ভারতের অসম লড়াই, সরে আসা কঠিন

কার্টুনটি করেছেন সন্তোশ মিশরা - ডব্লিও টি ডব্লিও

  • সাকিব ফারহান
  • ১৯ জুলাই ২০২০, ২২:০১

ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত সংঘাতের পর ভারতের আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে উগ্র জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ আরো তীব্র রুপ নিচ্ছে। এর ফল হিসাবে বাড়বে দক্ষিন এশিয়ায় সামরিক প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা শুধু চীন ও ভারতের মধ্যে নয়, পাকিস্তানের ওপর প্রভাব ফেলবে। এমনকি দক্ষিন এশিয়ার ছোট দেশগুলো এক ধরনের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়তে যাচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন মানের উন্নয়নের দিকটি আরো বেশি উপেক্ষিত থেকে যাবে। বাড়বে সামরিক ব্যয়।

লাদাখে ভারত ও চীনের সৈন্যদের মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়ার কাছ থেকে ২৪০ কোটি ডলারে ৩৩টি যুদ্ধবিমান ক্রয় করার। চীনের সঙ্গে সীমান্ত বিরোধের মধ্যে বিমান বাহিনীকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ গ্রহন করে ভারত। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায় , ২১টি মিগ-২৯ ও এক ডজন সু-৩০ জেট ক্রয়ে সরকারের ১৮ হাজার ১৪৮ কোটি রুপি বা ২৪৩ কোটি ডলার ব্যয় হবে। একই সঙ্গে আগে কেনা ৫৯টি মিগ-২৯ আপগ্রেড করা হবে।

জুন মাসে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংয়ের মস্কো সফরে রাশিয়ান যুদ্ধবিমানের ব্যাপারে সবুজ সংকেত দেয়া হয়। তিনি তখন যুদ্ধবিমানগুলো দ্রুত সরবরাহের আহ্বান রাখেন। ভারতের সামরিক অস্ত্র আমদানির অর্ধেকই রাশিয়া থেকে আনা। তবে গত দশকে উচ্চ প্রযুক্তির অস্ত্র ক্রয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দিকে নজর দিয়েছে নয়াদিল্লি।

চীন ও ভারতের মধ্যে এই দ্বন্দ্বে প্রাথিমিকভাবে লাভ অস্ত্র বিক্রেতা দেশগুলোর। যার মধ্যে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স ও ইসরাইল। গত মার্চ মাসে প্রকাশিত স্টকহোম সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিশ্বের দ্বিতীয় সমরাস্ত্র আমদানিকারক দেশ হলো ভারত। দেশটিকে শুধু অস্ত্র আমদানি করতে হচ্ছে মুলত চীনের সাথে প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে। ভারতের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন দেশটির ভূঅবস্থানগত কারনে এক সাথে দুটি শত্রু দেশকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। পূর্বে চীন ও পশ্চিমে পাকিস্তান। দুই দেশের প্রতিযোগিতা ভারতকে সামরিক দিক দিয়ে এক কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

লাদাখে ২০ জন সৈন্য প্রান হারানোর পর ভারতের আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে চাপের মুখে পড়ে বিজেপি সরকার। মোদি সরকারকে এখন সাধারন মানুষের কাছে এই বার্তা দিতে হবে যে চীনের মোকাবিলায় ভারতের সামরিক বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতের জন্য সমস্যা হচ্ছে চীনকে প্রতিদ্বন্দ্বি হিসাবে জনমানসে হাজির করার বিপদ আছে। চীন সমরাস্ত্রের জন্য অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল নয়। এর বিপরীতে ভারত সমরাস্ত্রের দিক দিয়ে মূলত বিদেশের ওপর নির্ভরশীল একটি দেশ। শুধু বিমান বাহিনীর দিকে নজর দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।

ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান হলো এসইউ-৩০ এমকে। রাশিয়ার কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে ভারতের হিন্দুস্তান এরোনটিক্স লিমিটেড তৈরি করছে এ বিমান। ভারতের বিমান বাহিনীতে বর্তমানে ২৭২টি বেশি এসইউ-৩০ বিমান রয়েছে। তিন শতাধিক এ বিমান ভারতের বিমান বাহিনীতে যুক্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মাধ্যমে ভারত হবে এ বিমানের সবচেয়ে বড় ব্যবহারকারী দেশ। এটি চতুর্থ প্রজন্মের বিমান।

এ ছাড়া নেপুচন, ফ্যালকন নামে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান রয়েছে ভারতে। ফ্যালকন বিমানে রয়েছে শক্তিশালী এয়ারবর্ণ আর্লি ওয়ার্নিং এন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম। অনেক দূরের বিমান, জাহাজ এবং সমরযান সনাক্ত করতে পারে এ বিমান। ভারতের কাছে থাকা অন্যতম শক্তিশালী য্দ্ধু বিমান এটি। এ ধরনের তিনটি রাডার সিস্টেমের বিমান রয়েছে ভারতের। এ রাডার সিস্টেম ইসরাইলের তৈরি।

ভারতের কাছে থাকা অন্যান্য শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান হলো ফ্রান্সের তৈরি রাফালে, মিরেজ, রাশিয়ার তৈরি মিগ-২৯, মিগ ২১ বৃটেন ও ফ্রান্সের তৈরি জাগুয়ার, ভারতের তৈরি তেজাস। গোয়েন্দা, পর্যবেক্ষন কাজের জন্য ভারতের কাছে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের তৈরি বিমান। এছাড়া ভারতের কাছে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি শক্তিশালী এপাচি হেলিকপ্টার।

এর বিপরীতে চীনের বিমান বাহিনীর দিকে তাকানো যাক। চীনের কাছে পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ ফাইটার ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান যা সম্পূর্ণরুপে তাদের নিজেদের তৈরি। চীনের কাছে রয়েছে হাইপারসনিক মিসাইলসহ ভয়াবহ ক্ষমতার বিভিন্ন ধরনের মিসাইল যা তাদের নিজস্ব উদ্ভাবিত। এমনকি চীনের রয়েছে এন্টি স্যাটেলাইট মিসাইল। এভাবে সমরাস্ত্র শিল্প, সমরাস্ত্র প্রযুক্তি, ড্রোন প্রযুক্তি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সমহ সামগ্রিক প্রযুক্তি ক্ষেত্রে চীনের অগ্রযাত্রা, রকেট ও মহাকাশ কার্যক্রম, শক্তিশালী রণতরী প্রভৃতি বিষয় তুলনা করলে চীনের সাথে ভারতের বড় ধরনের শক্তির পার্থক্য স্পষ্ট। চীন বিশ্বে দ্বিতীয় সমরাস্ত্র প্রস্তুতকারক দেশ। বিশ্বের বড় ১০টি সমরাস্ত্র প্রস্ততকারী প্রতিষ্ঠানের তিনটিই বর্তমানে চীনের।

একটি দেশের সামরিক সক্ষমতা নির্ভর করে দেশটির অর্থনৈতিক শক্তির ওপর। মাত্র কয়েক বছর আগেও ভারত চীনকে মনে করত তাদের প্রতিযোগী। দুদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সর্ম্পক বাড়ছিলো। ভারতে বড় বড় প্রকল্পগুলোতে চীনের বিনিয়োগ কম নয়। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রæত বদলে গেছে। এখন ভারত- চীনকে গণ্য করছে প্রধান শত্রæ হিসাবে। ভারত ঢুকে পড়ছে চীন বিরোধী পশ্চিমা বলয়ে কিন্তু এর প্রভাবে দুদেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারে।

চীনের সাথে ভারতের শক্তির ভারসাম্যহীনতার কারনে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান কৌশলগত মিত্র বানিয়েছে দিল্লি। ধীরে ধীরে চীন- যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েছে ভারত। চীনের বিশ্বাস ভারত এখন আরো বৃহত্তর পরিসরে ভূ-কৌলশগত গেমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রক্সি হিসেবে ভূমিকা পালন করবে। লাদাখের ঘটনার পর ভারত কোনো ধরনের রাখঢাকা না করে এ দিকে ঝুকে পড়ছে।

ভারতীয় একটি পত্রিকায় কার্টুনটি করেছেন মিকা আজিজ- দ্যা প্রিন্ট ডট ইন
ভারতীয় একটি পত্রিকায় কার্টুনটি করেছেন মিকা আজিজ- দ্যা প্রিন্ট ডট ইন

 

যুক্তরাষ্ট্রের পর চীনের সাথে পশ্চিমা বিশ্বে চীনের সাথে যে দেশটির খারাপ সর্ম্পক সেটি হলো অষ্ট্রেলিয়া। চীনের সাথে উত্তেজনার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার সাথে একে অপরের সামরিক ঘাটি ব্যবহারের চুক্তি স্বাক্ষর করে ভারত। এ অঞ্চলে চীনের সামরিক ও অর্থনৈতিক উত্থান মোকাবেলায় যে এ নিরাপত্তা চুক্তি তা বোঝা কঠিন নয়। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে বলা হয়েছে এ চুক্তির ফলে উভয় দেশের সামরিক বিনিময় এবং ইন্দো-প্যাসেফিক অঞ্চলে মহড়ার পথ পরিষ্কার হলো।

চুক্তি অনুসারে উভয় দেশের রণতরী এবং যুদ্ধ জাহাজ জ্বালানি তেল সংগ্রহ, মেরামতসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ভারতের সামরিক চুক্তি রয়েছে।

ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসহারে ভারতের বার্ষিক নৌ মহড়ায় যুক্তরাষ্ট্র, জাপানের সাথে অস্ট্রেলিয়াকেও যুক্ত করার চেষ্টা করছে। ২০০৭ সালে ভারত এ ধরনের চারদেশীয় যৌথ মহড়া চালায় যা চীনকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।

ভারতের এই পশ্চিমমুখী নীতির কারনে চীন দক্ষিন এশিয়ায় আরো বেশি মনোযোগি হয়েছে। ভারতের প্রতিবেশি ছোট দেশগুলোর সাথে সর্ম্পক ঘনিষ্ট করছে। অর্থনৈতিকভাবে দূর্বল এসব দেশের পাশে দাড়নোর মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য চীনের আছে। এছাড়া পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল বা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সাথে চীনের বড় ধরনের কোনো দ্বিপাক্ষিক সমস্যা নেই। এমনকি নেপাল ছাড়া অন্য কোনো দেশের সাথে নেই কোনো সীমান্ত। প্রতিটি দেশের সাথে চীনের রয়েছে নিবিড় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা। ফলে খুব সহজেই চীন এসব দেশের সাথে সর্ম্পক জোরদার করতে পারছে।

অপরদিকে ভারত এমন এক সময় চীনের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে যখন দেশটির অর্থনীতি নাজুক অবস্থার মধ্যে রয়েছে। ২২ বছরেরর মধ্যে ভারতে সবচেয়ে কম বিনিয়োগের ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে এ বছর। লকডাউন শিথিলের মাধ্যমে অর্থনীতি চালু হওয়ার আশা করা হচ্ছে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে দীর্ঘ সময় লাগবে। অর্থনীতিবিদদের মতে ২০২০-২১ অর্থ বছরে ভারতের জিডিপি মাইনাস ৭ থেকে শুন্যের ঘরে নেমে আসতে পারে। আর এটা হবে ১৯৭০ সালের চেয়েও বড় আকারের মন্দা।

ভারতের আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে যে উগ্রজাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ তৈরি করা হয়েছে তা দেশটিকে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে অবস্থান ধরে রাখার জন্য চীনের সাথে একটি অসম প্রতিযোগিতা আর লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে ভারতকে। এখান থেকে সরে আসাও ভারতের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। কারন পশ্চিমা দেশগুলোও ভারতকে পুরোপুরিভাবে চীনবিরোধী ভূকায় ব্যবহার করবে। যা থেকে ভারত খুব কমই লাভবান হবে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে