চীন না আমেরিকা কোন দিকে যাবে ভারত

আমেরিকা ও জাপানের ফাঁদে পড়ছে ভারত। কার্টুনটি করেছেন শি উ - চায়নাডেইলি

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০২ অক্টোবর ২০২০, ১৪:০৬

আয়তনে বড় দেশ হিসেবে ভারতের একটা বড় আকাঙ্খা আছে, তা হলো আঞ্চলিক পরাশক্তি হওয়া। তবে সাধ তার যতটুকু, সাধ্য ততোটা নয়। তার ওপর আছে চীন। এর আয়তন যেমন বড়, অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতেও তারা তেমনই আগুয়ান। ফলে চীন নামের দেশটি অঘোষিতভাবেই আঞ্চলিক পরাশক্তির আসনটি দখল করে আছে। এ নিয়ে বহুকাল ধরে দু'দেশের মাঝে মনস্তাত্বিক যুদ্ধ চলে আসছে। আর গত কয়েক মাস ধরে লাদাখে উভয় দেশ তো একেবারে মুখোমুখি অবস্থানে। চীন-ভারত এ দ্বৈরথকে কেবল দু'দেশের লড়াই ভাবলে ভুল ভাবা হবে। এর পেছনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাই চীন-ভারত দ্বন্দ্বকে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্বও বলা চলে। এ দুয়ের মাঝখানে ভারত দুলছে পেন্ডুলামের মতো - এ অভিমত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের। নেপালের বিশিষ্ট পর্যবেক্ষক ভিম ভুরতেল তাদেরই একজন।

চীন-মার্কিন জিও-স্ট্র্যাটেজিক দাবার বোর্ডে ধরা খেয়ে গেছে ভারত। চীন গত মে মাসের শুরু থেকেই লাদাখ সীমান্তে বিপুলসংখ্যক সৈন্য সমাবেশ ঘটিয়ে ভারতের ওপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। আর এদিকে নিজের কৌশলগত লক্ষ্য হাসিলের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও চাপ দিয়ে চলেছে ভারতকে।

সব মিলিয়ে ভারত তার কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন হারাতে বসেছে। তারা একবার চীনের দিকে, আরেকবার আমেরিকার দিকে ঝুঁকছে, ঠিক যেন দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলাম।
কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার দিকে তাকালে এ ধারণার সত্যতা বোঝা যাবে। প্রথমটি হলো, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করের সাথে তাঁর চীনা প্রতিপক্ষ ওয়াং ঈ-র বৈঠক এবং পরে দু'দেশের যৌথ ইশতেহার। গত ১০ সেপ্টেম্বর সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনের মন্ত্রী পর্যায়ের সভার সাইডলাইনে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
ইশতেহারের শুরুতেই বলা হয়, ''চীন ও ভারতের সুসম্পর্ক রক্ষায় দু'দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে যে-রকম মতৈক্য হয়েছে, সেটা অনুসরণ করা হবে এবং মতপার্থক্যকে মতবিরোধে রুপ নিতে দেয়া হবে না।'' ইশতেহারের এ বক্তব্য থেকে এটা পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে যে, দু'দেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে ইতিপূর্বে সম্পাদিত চুক্তি ও সমঝোতা অনুসরণ করার চীনা দাবি ভারত মেনে নিয়েছে।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া দরকার তা হলো, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সচিবদের ২+২ ভারচুয়াল মিটিং শেষে উভয় দেশের পৃথক বিবৃতি। জয়শঙ্কর-ওয়াং বৈঠকের একদিন পরই ভারচুয়াল মিটিংটি হয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এমনিতেই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি আছে ভারতের। এগুলো হলো ২০১৬ সালে সম্পাদিত লজিস্টিক এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব অ্যাগ্রিমন্ট, ২০১৮ সালে সম্পাদিত দ্য কমিউনিকেশন কম্প্যাটিবিলিটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাগ্রিমেন্ট এবং ২০১৯ সালের দ্য ইনডাস্ট্রিয়াল সিকিউরিটি অ্যানেক্স টু দ্য ইন্ডিয়া-ইউএস জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি ইনফরমেশন অ্যাগ্রিমেন্ট। এসব চুক্তির ফলে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে মার্কিন দক্ষতা ব্যবহারের সুযোগ পাবে ভারত। আর সামরিক কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র ও অটোমেটেড হার্ডওয়্যার সিস্টেমকে আরো নিপূণ করতে পারবে তারা।

ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা সচিবদের ২+২ ভারচুয়াল মিটিংয়ে উভয়পক্ষ ভবিষ্যতে আরো আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হয়। মার্কিন বিবৃতিতে বলা হয়, এ বছরের শেষে দু' দেশ আবারও এ ধরনের বৈঠকে মিলিত হবে।

এর বাইরে মার্কিন চাপের মুখে আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান চতুষ্টয়ের বৈঠক আয়োজনে সম্মত হয়েছে ভারত। অনেক পর্যবেক্ষক এই মার্কিন চাপকে ভারতের স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি হারানো বলে মনে করছেন এবং এ জন্যে দায়ী করছেন প্রধানমন্ত্রী মোদির অদূরদর্শী চীন নীতিকে।
একজন ভারতীয় বিশ্লেষক মত প্রকাশ করেন, ক্ষমতাসীন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব এবং মোদির ডান হাত অমিত শাহ সারাক্ষণ প্রধানমন্ত্রীকে ১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এবং চীনের কাছ থেকে আকসাই চীন এলাকাটি কেড়ে নিতে প্ররোচিত করে চলেছেন। আকসাই চীন এলাকাটি বর্তমানে চীন-শাসিত লাদাখ অঞ্চলে অবস্থিত।

মোদির স্ট্র্যাটেজিক এইড জয়শঙ্কর দাবি করেন, ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর কৌশলগত বিবর্তনের ষষ্ঠ পর্যায়ে অবস্থান করছে ভারত। ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পরই ভারত এ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ভারতের উচিত ঝুঁকি নেয়া এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেয়া।

অবশ্য এটা ঠিক যে, মোদি ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকার সাথে ভারতের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি সই হয়েছে এবং আরো একটি চুক্তি হওয়ার অপেক্ষায় আছে।

পাশাপাশি এটাও ঠিক যে, একসময় বিশ্বে আমেরিকার যে প্রশ্নাতীত একাধিপত্য ছিল, তার প্রতি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে চীন। এ অবস্থায় এশিয়ায় আমেরিকার দরকার হয়ে পড়েছে একজন শক্ত ও নির্ভরযোগ্য অংশীদারের। চীনকে দমিয়ে রাখতে আমেরিকা তাই ভারতকে সামরিক ও কৌশলগত অংশীদার বানাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা করতে না-পারলে এশিয়ায় মার্কিন আধিপত্যের অবসান ঘটবে।

এদিকে ভারত দাবি করছে যে একটি মধ্যবর্তী দেশ হিসেবে তারা তাদের স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি বজায় রেখে চলেছে। ব্রিকস, সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন, দ্য কোয়াড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অংশিদারিত্বের মাধ্যমে তারা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। কাজেই ভারত কেন দাবি করছে যে তারা তাদের স্ট্র্যাটেজিক অটোনমি বজায় রেখে চলেছে - এটা সহজে বোঝা যায়।

অন্যদিকে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে তথাকথিত উদার বিশ্বব্যবস্থার ঢোল বাজিয়ে আসছে, তারা মনে করে বিশ্বকে ডমিনেট করা অর্থাৎ বিশ্বের ওপর প্রভুত্ব করার অধিকার কেবল তাদেরই আছে। এমন অবস্থায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো চীন বিশ্বমঞ্চে হাজির হয়েছে বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষমতা, সামরিক শক্তিমত্তা ও প্রযুক্তিগত প্রাগ্রসরতা নিয়ে। স্নায়ুযুদ্ধ অবসানের সিকি শতাব্দী পর আজ এটা প্রমাণিত যে, চীনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যথেষ্ট কঠিন।

চীনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একটি বড় কৌশলের সূচনা করেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরী ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন চীনকে আয়ত্বে রাখতে এবং বিশ্বে মার্কিন দাদাগিরি বজায় রাখতে ২০১৭ সালে সূচনা করেন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির।

এ লক্ষ্য অর্জনে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় আমেরিকার প্রয়োজন একজন খাঁটি বন্ধুর। এ স্থানটি পেতে আগ্রহী ছিল অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। কিন্তু আমেরিকা ভেবেছে, চীনকে কব্জায় রাখতে সবচাইতে যোগ্য সাথী হবে ভারত।

জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নজর সবসময় ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে; জিওপলিটিক্স ও গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজির প্রতি তাদের কোনো আগ্রহই নেই। আর থাকলেই বা কী, তাদের স্ট্র্যাটেজিক সক্ষমতা একেবারেই সীমিত।

তাদের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের তুলনায় কম সুবিধাজনক। কারণ, চীনের সাথে তাদের কোনো স্থলসীমান্ত নেই।

এছাড়াও মার্কিন রণকৌশলবিদরা দেখছেন, ভারতের রয়েছে একটি বিশাল সমুদ্রসীমা, যা চীনকে দাবিয়ে রাখতে অতিরিক্ত সুবিধা হিসেবে কাজে লাগবে। ইস্টার্ন প্যাসিফিকে অস্ট্রেলিয়ার গুরুত্বও সীমিত। সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকার গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজিতে কেবল ভারতই বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।

চীনের গ্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি হলো এশিয়াকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় ভারতকে পেছনে রাখা। তাই তারা চাইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত ভারসাম্যের ক্ষেত্রে ভারতকে নিরপেক্ষ রাখতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটা দক্ষতা হলো, লোকজন যখন যেখানে যা শুনতে চায়, সেখানে ঠিক সে-কথাটি বলতে তিনি পারঙ্গম।

আমেরিকা গিয়ে তিনি ট্রাম্পের কাছে অঙ্গীকার করে এসেছেন যে মার্কিন মিত্র হিসেবে যখন যা করা দরকার সবই তিনি করবেন। আবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং-এর কাছে ওয়াদা করেছেন যে এশিয়ান সেঞ্চুরি প্রতিষ্ঠা এবং একটি বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব গড়তে একযোগে কাজ করবেন।

নেপালে একটা প্রবাদ আছে, ''বরের ঘরের পিসি, কনের ঘরের মাসি''। চীন ও আমেরিকার সাথে সম্পর্কের বেলায় মোদি সেই ২০১৬ সাল থেকেই এ কাজটি করার চেষ্টা করে আসছেন। তিনি বোধহয় মনে করেন যে ভারতের ভোটারদের যেভাবে লম্বাচওড়া ওয়াদা দিয়ে ভোলানো যায়, চীন ও আমেরিকাকেও তেমন ভোলানো যাবে। কিন্তু কূটনীতিতে এর তেমন মূল্য নেই। কেননা সেখানে চুক্তি ও মতৈক্যের ব্যাপারে প্রতিপক্ষ সবসময় জবাবদিহিতা চায়।

সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, আমেরিকার সাথে জোট বাঁধার আগে অনেকগুলো বিষয় বিবেচনায় নেয়ার দরকার ছিল, যা মোদি করেননি।

প্রথমত, ভারত ও তার উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিবেশী চীনের মধ্যে রয়েছে ৩,৪৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ স্থলসীমান্ত। ভারতের প্রতিটি কৌশলগত ব্যবস্থার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখে চীন।

দ্বিতীয়ত, ১৯৬২ সালে চীনের সাথে ভারতের তুলনা করা যেত। তখন উভয় দেশের অর্থনীতি এবং সামরিক ও কৌশলগত শক্তি কমবেশি একই রকম ছিল। কিন্তু আজ চীনের অর্থনীতি ভারতের চাইতে অনেক বড়। আর তাদের প্রতিরক্ষা বাজেট ভারতের তিন গুণ।
তৃতীয়ত, মোদি একটা বিষয় দেখছেন না যে, চীন প্রতিটি ফ্রন্টেই বিনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে চলেছে। আর গত দু'দশক ধরে আমেরিকা সবখানে লড়াই করছে, কিন্তু একটাতেও জয়ী হতে পারেনি।

চতুর্থত, ভারত চাইছে আমেরিকার সাথে জোট বাঁধতে, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দেয়া বেশিরভাগ প্রতিশ্রæতি থেকে সরে এসে আমেরিকা তার মিত্রদের সাথে বেঈমানি করে চলেছে। এমন অবস্থায় আমেরিকার সাথে মৈত্রী গড়ে ভারত কতদূর কী করতে পারবে, সেটাই এখন বিশ্বজনের দেখার বিষয়।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে