কোথায় গেলো মোদির স্ট্রংম্যান ইমেজ

নিজেকে একজন 'লৌহমানব'রূপে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন মোদি - এফটি ডটকম

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ৩০ জুলাই ২০২০, ১৩:০৬

চীন-ভারত সীমান্তের লাদাখ এলাকা এখন শান্ত। আপাত শান্তির ছাইয়ের নিচে চাপা পড়ে গেছে সম্ভাব্য যুদ্ধের আগুন। তবে লাদাখ ইস্যু নিয়ে আগুন জ্বলছে ভারতের রাজনীতিতে।

দিনকয় আগে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন যে, মোদির পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতাই ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে চীনকে। নিজের অফিসিয়াল টুইটারে এক দীর্ঘ ভিডিওতে লাদাখে ভারতের কৌশলগত স্বশাসন হারানোর জন্য মোদিকেই দায়ী করার চেষ্টা করেন রাহুল গান্ধী। জানতে চান, ''চীন ঠিক এ সময়টাকেই কেন বেছে নিল? ভারতে এমন কী হয়েছে, যা চীনকে এমন আগ্রাসী হয়ে উঠতে প্ররোচিত করলো? ঠিক এ সময় কিসে চীনকে এত আত্মবিশ্বাস দিল যে তারা ভারতের মতো একটি দেশের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে পারে?''

রাহুল অভিযোগ করেন, মোদি নিজেকে বিশ্বের অন্যতম বড় ও প্রভাবশালী নেতাদের একজন হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টায় ব্যস্ত। তিনি বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে ''লেনদেনভিত্তিক'' সম্পর্ক গড়তে চাইছেন, যা পরিণামে ভারতকে 'কৌশলগত স্বশাসন' হারানোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মনমোহন সিং-এর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার ২০১৪ সালের মে মাস পর্যন্ত যে 'কৌশলগত স্বশাসন' বজায় রেখেছিলেন, মোদী সরকার তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন রাহুল গান্ধী।

রাহুলের টুইটার পোস্টিংটি এমন সময় এলো যখন তার দেশব্যাপী তার 'দুর্বল' ও 'অকর্মণ্য' নেতৃত্বের তীব্র সমালোচনা হচ্ছিল। বলা হচ্ছিল, ''পররাষ্ট্রনীতিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে আলাদা করা উচিত'' এ কথাটাও কংগ্রেস নেতৃত্ব জোর গলায় বলতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ২০১৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মোদী ভারতের ঐতিহ্যবাহী এ নীতি থেকে দূরে সরে থাকছেন।

এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, লাদাখ-কাণ্ডের আগ পর্যন্ত পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ে ভারত সরকার ও বিরোধী দলের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অভিন্ন। বৈদেশিক ইস্যুগুলোকে যে-কোনো রকম অপরাজনীতির শিকার হওয়া থেকে বাঁচাতে উভয় পক্ষই ছিল সমান সতর্ক। অনেক সাংবাদিক, বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদও পররাষ্ট্রনীতি প্রশ্নে, তা হোক বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক, সরকারের সাথে অভিন্ন মত পোষণ করতেন।

২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামা সন্ত্রাসবাদী হামলার পর ''পররাষ্ট্রনীতিকে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থেকে আলাদা করার'' ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় মূল্যবোধ থেকে সরে আসেন মোদী। তিনি নিজেকে এ সময় একজন ''লৌহমানব''রূপে তুলে ধরতে এবং ওই ঘটনাকে আসন্ন নির্বাচনে ভোট পাওয়ার হাতিয়াররূপে ব্যবহার করতে শুরু করেন। ওই বছরের এপ্রিল ও মে মাসে ভারতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোদী ছিলেন ভাগ্যবান। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অনেক ব্যর্থতা সত্ত্বেও পুলওয়ামা সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা তার মাথায় বিজয়ের মুকুট পরিয়ে দেয়।

তবে এবার ঘটনা ঘটেছে অন্য রকম। এবার শুধু বিরোধী দলগুলোই নয়, পররাষ্ট্র বিষয়ক দায়িত্বশীল সাংবাদিকমহল, কৌশলগত বিশ্লেষকবৃন্দ এবং শিক্ষাবিদগণও মোদির সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। বলছেন, লাদাখকাণ্ডে মোদির চীন নীতির অব্যবস্থাপনাই প্রকট হয়ে উঠেছে। একই সাথে পররাষ্ট্রনীতি ইস্যুতে ভারত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর এ ইস্যুতে ভারতের দ্বিধাবিভক্তি এটাই প্রথম।

২০১৯ সালের নির্বাচনে কংগ্রেসকে জয়ী করে আনতে রাহুল গান্ধীর ব্যর্থতার কারণ শুধু এটাই নয় যে, পররাষ্ট্রনীতিকে নির্বাচনী ইস্যু বানিয়েছিলেন মোদি, রাহুল তা প্রতিরোধ করতে পারেননি। বরং সীমান্ত রক্ষায় সেনাবাহিনীর সাফল্য যে কেবল সরকারের নয়, বরং গোটা দেশের সাফল্য - এ সত্যটা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরতেও ব্যর্থ হয়েছে কংগ্রেস। বিপরীতে পুলওয়ামা হামলার পর পাকিস্তানের বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সারজিক্যাল স্ট্রাইককে দেশবাসীর কাছে তার ব্যক্তিগত সাফল্যরূপে তুলে ধরতে পেরেছেন মোদি।

অবশেষে অনেক দেরিতে হলেও লাদাখকাণ্ডে মোদির পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতাকে তাকে আক্রমণের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগালেন রাহুল। বললেন, কোথায় গেল আপনার স্ট্রংম্যান ইমেজ, লাদাখে ওটা কাজে লাগাননি কেন?

কৌতুহলোদ্দীপক হলো, রাহুল এমন সময় মুখ খুললেন, যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার চীন নীতি পরিবর্তনের আভাস দিয়েছেন।

মোদি যে বিষয়টি সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি তা হলো, ট্রাম্পের কাছে এখন সবকিছুর উপরে হলো আগামী নভেম্বর মাসের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসা। এ কাজে তিনি দেশী-বিদেশী সকল পক্ষকে কাজে লাগাতে চান। ট্রাম্প যে তাকেও এ কাজে ব্যবহার করছেন, এ কথা আগে বুঝতে পারেননি দেখে বেশ বোকা বনে গেছেন মোদি।

মোদি ভেবেছিলেন, চীনকে বাগে আনতে যুক্তরাষ্ট্র তাকে সত্যিই সমর্থন দিয়ে যাবে। এটা হলো সেই সময়ের কথা, যখন কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়া রোধে ব্যর্থতার অভিযোগের মুখে চীন বেশ বেকায়দায় ছিল। এ সময় মোদীকে তার বিদেশী বন্ধুরা এবং নিজ দল বিজেপি-র নীতি বিশ্লেষকরা বোঝাতে সক্ষম হন যে, চীন এখন বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে। কাজেই ১৯৬২ সালের যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণের এটাই মোক্ষম সময়।

এদিকে চীনের বিরুদ্ধে কড়া বাকোয়াজ করেও ট্রাম্প তার জনপ্রিয়তার পতন ঠেকাতে পারছেন না। সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ডেমক্র্যাট প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেন জনপ্রিয়তায় ট্রাম্পের চাইতে ডাবল ডিজিট ব্যবধানে এগিয়ে আছেন। করোনা অতিমারী ঠেকাতে ব্যর্থতা ট্রাম্পের জনপ্রিয়তাকে তলানিতে নামিয়ে এনেছে। সর্বশেষ জরিপগুলোতে দেখা গেছে, কেবল চীনের বিরুদ্ধে কড়া বাকোয়াজ করে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে পারবেন না ট্রাম্প। এর ফল হয়েছে এই যে, চীন নীতি পরিবর্তনের জন্য ট্রাম্পের ওপর চাপ বেড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ হোয়াইট হাউসের প্রেস সচিব ম্যাকইনানীর একটি বক্তব্য তুলে ধরা যায়। গত ১৭ জুলাই তার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিঙয়ে তাকে প্রশ্ন করেন প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিধি ললিত কুমার ঝা। জবাবে ম্যাকইনানী যা বলেন তাতেই ফুটে ওঠে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতিমধ্যেই তার চীন নীতি পরিবর্তন করেছেন।

দু'জনের প্রশ্নোত্তর ছিল এ রকম :
ললিত : ধন্যবাদ। চীন বিষয়ে আরেকটি প্রশ্ন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পই আমেরিকার একমাত্র প্রেসিডেন্ট, যিনি চীনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে দাঁড়িয়েছেন। এটি ভারত এবং এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্রদের জন্য বিরাট স্বস্তি। তিনি কি চীনের কাছে এ নিয়ে কোনো বার্তা পাঠিয়েছেন? (অস্পষ্ট) বিরুদ্ধে কিভাবে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করা যায়, তা নিয়ে তিনি কি চীন ও অন্যান্য দেশের সাথে কথা বলেছেন?

ম্যাকইনানী : ধন্যবাদ, ললিত। তোমার প্রশ্নটি আমি আগেই দেখেছি এবং প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করেছি। তিনি বলেছেন, ''আমি ভারতের জনগণকে ভালোবাসি এবং আমি চীনের জনগণকে ভালোবাসি। তাই জনগণ যাতে শান্তিরে থাকতে পারে, সেজন্য সম্ভবপর সবকিছুই করতে চাই।'' থ্যাংক ইউ।

এরপর ২১ জুলাইর প্রেস ব্রিফিঙয়ে চীন নিয়ে কোনো কথাই বলেননি ম্যাকইনানী। তিনি এদিন চীন বিষয়ক একটি প্রশ্নের জবাবও এড়িয়ে যান।

সুর বদলেছেন স্বয়ং ট্রাম্পও। গত ১৪ জুলাই এক বিবৃতিতে ট্রাম্প চীনের প্রসঙ্গ টানেন ৬০ বার। ২০ জুলাইর আরেক বিবৃতিতে তা নেমে আসে সাতবারে। এখন তার গলায় আপসের সুর। বোঝাই যায়, তিনি চীনের সাথে একটা বোঝাপড়ায় যেতে চান। এ থেকে পরিষ্কার যে, আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে মোদিকে কাজে লাগাতে চান ট্রাম্প।

আর ঠিক এই মোক্ষম সময়েই পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার জন্য মোদিকে দায়ী করলেন রাহুল গান্ধী। আর মোদির হয়ে তার দীর্ঘ জবাব দিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রাহমনিয়াম জয়শঙ্কর। টুইটারে রাহুলের বিরুদ্ধে ১০ দফা তোপ দাগেন তিনি। বলেন, বৃহৎ শক্তিগুলোর অংশীদার হয়ে মোদি কী অর্জন করেছেন, জানতে হলে বিশ্লেষকদের জিজ্ঞেস করুন!

জয়শঙ্কর লিখেছেন, বৃহৎ শক্তিগুলোর সাথে আমাদের অংশীদারিত্ব জোরদার হয়েছে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের অবস্থান উঠে গেছে উপরে। আমেরিকা, রাশিয়া, ইউরোপ ও জাপানের সাথে আমাদের নিয়মিত শীর্ষ বৈঠক ও ইনফর্মাল মিটিংগুলোর দিকে তাকান। চীনের সাথেও অধিকতর রাজনৈতিক সমকক্ষতা নিয়ে আমরা কাজ করে চলেছি। জানতে চাইলে বিশ্লেষকদের জিজ্ঞেস করুন।

এরও জবাব দেন রাহুল। ২০ জুলাই টুইটারে পোস্ট করা আরেক ভিডিওতে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার জন্য আবারও মোদিকে দায়ী করার চেষ্টা করেন তিনি। বলেন, ''ক্ষমতায় থাকার জন্য নিজের একটি ভুয়া স্ট্রংম্যান ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এটাই তার সবচাইতে বড় শক্তি আর এটাই এখন ভারতের সবচাইতে বড় দুর্বলতা।''

রাহুল বললেন, কোথায় গেল আপনার স্ট্রংম্যান ইমেজ। ছবি : অনিন্দিত মুখার্জি, রয়টার্স
রাহুল বললেন, কোথায় গেল আপনার স্ট্রংম্যান ইমেজ। ছবি : অনিন্দিত মুখার্জি, রয়টার্স

 

বাস্তবিকই মোদি এখন বেশ-খানিকটা ব্যাকফুটে আছেন। তার হাতে এ মুহূর্তে এমন কোনো অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ইস্যু নেই, যা ব্যবহার করে তিনি প্রবল বেগে নিম্নমুখী জনপ্রিয়তাকে টেনে তুলতে পারেন।

দেশের ভেতরে করোনা অতিমারী আর লাদাখকাণ্ডে পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা ঢাকতে মোদী এখন চাইছেন ভোটার ও করদাতাদের মনোযোগ ঘুরিয়ে দিতে। এরই অংশ হিসেবে আগামী ৫ আগস্ট অযোধ্যায় বিতর্কিত রামমন্দিরের শিলান্যাস বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন তিনি। কিন্তু এই একটি কাজ করে মোদি কি পারবেন তার নিম্নমুখী জনপ্রিয়তা উদ্ধার করতে?

মোদির স্ট্রংম্যান ভাবমূর্তিও দেশে-বিদেশে এখন প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এ ভাবমূর্তি রক্ষায় মোদির সামনে একটাই অপশন - চীন ও ভারতের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা গত ৮ জুলাইর অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া। আর এটা করতে হলে শক্তি প্রয়োগ করতে হবে। মোদী তা করতে গেলে পরাজয় অনিবার্য। কেননা এ কাজে কোনো মিত্র দেশেরই সাহায্য পাবে না ভারত।

অর্থনৈতিক বা সামরিক শক্তি - কোনো দিক থেকেই চীনের সমকক্ষ নয় ভারত। এমন অবস্থায় মুখোমুখি সংঘাত ভারতকে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের চাইতেও করুণ পরিণতির শিকার হতে পারে।

আর দেশীয় বা আন্তর্জাতিক - কোনো ক্ষেত্রেই মোদীকে স্ট্রংম্যানের মতো দেখাচ্ছে না। ভারত হয়ে গেছে দ্বিধাবিভক্ত। এমন অবস্থায় চীনও মোদীর সাথে কোনো কূটনৈতিক সমাধানে যেতে চাইবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ, মোদি তাদের চোখে আর ঐক্যবদ্ধ ভারতের প্রতিনিধি নন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে