পানি নিয়ে চীন, ভারত ও পাকিস্তানের লড়াই

আগামী দিনগুলোতে পানি বণ্টনই হয়ে উঠবে পাকিস্তান ও ভারতের বিরোধের একটা বড় কারণ - ভিউপয়েন্ট ডটনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৫ জুলাই ২০২০, ১৯:২৩

কাশ্মীরের বিতর্কিত হিমালয় অঞ্চলে চীন ও ভারতের সেনাবাহিনী দীর্ঘদিন থেকে মুখোমুখি অবস্থান করছে। এমনিতেই ভূ-রাজনীতির ইন্দো-প্যাসিফিক রঙ্গমঞ্চের দুই প্রধান নট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে অনেক দিন ধরে স্নায়ুযুদ্ধ চলে আসছে, তার ওপর সীমান্ত অঞ্চলে চীন ও ভারতের এই মুখোমুখি অবস্থান দক্ষিণ এশিয়াকে পরিণত করেছে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সবচাইতে বিপজ্জনক হটস্পটে।

লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা ভারতশাসিত কাশ্মীরের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও ওই এলাকাকে চীন বরাবরই নিজের বলে দাবি করে। এখন সেখানে সেনা মোতায়েন করে চীন চাইছে পাক-ভারত বিরোধকে উস্কে দিতে, যার ফল হবে দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাত আরো জটিল রূপ নেবে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে কথিত এক জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবিরে বিমানহামলা চালায় ভারত। এরপর আগস্ট মাসে নিজ অধিকৃত কাশ্মীরকে অঙ্গীভূত করে নেয় দেশটি। এ দু'ঘটনা পাকিস্তান ও ভারতের সম্পর্ককে তিক্ততম পর্যায়ে নিয়ে যায়, ১৯৯৯ সালের এক সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের পর দু' দেশের সম্পর্ক আর কখনও এতোটা তিক্ত রূপ নেয়নি।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ভারতের বিমানহামলা এবং জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতভূক্তির ঘটনায় উভয় দেশ নিজ নিজ রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠায় এবং সব রকম দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ স্থগিত করে দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে পরস্পরের দূতাবাসের অর্ধেকের মতো কর্মীকে বহিষ্কার করে পাকিস্তান ও ভারত।

১৯৬২ সালের যুদ্ধে ভারতকে হারানোর পর চীন কখনও কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত বিরোধে নাক গলায়নি। এবার কাশ্মীরের উত্তপ্ত কড়াইয়ে চীনের পূনঃ প্রবেশে উপমহাদেশের পরমাণু শক্তিধর দেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কাই তীব্রতর হয়ে উঠলো বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এক বিশেষজ্ঞ বলেন, মনে হচ্ছে একটা যুদ্ধ লাগবেই। কিন্তু কাশ্মীর নিয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধ লাগিয়ে চীনের কী লাভ? তাদের তো ভারতের সাথে বোঝাপড়ার আরো অনেক বড় ইস্যু আছে। সীমান্তে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলএসি নির্ধারণই তো এখনও হয়নি। তাহলে কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। আসুন জেনে নেই

প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলএসি হচ্ছে চীন ও ভারতের চার হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ অচিহ্নিত ও বিতর্কিত সীমান্ত, যা পশ্চিমে লাদাখ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে শেষ হয়েছে ভূটানের ত্রিদেশীয় সীমান্তসঙ্গমে। ২০১৭ সালের গ্রীস্মে এখানেই তিন মাসব্যাপী মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছিল ভারত ও চীন।

১৯৪৯ সালেই কাশ্মীরে পাকিস্তানের সাথে ভারতের বিতর্কিত সীমান্ত চিহ্নিত করে দিয়েছিল জাতিসংঘ, যা নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলওসি নামে পরিচিত। এই এলওসি ও এলএসি-কে পৃথক করেছে কারাকোরাম পাস, যা গালওয়ান উপত্যকার ঠিক পশ্চিমে অবস্থিত। কারাকোরাম পাসের অপরদিকেই সিয়াচেন হিমবাহ। এটিও এলওসি-র সর্বউত্তরের একটি অচিহ্নিত পয়েন্ট। ১৯৮৪ সালে ভারত এটি দখল করে নেয়। সিয়াচেন হিমবাহ এখন বিশ্বের সর্বোচ্চ রণাঙ্গন হিসেবে কুখ্যাতি পেয়েছে।

১৯৯৯ সালে কারগিল দখল করে প্রতিশোধ নেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা চালায় পাকিস্তান। কারগিল কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা। এখান থেকে সিয়াচেনে কোনো সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করা হচ্ছে কি না, তার ওপর নজর রাখা যায়। আগে ভারতের দখলে ছিল, লাদাখের এমনসব এলাকা চীনের দখল করে নেয়ার পেছনে কাজ করেছে এমন উদ্দেশ্যই।

একজন মার্কিন বিশেষজ্ঞ বলেন, লাদাখ সমস্যাকে আমরা কাশ্মীর বিরোধ থেকে আলাদা করে দেখতে পারি না। এলএসি নিয়ে যতদিন উত্তেজনা থাকবে, এলওসি নিয়ে উত্তেজনাও ততোদিন থাকবে।

পাকিস্তান ও চীন কাশ্মীরে ভারতের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামবে, এমন কোনো লক্ষণ দেখা যায় না বলেই মনে করেন একজন পাকিস্তানি বিশেষজ্ঞ। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ওই বিশেষজ্ঞ বলেন, কাগজে-কলমে হিসাব করলে মনে হয়, ভারত দুই ফ্রন্টের একটি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতেও পারে। তবে পাকিস্তান ও চীন এ রকম কোনো যুদ্ধ চায় না এবং সে-রকম কোনো প্রস্তুতিও তাদের নেই।

পাকিস্তানের একজন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডনের কলাম লেখক টম হুসাইনকে বলেন, চীনের সাথে যোগ দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে দুই ফ্রন্টের যুদ্ধে জড়ানোর কোনো ইচ্ছা পাকিস্তানের নেই। কেননা, সে-রকম ক্ষেত্রে ওটি হয়ে যাবে তিন পরমাণু শক্তিধর দেশের লড়াই। ওই লড়াই কেবল তিন দেশের মধ্যে সীমিত থাকবে না, আমেরিকা এবং অন্যান্য বৃহৎ শক্তিগুলোও এতে জড়িয়ে পড়বে।

দ্য স্টকহোম ইন্টারন্যশনাল পীস রিসার্চ ইন্সটিটিউট গত ১৫ জুন প্রকাশিত তাদের ইয়ারবুকে বলেছে, বড় প্রতিদ্বন্দ্বীদের হুমকি মোকাবিলায় চীন, ভারত ও পাকিস্তান ক্রমাগত তাদের কৌশলগত অস্ত্রসরঞ্জামের আধুনিকায়ন করে চলেছে।
১৯৭৪ সালে ভারত প্রথম পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা চালায়। এর পর পাকিস্তানও আর বসে থাকে না। চীনের সাহায্য নিয়ে তারাও ১৯৮৯ সালে পরমাণু অস্ত্র ক্ষমতা অর্জন করে।

দ্য স্টকহোম ইন্টারন্যশনাল পীস রিসার্চ ইন্সটিটিউট বলছে, চীন তার পরমাণু অস্ত্র আধুনিকায়নের মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। তারা প্রথম বারের মতো একটি নিউক্লিয়ার ট্রিয়াড বানাচ্ছে। এতে থাকবে নতুন স্থল ও আকাশভিত্তিক মিসাইল এবং পরমাণু অস্ত্র বহনক্ষম যুদ্ধবিমান। পাশাপাশি ভারত এবং পাকিস্তানও ধীরে ধীরে তাদের পরমাণু অস্ত্রের আকার ও বহুমাত্রিক ক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে।

স্টকহোম পিস রিসার্চ ইন্সটিটিউটের ধারণা, চীনের হাতে ৩২০টি নিউক্লিয়ার ওয়্যারহেড রয়েছে। পাকিস্তান ও ভারতের হাতে আছে যথাক্রমে ১৬০ ও ১৫০টি। তবে একটি মার্কিন থিংকট্যাংক মনে করে, এসব অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা খুবই কম, বিশেষ করে কাশ্মীর নিয়ে কোনো যুদ্ধে।

পাক-ভারত-চীন বিরোধ শুধু হিমালয় অঞ্চলের অচিহ্নিত সীমান্ত নিয়েই নয়। মনে রাখা দরকার, এ এলাকাটিতে রয়েছে কয়েকটি হিমবাহ। এসব হিমবাহ সিন্ধু ওবং তার বিভিন্ন শাখা নদীর পানির উৎস। এ পানি দিয়েই চালু রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। এই সেচ প্রকল্পের ওপর নির্ভর করছে পাকিস্তান ও ভারতের ২৭০ মিলিয়ন মানুষের খাদ্য যোগান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে এসব হিমবাহের বরফ গলছে দ্রুত গতিতে। ২০৫০ সাল-পরবর্তী বছরগুলোতে এ গলন সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হবে। এর পরই কমে আসতে থাকবে পানির প্রবাহ।

পাকিস্তান ও ভারত - দু' দেশেই জনসংখ্যা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে প্রাকৃতিক সম্পদ ভাগাভাগির দাবি ও প্রতিযোগিতা। ১৯৬০এর দশকে বিশ্ব ব্যাংকের মধ্যস্থতায় পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সিন্ধু নদের পানি বণ্টন চুক্তি হয়। সময়ের পরিক্রমায় আজ উভয় পক্ষ থেকেই ওই চুক্তিকেই বলা হচ্ছে অন্যায্য ও সেকেলে। এ অবস্থায় বলা যায়, আগামী দিনগুলোতে পানি বণ্টনই হয়ে উঠবে পাকিস্তান ও ভারতের বিরোধের একটা বড় কারণ।

একদিকে ভারত, অন্যদিকে চীন-পাকিস্তানের গলায় গরায় দোস্তি। আড়াল থেকে দেখছে আমেরিকা। ইলাস্ট্রেশন : রাওয়াল ডটটিভি
একদিকে ভারত, অন্যদিকে চীন-পাকিস্তানের গলায় গরায় দোস্তি। আড়াল থেকে দেখছে আমেরিকা। ইলাস্ট্রেশন : রাওয়াল ডটটিভি

 

মজার ব্যাপার হলো, সিন্ধুর পানি নিয়ে পাক-ভারতের সম্ভাব্য বিরোধ শুধু দু' দেশের মাঝেই সীমিত থাকবে না, এতে অবশ্যম্ভাবীভাবেই চীনের অংশগ্রহণ থাকবে। কারণ, এ নদের উৎসস্থল তিব্বতে, যা চীনের নিয়ন্ত্রণে। তাছাড়া পাকিস্তানের পানি ব্যবস্থাপনায় চীন নানাভাবে জড়িয়ে পড়েছে। কাশ্মীরের ঝিলাম নদীতে ভারতের বাঁধ নির্মাণের জবাবে নদীর নিজ অংশে পাকিস্তান নিয়েছে তিনটি জলবিদ্যুত প্রকল্প। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ পেয়েছে চীনেরই কয়েকটি সরকারি কর্পোরেশন। গিলগিট-বালতিস্তান এলাকায় সিন্ধু নদের ওপরও তৃতীয় বড় বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে পাকিস্তান। আর এ কাজে তাদের সাথে আছে চীন।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, জম্মু-কাশ্মিরকে ভারতভূক্ত করাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করে সিন্ধুর পানি বণ্টন চুক্তি থেকে বের হয়ে আসতে পারে পাকিস্তান। তেমন কিছু ঘটলে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই! এমনিতেই চীনের উচ্চাভিলাষী রোড অ্যান্ড বেল্ট প্রকল্পসহ নানা বিষয়ে পাক-ভারত সম্পর্ক ধোঁয়াটে, এর মাঝে পানি নিয়ে বিরোধ ভবিষ্যতে যদি সামরিক সংঘাতের দিকেও ঠেলে দেয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এই বিরোধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য বড় দেশও যোগ দেয়, তাতেও কেউ অবাক হবে না। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলকে কেন্দ্র করে আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ আগুন জ্বলে উঠছে কি না, তা-ই বা কে বলবে!

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে