করোনায় লন্ডভন্ড ভারত

লকডাউন শিথিল করলেও বিভিন্ন স্থানে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ রোধে রাজ্য সরকারগুলো কড়াকাড়ি আরোপ করছে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ঠিকঠাক চলছে না। যেমন পাঞ্জাবে রাত্রিকালীন কারফিউ চলছে - সিএনবিসি

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৩৬

করোনা মহামারিতে লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে ভারত। বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ ঘটছে ভারতে। দৈনিক আক্রান্ত হচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। প্রতিদিন মারা যাচ্ছে এক হাজার লোক। করোনার তান্ডবে ভারতের অর্থনীতিতেও ধস নেমেছে। বছরের প্রথম প্রান্তিকেই দেশটির অর্থনীতি ২০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞর বলছেন, ভারতে করোনা পরিস্থিতি সামনে আরও ভয়াবহ হবে। ফলে অর্থনীতিও হবে বেসামাল। নিউইয়র্ক টাইমস ও আলজাজিরার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আজ থাকছে ভারতের অনিশ্চিত গন্তব্যের রূপরেখা।

বিশ্বের যে কোনো দেশের তুলনায় করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি বাড়ছে ভারতে। জনাকীর্ণ শহর, লকডাউনের পর শিথিল মনোভাব এবং কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের অভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনবহুল দেশটির প্রতিটি প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে রোগটি। চলতি সপ্তাহে দেশটিতে আগের সপ্তাহের চেয়ে রোগী বেড়েছে ৭ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে ভাইরাসটি বিস্তারের হারও বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকার অর্থনীতির স্বার্থে কড়াকড়ি শিথিল করায় অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের মেলাকা মনিপল কলেজের স্বাস্থ্য গবেষক ডা. অনন্ত ভান বলেন, ‘বর্তমানের ঘটনা প্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে সংক্রমণ ভয়াবহ হবে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে, বিশ্বে শীর্ষ সংক্রমিত দেশ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ভারত।’

১৩০ কোটি জনসংখ্যার ভারতে আগস্টের শেষ নাগাদ ৩৬ লাখের বেশি লোক করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মৃতের সংখ্যা প্রায় ৬৫ হাজার। আক্রান্তের দিক থেকে ভারত বিশ্বে শীর্ষ তিনে রয়েছে। মৃত্যুর দিক থেকে কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও শিগগিরই একই অবস্থানে পৌঁছবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সংক্রমণ ও মৃত্যুতে বিশ্বে শীর্ষে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে চলতি সপ্তাহে গড়ে দৈনিক ৪২ হাজার এবং দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলে ৩৭ হাজার করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে চলতি সপ্তাহে আগের সপ্তাহের তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ১১ শতাংশ কমেছে। ব্রাজিলেও কমেছে ৬ শতাংশ।

ভারতে মার্চ থেকে মে পর্যন্ত কঠোর লকডাউনে রোগী ছিল সীমিত। তখন মূলত শহরে রোগটি সীমাবদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও রোগীরা চিকিৎসা পায়নি। এখন রোগটি গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে করোনা রোগীদের চিকিৎসায় কী অবস্থা হবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। অবস্থা এতটাই খারাপ যে রাজধানী নয়াদিল্লির এক অন্তঃসত্ত্বা নারী ১৫ ঘণ্টায় ৮টি হাসপাতালে গিয়েও চিকিৎসা পাননি। শেষ পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্সেই তার মৃত্যু হয়।

ভালো দিক হলো ভারতের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যু কম। এর কারণ দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশই তরুণ ও কম ওজনের। আর করোনায় বেশি মৃত্যু হচ্ছে প্রবীণ ও স্থুলকায় লোকদের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত সরকার করোনায় মৃত্যুর যে হিসাব দিচ্ছে তাতে অনেক প্রাণহানির খবরই আসছে না। অনেক সময় তারা ইচ্ছেকৃতভাবেও মৃত্যুর হিসাব কম করে দেখাচ্ছে যাতে জনগণ ভীতসন্ত্রস্ত্র না হয়ে পড়ে।

ভারতে সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য মহারাষ্ট্রে। দেশটির বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাই এ রাজ্যেই অবস্থিত। মোট শনাক্তের ৩৪ শতাংশ শুধু এই এক রাজ্যের বাসিন্দা। এখানে করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২৩ হাজারের বেশি লোকের। মুম্বাই শহরে লাখ লাখ মানুষ ঘিঞ্জি বস্তিতে বসবাস করে। একটি রুমে ৮ থেকে ১০জনও থাকে সেখানে। করোনার মত অত্যন্ত ছোঁয়াছে রোগ এসব জায়গায় নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ।

১২ কোটি জনসংখ্যার মহারাষ্ট্রে একদিনে ৩৫৫ জনের মৃত্যুও হয়েছে। ভারতে এখন যত লোক আক্রান্ত হচ্ছে তার ৭৩ শতাংশ আসছে ১০টি রাজ্য থেকে। দেশটিতে ২৮টি রাজ্য রয়েছে। মহারাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি বিপন্ন হচ্ছে তামিল নাড়ু, কর্নাটক, তেলেঙ্গানা ও গুজরাট।

তামিল নাড়ুর ক্রিশ্চিয়ান মেডিকেল কলেজের ক্লিনিক্যাল ভাইরোলজির সাবেক প্রধান থেক্কেকারা জ্যাকব জন বলেন, সেপ্টেম্বরে ভারতে করোনার তান্ডব চূঁড়ায় পৌঁছবে। তিনি বলেন, দেশটির স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোর সবচেয়ে বড় পরীক্ষা হবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে করোনায় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের হচ্ছে সমাজ থেকে অনেকাংশে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসকারী উপজাতীয়রাও করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। যেমন ভারত মহাসাগরের দ্বীপ আন্দামানে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে বসবাসকারী আদিবাসীরাও করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তার মানে হচ্ছে ভাইরাসটি এখন সব জায়গায় পৌঁছে গেছে।

করোনার বড় ধাক্কার আগেই ভারতের অর্থনীতিতে টালমাটাল অবস্থা ছিল। হিন্দুত্ববাদী নেতা নরেন্দ্র মোদির শাসনে ভারতের অর্থনীতি ক্রমেই সংকুচিত হতে শুরু করে বেশ আগেই। মার্চে সমাপ্ত অর্থবছরে দেশটির অর্থনীতি ৫ দশমিক এক শতাংশ সংকুচিত হয়। ১৯৭৯ সালের পর ভারতের অর্থনীতি এতো খারাপ ছিল না কখনোই।

মার্চ থেকে ভারতে লকডাউন শুরু হলে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে ভারতের অর্থনীতি ২৫ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয়েছে বলে মনে করেন লন্ডনভিত্তিক ঋণদানকারী সংস্থা বারক্লেসের অর্থনীতিবিদ রাহুল বাজোরিয়া। এর মানে প্রবৃদ্ধি তো দূরের কথা, গত বছর একই সময় অর্থনীতির আকার যা ছিল তা থেকেও ২৫ শতাংশ ছোট হয়েছে ভারতের অর্থনীতি। যা একটি দেশের অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ ব্যাপার।

অর্থনীতির পতন ঠেকাতে গত মে মাসে ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ২৬৫ বিলিয়ন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন। এটা দেশটির মোট ডিজিপির ১০ শতাংশ। তবে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, ওই ঘোষণায় শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। প্রণোদনায় ব্যয় হয়েছে জিডিপির বড়জোর এক শতাংশ। এটা পতনশীল অর্থনীতিকে উদ্ধারের জন্য যথেষ্ট নয়।

ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার লকডাউন শিথিল করলেও বিভিন্ন স্থানে ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ রোধে রাজ্য সরকারগুলো কড়াকাড়ি আরোপ করছে। ফলে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ঠিকঠাক চলছে না। যেমন পাঞ্জাবে রাত্রিকালীন কারফিউ চলছে। হরিয়ানায়ও কঠোর বিধিনিষেধ জারি করেছে রাজ্য সরকার। এতে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড দারুণভাবে ব্যাহত হয়েছে।

অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সংকুচিত হওয়ায় রাজকোষেও টান পড়েছে। জুনে সমাপ্ত প্রথম প্রান্তিকে সরকারের কর আদায় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ শতাংশ বা ২৫ বিলিয়ন ডলার কমে গেছে।

এ অবস্থায় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত রেলওয়ের ১০৯টি রুট বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

প্রবৃদ্ধি তো দূর অস্ত, ২০২১-২২ অর্থববছরে ভারতীয় অর্থনীতি ৯ শতাংশ পর্যন্ত পেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গবেষণা সংস্থা ম্যাককিনসে। অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করেছে, গত অর্থ বছরে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৪ দশমিক ২ শতাংশ।

অনেকেই মনে করছিল, রাজকোষের ঘাটতি বাড়িয়ে লকডাউনে উদারহস্ত হতে চায়নি কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের ভয় ছিল, তাতে ভারতের রেটিং কমিয়ে দেবে সংস্থাগুলি। এর জেরে বিনিয়োগকারীরা আর আসবে না দেশে। বিদেশি ঋণ পেতেও সমস্যা হবে দেশটির। সেই আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে কয়েকদিন আগেই মুডিজ ইনভেস্টরস সার্ভিস ভারতের রেটিং নামিয়ে আনে। তার মানে আরও তলানিতে যেতে চলেছে ভারতের অর্থনীতি। এমনটাই আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

ভারতের অর্থনীতির বেহাল দশা এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমনও একে ‘দৈবদুর্বিপাক’ বলে মন্তব্য করেছেন। এতে অবশ্য বিরোধী দল কংগ্রেস তাকে তুলোধুনো করেছে। তার মন্তব্যে ক্ষেপেছে শাসক দল বিজেপির নেতারাও।

কংগ্রেস নেতা ও সাবেক কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম কটাক্ষ করে বলেছেন ‘এ বছর করোনার কারণে ভারতের অর্থনীতি নিম্নমুখী তা সকলেই বুঝতে পারছেন। কিন্তু মহামারির আগে, ২০১৭ সাল থেকেই ভারতের অর্থনীতি কেন ধুঁকতে শুরু করেছিল, সে বিষয়ে ভগবানের দূত নির্মলা সীতারামন কি কিছু জানাবেন?’

ভারতের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যু কম। এর কারণ দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশই তরুণ ও কম ওজনের। ছবি : ইন্টারনেট
ভারতের আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যু কম। এর কারণ দেশটির জনসংখ্যার একটি বড় অংশই তরুণ ও কম ওজনের। ছবি : ইন্টারনেট

 

ভারতের অর্থনীতির এই দুঃসময়ে প্রতিবেশী চীনের সঙ্গেও এক ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধে জড়িয়েছে মোদি সরকার। এতে চীনের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা না নাগলেও ভারত যে আরো বেকায়দায় পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভারতের অর্থনীতির এই বেহাল দশার মধ্যেও মোদির গালভরা গল্প অবশ্য থামছে না। তিনি দিয়ে যাচ্ছেন উচ্চাভিলাসী প্রকল্প। এরই একটি হচ্ছে আগামী ৫ বছরে জাতীয় অবকাঠামোর নির্মাণে ১ লাখ ৪০ কোটি ডলার ব্যয়ের ঘোষণা। এতে দেশটির বন্দর, রেলওয়ে ও গণপরিবহনে মেট্রো সিস্টেম চালু হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ক্লিন এনার্জি সরবরাহ, মানসম্মত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাও এই প্রকল্পের অন্তভুক্ত। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা এখন প্রশ্ন তুলছেন, এতো টাকা আসবে কোত্থেকে?

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে