নেপালে ঝড় তোলা এক নারী কূটনীতিক

নেপালে ঝড় তোলা চীনা কূটনীতিক হু ইয়াংকি - হু ইয়ানলিন, গ্লোবাল টাইমস

  • আলফাজ আনাম
  • ১৪ জুলাই ২০২০, ১৯:০২

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নেপাল এখন এক আলোচিত দেশ। দীর্ঘদিন থেকে নেপালের আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ছিলো একচ্ছত্র। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেছে। নেপালে সক্রিয় হয়ে উঠেছে চীন। বিশেষ করে কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর থেকে এই সর্ম্পক বদলে যেতে থাকে। এই বদলে যাওয়া সর্ম্পকের পেছনে রয়েছে এক নারী কূটনীতিক। যিনি বাধা ধরা কূটনৈতিক নিয়মের বাইরে এসে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। আবার বহু নেপালির মন জয় করেছেন।

নেপাল- চীন সর্ম্পকের সাথে এখন ব্যপকভাবে আলোচনায় আছেন নেপালে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত হু ইয়াংকি। ২৪ বছর ধরে কূটনীতিক হিসাবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ছিলেন চীনের দক্ষিন এশিয়া বিভাগের গুরুত্বপূর্ন পদে। দায়িত্ব পালন করেছেন পাকিস্তানে। উর্দু ভাষার ওপর তার রয়েছে ভাল দক্ষতা ।

এক সন্তানের জননী হু ইয়াংকি ২০১৮ সাল থেকে নেপালে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। নেপালের রাজনৈতিক পরিমন্ডলে রয়েছে তার অবাধ যাতায়াত। ভারতের গনমাধ্যমের অভিযোগ, ভারত বিরোধী হিসাবে পরিচিত কে পি শর্মা ওলির সরকারকে টিকিয়ে রাখতে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়ছেন হু ইয়াংকি।

নেপালের ও ভারতের গণমাধ্যমে তার সর্ম্পকে যে খবর প্রকাশ হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে তিনি শুধু ওলি নয় সব পক্ষের সাথে ভালো যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। সকালে যদি ওলির সাথে বৈঠক করেন তো রাতে ডিনারে অংশ নেন প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবি ভান্ডারির সাথে। আবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপাল কিংবা ঝালনাথ খানাল কিংবা পুস্প কুমার দহল প্রচন্ডের সাথেও আছে ঘনিষ্ট যোগাযোগ।

রাজনীতির অন্দরে যোগাযোগর বাইরে নেপালে তিনি বহুল আলোচিত এক বিদেশিনী। যিনি নেপালকে তুলে ধরছেন বিশ্বের দরবারে। বিশেষ করে চীনের মানুষের কাছে। নেপালের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে তিনি নিয়মিত সফর করেন। সেখানে তোলা ছবি টুইটার, ফেসবুকে শেয়ার করেন। চীনা পর্যটকদের নেপাল ভ্রমনে তার আছে উৎসাহ ব্যঞ্জক তৎপরতা। এ ক্ষেত্রে তিনি অনেকটা প্রচার মডেলের ভুমিকা পালন করছেন। ফলে কূটনীতির ভাবগাম্ভীর্যের বাইরে তার এই কর্মকান্ড বহু নেপালির মনে দাগ কেটেছে।

নেপালের সাথে ভারতের যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তার পেছনে চীনা রাষ্ট্রদূতের বড় ভূমিকা দেখছে ভারতের বিশ্লেষকরা। ভারত-নেপাল সর্ম্পক নিয়ে যে কোনো খবর বা বিশ্লেষণে চলে আসছে হু ইয়াংকির নাম। এমনকি ভারতীয় গনমাধ্যমে সুন্দরী এই কূটনীতিকের বিরুদ্ধে আকার ইঙ্গিতে অশোভন ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যও করছে ভারতের গনমাধ্যম। ভারতের নেতিবাচক প্রচারনায় হু ইয়াংকি আরো বেশি মাত্রায় পৌঁছে যাচ্ছেন নেপালের সাধারণ মানুষের কাছে।

নেপালে এখন চীনের আর্থিক সহযোগিতায় বহু প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের গুরুত্বপর্ণ অংশীদার নেপাল। হু ইয়াংকি মাঝে মাঝে চলে যাচ্ছেন এসব প্রকল্প পরির্দশনে। দেখছেন কাজের অগ্রগতি। নেপালের পর্যটন শহর পোখারায় চীন একটি বিমান বন্দর নির্মাণ করছে। এসব খবর ও ছবি নেপালের সংবাদমাধ্যমে নিয়মিত প্রকাশ হচ্ছে। আবার হু নিজেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। আবার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা স্কুল পরিদর্শন করছেন। সেখানে মিশে যাচ্ছেন সাধারন মানুষের সাথে। লাখ লাখ নেপালি তরুন - তরুনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে ফলো করেন।

করোনা মহামারী মোকাবিলায় ভারত পাকিস্তান বা বাংলাদেশ যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন নেপালের অবস্থা তুলনামুলক ভালো। নেপালে করোনা মোকাবিলায় চীন নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। নেপালের সেনাবাহিনীর জন্য করোনা সুরক্ষাসামগ্রী দিয়েছে। এগুলো হস্তান্তর অনুষ্টানে সেনা প্রধান জেনারেল সূর্যথাপার সাথে উপস্থিত ছিলেন রাষ্টদূত হু ইয়াংকি। স্বাভাবিক আনুষ্টানিকতা হলেও ভারতের বিশ্লেষকরা একে দেখছেন নেপালের সেনাবাহিনীতে চীনা প্রভাবের অংশ হিসাবে।

তবে শুরু থেকেই করোনা মোকাবিলায় নেপালের পাশে দাঁড়িয়েছে চীন। আর এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রদূত যে গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নেপালে করোনা সংক্রমনের শুরুতেই হু ইয়াংকি নিজ প্রেসিডেন্ট সি জিন পিংয়ের সঙ্গে নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারির সরাসরি টেলিফোন সংলাপের ব্যবস্থা করেন। তাতে প্রেসিডেন্ট সি নেপালকে সব ধরনের সুরক্ষাসামগ্রী দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

ভারতের সাথে নেপালের সীমান্ত বিরোধ ও নতুন মানচিত্র প্রকাশ করার পর কাঠমান্ডুর সাথে দিল্লির দূরত্ব আরো বেড়েছে। নেপালের এই কঠোর অবস্থানকে হু ইয়াংকির আগ্রাসী কূটনীতির ফল বলে মনে করেন নয়াদিল্লির অনেক বিশ্লেষক। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি অভিযোগ করছেন তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চাইছে নয়াদিল্লি। দলের মধ্যে প্রথম সারির অনেক নেতা ওলির পদত্যাগ চেয়েছেন। অপরদিকে ভারতের গনমাধ্যমের খবর হচ্ছে ওলিকে ক্ষমতায় রাখতে নানা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হু ইয়াংকি।

কাঠমান্ডুর ওপর বেইজিংয়ের প্রভাব ধরে রাখতে ওলিকে ক্ষমতায় রাখা চীনের স্বার্থের জন্য সুবিধাজনক। কারন ওলির সময় চীনের সাথে নেপালের ঘনিষ্টতা বাড়তে থাকে। আর এর ভিত্তি তৈরি হয়েছে নেপাল নিয়ে ভারতের ভুল নীতির কারনে।

নেপালের ওপর চাপ প্রয়োগের জন্য ভারত বিভিন্ন সময় দেশটির ওপর অবরোধ আরোপ করেছে। ভারতপন্থী মাধেসি জনগোষ্টীকে বিশেষ সাংবিধানিক সুবিধা দেয়ার জন্য নেপালের ওপর ২০১৬ সালে ভারত অঘোষিত অবরোধ আরোপ করে। সে সময় জ্বালানী সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ায় নেপালের জনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সরকার মাধেসীদের কিছু দাবি দাওয়া মেনে নিতে বাধ্য হয়। নেপালের আভ্যন্তরিন রাজনীতি নিয়ে ভারতের এই চাপ প্রয়োগের নীতি দেশটির সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিরুপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। সে সময়ও ওলি ছিলেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী।

বেইজিংয়ের প্রভাব ধরে রাখতে ওলিকে ক্ষমতায় রাখা চীনের স্বার্থের জন্য সুবিধাজনক। ছবি : চায়না অ্যামবেসি ডটঅর্গ

 

এ সময় নেপালের নেতারা চীনের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর ওপর গুরুত্বটা আবারো নতুন করে উপলদ্ধি করে। বলা যায় ভারতপন্থী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে নেপালকে অনেক বেশি মাত্রায় চীনের দিকে ঠেলে দেয়া হয়। অবরোধ চলাকালেই নেপাল-তিব্বত সীমান্ত পথ মেরামত করে চীন থেকে জ্বালানী আমদানি শুরু করে নেপাল। ভারতের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে চীনের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর ব্যাপারে নেপালের ভেতর থেকে এক ধরনের জনমত তৈরি হয়। এর ধারাবাহিকতায় নেপালের সাথে চীনের কৌশলগত সর্ম্পক গড়ে উঠে।

নেপালের সাথে চীনের সুসর্ম্পক গড়ে উঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে ২০১৮ সালে রাষ্ট্রদূত হিসাবে যোগ দেন হু ইয়ংকি। বলা যায় তিনি চীন -নেপাল সর্ম্পক সাধারন মানুষের সাথে সর্ম্পকে রুপান্তর করেন। এরমধ্যে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেপাল সফর করেন। এরপর দু দেশের সর্ম্পক অন্যমাত্রায় পৌছে যায়।

২০১৯ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং নেপাল সফর করেন। এটি ছিলো ২২ বছর পর চীনের কোনো সরকার প্রধানের নেপাল সফর। স্বাভাবিকভাবে এই সফরটি ছিলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ন। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কাঠমান্ডুতে নেপালের নেতাদের সাথে নৈশভোজে বলেন আমরা নেপালকে ল্যান্ড লকড কান্ট্রি থেকে ল্যান্ড লিংক কান্ট্রিতে পরিনত করতে চাই।

শি জিনপিংয়ের সফরে যসব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তাতে দুদেশের মধ্যে সংযোগের দিকটি বেশি গুরুত্ব পায়। এরমধ্যে চীনের তিব্বত থেকে কাঠমান্ডু পর্যন্ত ৭০ কিলোমিটারের রেলপথ নির্মান। যা হিমালয় পাহাড়ের ভেতর দিয়ে তৈরি করা হবে। এছাড়া কাঠমান্ডু থেকে চীন সীমান্ত পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগের জন্য একটি টানেল নির্মান করা হবে। ইতোমধ্যে প্রকল্প দুটির সাম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের আওতায় এই রেল ও সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এই প্রকল্প হবে বেল্ট অ্যান্ড রোডের ব্যায়বহুল প্রকল্পগুলোর একটি। নেপালের নেতারা আশা করছেন চীনের সাথে সংযোগ স্থাপনের এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে দেশটির অর্থনীতি বদলে যাবে। বিশেষ করে পন্য আমদানির জন্য ভারতের ওপর যে নির্ভরশীলতা তা আর থাকবে না। এর ফলে নেপালের অর্থনীতিতে গতি সঞ্চারিত হবে।

বৃহত প্রতিবেশীর ওপর অবিশ্বাস আর হতাশার কারনে চীনমুখী নীতি গ্রহন করে নেপাল। পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে শুধু ভারত নয়, চীনের সাথে সর্ম্পক বাড়ানোর উদ্যেগ নেয় দেশটি। ভারতের বিশ্লেষকরা নেপালের পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তনকে দেখছেন ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে উত্তরের প্রতিবেশি চীনের দিকে ঝুকে পড়া হিসাবে। আসলে প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে সর্ম্পক রক্ষায় ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতার উদহারন হিসাবে দেখা হচ্ছে নেপালের চীনমুখী নীতিকে।

বৃহত প্রতিবেশীর ওপর অবিশ্বাস আর হতাশার কারনে নেপাল চীনমুখী নীতি গ্রহন করে। কিন্তু ভারত একে দেখছে চীনের প্রভাব বিস্তারের আগ্রাসী কৌশল হিসাবে। এ কারনে ভারতের গনমাধ্যমে সমালোচনা করা হচ্ছে রাষ্ট্রদূত হু ইয়াংকিকে। বাস্তবতা হচ্ছে বাস্তবতা হচ্ছে হু ইয়াংকিং নেপালে তার কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়েছেন। একদিকে তিনি নিজ দেশের স্বার্থ দেখছেন আবার নেপালের বহু মানুষের মন জয় করে ফেলেছেন।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে