মোদির চীনকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার বাস্তবতা কতটুকু

ভুল আশা করে বসে আছেন মোদি - ইন্টারনেট

  • মেহেদী হাসান
  • ০২ জুলাই ২০২০, ০০:২৫

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিনি লাদাখের গালওয়ান ঘটনার উপযুক্ত জবাব দেবেন। মোদির এ বক্তব্য ঘিরে তীর্যক সমালোচনা চলছে দেশে এবং দেশের বাইরে। বাস্তবে মোদির চীনকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা দেখছে না অনেক বিশ্লেষক। তাদের মতে নরেন্দ্র মাদির এ প্রতিশ্রুতি বড় ধরনের অনিশ্চয়তায় ঘেরা। অন্তত সামরিকভাবে এখন চীনকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার কোনো অবস্থায় নেই ভারত। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি সাবরিনা কাজী। আজ আমরা চীনের মোকাবিলায় ভারতের সামর্থ্যর নানা দিক নিয়ে আলোচনা করবো।

গালওয়ান ঘটনায় গোটা ভারতজুড়ে তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা বিরাজ করছে । মোদি সরকারের বিরুদ্ধে চলছে তীব্র সমালোচন। ক্ষুব্ধ জনতারে মনের আগুন নিভিয়ে শান্তির পরশ বোলানোর মত উপায় এ মুহুর্তে মোদির কাছে নেই। এমন কি লোক দেখানো কোনো পদক্ষেপ নেয়ারও অবস্থা নেই, যেমনটা বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানের বালাকোট অপারেশন নিয়ে। ফলে বিশ্লেষকদের মতে এ ঘটনা হজম করা ছাড়া আপাতত উপায় নেই ভারতের ।

অপর দিকে লাদাখের গালওয়ান ঘটনায় চীন-ভারত সম্পর্ক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। ভারতের অনেকের মতে এ ঘটনার পর দুই দেশের সম্পর্ক সহজে আর আগের অবস্থায় ফেরানো সম্ভব হবে না। গালওয়ান ঘটনার জের অনেক দিন অনেক ভাবে বিরাজ করবে দক্ষিন এশিয়ার রাজনীতিতে।

গালওয়ান ঘটনার জন্য কেউ কেউ মোদিকে দায়ী করার চেষ্টা করছেন। চীনের কৌশল ভারত সঠিকভাবে সঠিক সময়ে অনুধাবন করতে পারেনি। ভারতের ভুল হিসাব নিকাশের কারণে গালওয়ান ট্রাজেডির অবতারণা হয়েছে। এছাড়া ২০১৯ সালে মোদি সরকার কাশ্মিরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করে লাদাখকে কাশ্মির থেকে আলাদা করে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আনে। এ ঘটনারও পরিণতি হিসেবে কেউ কেউ দেখছেন গালওয়ান ট্রাজেডিকে। এমনকি তখন চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনও দখলের হুঙ্কার দেয় বিজেপি নেতৃবৃন্দ। চীন এ ঘটনায় তখন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াা প্রকাশ করে। তখন থেকেই চীন লাদাখ নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা করে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।

অনেকের অভিযোগ মোদি সরকার সারাক্ষণ লেগে আছে শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আর অবহেলা করেছে চীনের বিষয়। ভারতের ভিন্ন ধারার অনলাইন দি ওয়্যার এর এক প্রবন্ধে অশোক কে মেহতা লিখেছেন এটা এখন পরিষ্কার যে, বড় ধরনের ভুল পদক্ষেপের কারণে গালওয়ান ট্রাজেডির ঘটনা ঘটেছে।

মধ্য এপ্রিল জুড়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদন দেয়া হয় তাতে লাদাখজুড়ে চীনা সৈন্যদের অস্বাভাবিক উপস্থিতির কথা বলা হয়। যা কাকতালীয়ভাবে মিলে যায় চীনের পিপলস আর্মির গ্রীস্মকালীন মহড়ার সাথে। এরপর ভারত দৌলত বেগ ওল্ডি থেকে চুসুল পর্যন্ত গালওয়ান ঘিরে ট্যাঙ্ক, আর্টিলারিসহ ভারী অস্ত্র মোতায়েন করে । এছাড়া হট স্প্রিং এবং পাংগং এলাকায়ও ভারী অস্ত্র মোতায়েন করা হয়। ৫ মে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মি বা পিএলএ অনুপ্রবেশ করে এসব এলাকায় লাইন অব কন্ট্রোল জুড়ে। এরপর তারা গালওয়ান উপত্যাকা এবং হট স্প্রিংয়ে ছাউনি স্থাপন করে। এরপর পানগং এ ৯ মে তারা ছাউনি বসায়। এ ছাড়া দেড় হাজার মইল পুর্বে সিকিমের নিষ্পত্তিকৃত সীমান্তের নাকু লাতেও তারা সেনা ছাউনি স্থাপন করে।

১৫ মে ভারতীয় সেনা প্রধান জেনারেল এম এম নারাভানে এ অনুপ্রবেশের জন্য চীনা আর্মির স্থানীয় কমান্ডারকে দায়ী করেন। এ ঘটনার বৈশিষ্ট অনুধাবেন কিছু সময় নেয় আর্মির কর্মকর্তারা। তারা চীনা আর্মির কৌশল এখনো অনুধাবন করতে পারেনি । কারন এটি ডেপসাং, চুমার এবং ডোকলাম এর মত অনুপ্রবেশের ঘটনা নয়। ২ জুন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পরিষ্কারভাবে জানান, পূর্ব লাদাখের অভ্যন্তরে ব্যাপক সংখ্যক চীনা বাহিনী প্রবেশ করেছে।

৬ জুন দুই পক্ষের সেনা কর্মকর্তা বৈঠকের ফলাফলও ভুলভাবে দেখা হয়েছে । ৯ জুন ভারতীয় আর্মির একটি সূত্রের ফাঁস হওয়া তথ্যে বলা হয় উভয় পক্ষ সংঘাত বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। চীনা পক্ষ থেকে শুধুমাত্র বলা হয় পরিস্থিতি সমাধানের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। ১৩ জুন সেনা প্রধান জেনারেল নারাভানে দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমি পরিদর্শনের সময় সাংবাদিকদের জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে রয়েছে।

চীনা আর্মির পরিকল্পনায় ছিল গালওয়ানজুড়ে তাদের বহুমুখী অনুপ্রবেশ বজায় রাখা। আর এর উদ্দেশ্য হলো কৌশলগত ডারবুক-শিয়ক টু দৌলত বেগ ওল্ডি হাইওয়েতে বাধা সৃষ্টি করা। ভারতীয় সৈন্য নিহতের পরও চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা চলছে দুই পক্ষের বৈঠকের মাধ্যমে। তারা কিন্তু তাদের সৈন্য প্রত্যাহারের কথা তখনো বলেনি। অথচ ঘটনার আগে থেকেই ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে পরিস্থিতি শান্তকরন এবং সৈন্য প্রত্যাহার কার্যক্রম চলছে।

ভারতের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে গালওয়ান ভ্যালিতে ভারতের ইন্দো-তিব্বত বর্ডার পুলিশও ব্যর্থ হয়েছে সঠিক বার্তা দিতে। আর বর্ডার পুলিশের পরিবর্তে সেখানে ভারতীয় আর্মির দখলে রাখা উচিত ছিল। দ্য ওয়্যার এর প্রবন্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, গালওয়ানে ১৫ জুনের রাতে ট্রাজেডি ঘটেছে ভুল হিসাব নিকাশ, সঠিক পরিচালনা আর কৌশলের অভাবে। এর সাথে ছিলো তড়িত পাল্টা জবাবের প্রস্তুতি ও মেকানিজমের অভাব।

২০১৯ সালে কাশ্মিরের বিশেষ রাজ্যের মর্যাদা বাতিল করে ভারত। তখন লাদাখকে কাশ্মির থেকে আলাদা করে সরাসরি কেন্দ্রের শাসনে নেয় ভারত। এসময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ হুঙ্কার দেয় চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনও দখল করার। এ ঘটনা বড় রকমে ক্ষুব্ধ হয় চীন। ক্ষুব্ধ চীন এ ঘটনায় বিবৃতি জারি করে তখন। লাদাখকে ভারতের কেন্দ্রীয় শাসনের অধীন করাকে অগ্রহনযোগ্য হিসেবে অভিহিত করে। বিবৃতিতে বলা হয় একতরভাভাবে ভারতের অভ্যন্তরীণ আইন পরিবর্তন করে লাদাখের মর্যাদা পরিবর্তন করাকে চীনা টেরিটোরিয়াল সর্বভৌমত্বকে খাটো করা হয়েছে।

অনেক বিশ্লেষকের মতে লাদাখকে কাশ্মির থেকে আলাদা করে সরাসরি কেন্দ্রের অধীনে আনার যে তড়িঘড়ি আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ করেছে তারই ফলে সেখানে ট্রাজেডি ঘটনা ঘটেছে। লাদাখকে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আনার ঘটনা ভালোভাবে নেয়নি চীন। ভারতের এ পদক্ষেপ কৌশলগত কারণে চীনের বিপক্ষে যায়। তখন থেকেই চীন লাদাখ বিষয়ে আগের চেয়ে সতর্ক অবস্থান নেয় এবং বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অথচ ২০১০ সাল থেকে ভারত সেখানে কৌশলগত হাইওয়ে নির্মান করলেও চীন এতদিন ধরে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু এখন চীন কঠোর অবস্থান নিয়েছে।

গালওয়ান ট্রাজেডিতে এখনো প্রতিতোধ আর ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে ভারত। কিন্তু এ মুহুর্তে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপ গ্রহনের অবস্থায় নেই দেশটি। তবে ভবিষ্যতে হলেও এর প্রতিশোধ নেয়া সম্ভব বলে মনে করেন ভারতের অনেক বিশ্লেষক।

সামরিক অর্থনৈতিকসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দিক দিয়ে চীনের তুলনায় বর্তমানে অনেক অনেক পেছনে রয়েছে ভারত। তার ওপর দেশটিতে চলছে করোনার দুর্যোগ। ভারতের অনেকের পরামর্শ লাইন অব কন্ট্রোল জুড়ে বিতর্কিত এলাকা দখল করে সেখানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে।

দি ওয়্যারর প্রবন্ধে অভিযোগ করা হয়েছে পাকিস্তানের সাথে অব্যাহতভাবে লেগে থাকতে গিয়ে ভারত চীনের প্রতি অবহেলা করেছে। ভারতের সব সৈন্যকে শেখানো হচ্ছে তাদের এক নম্বর দুশমন হলো চীন। কিন্তু কোনো কারনে তাদের মনে সবসময় জাগিয়ে রাখা হচ্ছে পাকিস্তান প্রসঙ্গ ।

অনেকের মতে এর কারণ হলো মোদি সরকারের সস্তা রাজনীতি আর ফায়দা হাসিলের সস্তা উপায়। মোদী সরকারের নেতৃবৃন্দ সারাক্ষন শুধু পাকিস্তান জিকির আর পাকিস্তান বিরোধীতার সস্তা রাজনীতিতে লিপ্ত।

ভারতের গণমাধ্যমও নিরন্তর পড়ে আছে উরি আর বালাকোট নিয়ে। চীনা আর্মির মুখপাত্র পিএলএ ডেইলি এবং পিপপলস ডেইলি ১৬ জুনের গালওয়ান ঘটনার কোনো প্রতিবেদনই প্রকাশ করেনি। অপর দিকে শাসক দল চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র গেøাবাল টাইমস এ খবর খুবই সংক্ষিত আকারে প্রকাশ করেছে পেছনের পাতায়। আর রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা জিনহুয়া কেবল মাত্র প্রকাশ করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়েল একটি বিবৃতি। গালওয়ান ট্রাজেডি চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। উভয় দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সহসা আর আগের অবস্থায় ফিরবে না।

নরেন্দ্র চীনকে উপযুক্ত জবাব দেয়ার যে প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন তার আদৌ কোনো সম্ভবনা দেখছে না অনেকে। তবে সামরিকভাবে সম্ভব না হলেও অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিকভাবে এর জবাব দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। মোদি সরকার চীনের বিরুদ্ধে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয় তা এখন দেখার বিষয়।

ভুল আশা করে বসে আছেন মোদি

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে