সরকার। তবে গিলগিট বালতিস্তান এলাকাটি লাদাখের কাছাকাছি। লাদাখে চীন ও ভারত একে অপরের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আছে। এমন একটি এলাকার কাছাকাছি ঘাঁটি করতে চাইবে চীন, এটাই স্বাভাবিক।

পাকিস্তানে চীন কাজ করছে সেদেশের শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও তাদের সাথে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে। সিপিইসি-র সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকগুলো কাজের ঠিকাদারি পেয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রকৌশল শাখা ফ্রন্টিয়ার ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন বা এফডাব্লিউও। অর্থাৎ এই প্রকল্পের সাথে সরাসরি জড়িত আছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।

এসব কাজের মধ্যে রয়েছে কারাকোরাম হাইওয়ে পূণঃনির্মাণ ও মেরামত। এতে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ২০০ কোটি মার্কিন ডলার। মহাসড়কটি চীনের কাশগড় নগরীর সাথে পাকিস্তানের পাঞ্জাবকে যুক্ত করবে। আর তার মাধ্যমে একটি বিকল্প বাণিজ্য রুট প্রতিষ্ঠায় চীনের স্বপ্ন পূরণ করবে এ হাইওয়ে।

আগে পাকিস্তানের দিকে সিপিইসি-র দায়িত্বে ছিল সরকারের প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ডিভিশন। গত বছর প্রেসিডেন্টের এক অধ্যাদেশবলে সিপিইসি অথরিটি নামে নতুন একটি সংস্থা গঠন করা হয়। এর চেয়ারম্যান করা হয় অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল আসিম সালাম বাজওয়াকে।

এ অবস্থায় এ প্রকল্পে চীনের আরো বিনিয়োগ বেশ তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, এটি যেমন আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়াবে, তেমনি মহামারী-পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য আশার আলোও জ্বালাবে।

এমনিতে ২০১৮ সালে পাকিস্তানে ইমরান খানের দল ক্ষমতায় আসার পর থেকে সিপিইসি প্রকল্পটি একরকম অচল হয়েই ছিল। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান চাচ্ছিলেন আর্থিক বিষয়সহ প্রকল্পের নানা ক্ষেত্রে কিছু রদবদল। কিন্তু ততোদিনে প্রকল্পের ওপর সেনাবাহিনী ও তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ অনেকটাই ব্যর্থ হয়।

দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে গত জুন মাসে আজাদ কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্থানে দু'টি জলবিদ্যুত প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এগুলো হলো আজাদ পাত্তান হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্ট এবং কোহালা হাইডেল পাওয়ার প্রজেক্ট। এর ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ দু' প্রকল্পের ৮০ ভাগ কাজ করবে চীনের বিভিন্ন কম্পানি। বাকি কাজের সাব-কন্ট্রাক্ট পেয়েছে পাকিস্তানের এফডাবিøউও এবং লারাইব গ্রুপ।

ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন গিলগিট-বালতিস্থানে দায়ামার-ভাসা নামে একটি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছেন ইমরান খান। যদিও এটি সিপিইসি প্রকল্পের অংশ নয়, তা সত্তে¡ও বাঁধটির নির্মাণব্যয়ের বেশিরভাগই বহন করছে চীন। এর আগে এতে অর্থ যোগান দিতে অস্বীকৃতি জানায় বিশ্ব ব্যাংক। তাদের আপত্তির কারণ, প্রকল্পটি বিতর্কিত এলাকায় অবস্থিত।

পাকিস্তানের ইতিহাসে বৃহত্তম বাঁধ নামে বহুল উচ্চারিত বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে দেশটির উত্তরাঞ্চলে; সিন্ধু নদীতে। চীন ও পাকিস্তানের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণাধীন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৫০ কোটি মার্কিন ডলার। ধারণা করা হচ্ছে, এ প্রকল্প থেকে পাকিস্তানের জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হবে প্রায় সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।

পর্যবেক্ষক ও সমালোচকরা বলছেন, এ প্রকল্পের সুবাদে গিলগিট-বালতিস্থানের কাছাকাছি অথবা এমনকি একেবারে ভেতরে চলে আসার সুযোগ পাবে চীনা সেনাবাহিনী। কেউ-কেউ বলছেন, এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের একেবারে দরজায় চলে এলো চীন।

একটি মার্কিন থিংকট্যাঙ্কের একজন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, আজাদ কাশ্মীরে চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ ভারতের প্রতি আঘাতস্বরূপ। এতে চীন-ভারত উত্তেজনা আরো বাড়বে।

পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দরের সাথে দেশের অন্যান্য অংশকে যুক্ত করতে নির্মাণ করা হচ্ছে এক হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ সড়ক। এতে অর্থ যোগান দিচ্ছে চীনের দু'টি ব্যাঙ্ক। তবে এ ঋণের শর্ত কি, দীর্ঘ মেয়াদে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতই বা কারা করবে, তার কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।

সেনাবাহিনীর ওই সংস্থাটি আরো প্রায় ১১শ' কোটি মার্কিন ডলারের কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। এসব কাজের মধ্যে আছে সড়ক নির্মাণ এবং মডেল টাউন, বিদ্যুৎকেন্দ্র, তেল শোধনাগার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এসব কাজে নিয়োজিত রয়েছে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষ, যাদের বেশিরভাগই সামরিক বাহিনী থেকে আসা। এছাড়া আরো অনেক বেআইনী সুবিধা ভোগ করছে সংস্থাটি।

এসব দেখেশুনে সমালোচকরা কোনো রাখঢাক না রেখেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকার হচ্ছে সেনাশাসিত বেসামরিক প্রশাসন। কেউ-কেউ এমনও বলছেন যে, পাকিস্তানের বর্তমান পলিটিক্যাল সেট-আপ হচ্ছে হাইব্রিড মার্শাল ল', যেখানে বর্তমান ও সাবেক জেনারেলরাই সরকারের সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে জড়িত থাকেন।

পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন রাজনীতি, উন্নয়ন প্রকল্প ও ব্যবসায় সেনাবাহিনীর অংশগ্রহন নতুন কোনো বিষয় নয়। এটা পাকিস্তানের সব সময়ের বন্ধু চীনের অজানা নয়। আর ঠিক এ কারণেই বেল্ট অ্যান্ড রোডসহ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নিজেদের সব প্রকল্পেই দেশটির সেনাবাহিনীকে গুরুত্ব দিচ্ছে চীন।
আর এখানেই ভারতের ভয়। একেবারেই সীমান্ত ঘেষা গিলগিট বালিস্তানের চীনের সরব উপস্থিতি দিল্লির মনে নানা শঙ্কার জন্ম দিয়েছে। লাদাখ নিয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে যে উত্তেজনা সেখানেও কাজ করেছে এই ভয়ের ছবি। কারন লাদাখ থেকে গিলগিট বালিস্তান খুব দূরে নয়। ভুকৌশলগত দিক দিয়ে বলা যায় একই এলাকার অংশ। পুরো অঞ্চল নিয়ে চীনের সামরিক পরিকল্পনা কাজ করছে বলে অনেকে ভারতীয় বিশ্লেষক মনে করেন।

গোয়াদর থেকে গিলগিট বালিস্তান পর্যন্ত চীনের উপস্থিতিকে নিরাপত্তার দিক দিয়ে পাকিস্তানের জন্য স্বস্তিদায়ক। কারন এ অঞ্চলে ভারতের হুমকি মোকাবিলায় সব সময় চীনকে পাশে পাবে। যদিও চীনের এই বিপুল ঋন পাকিস্তানকে ফাঁদে ফেলছে এমন সমালোচনা কম নয়। কিন্তু চীনের সাথে পাকিস্তানের যে নিরাপত্তা সর্ম্পক তাতে এমন সমালোচনা পাকিস্তানের সামরিক-বেমাসরিক নেতৃত্ব উপেক্ষা করে যাচ্ছে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের মাধ্যমে পশ্চিম ফ্রন্টে এখন শুধু পাকিস্তানকে নয় চীনের উপস্থিতি ভারতকে মোকাবিলার চিন্তা করতে হচ্ছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে