করোনার চিকিৎসায় দিশেহারা ভারত

করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন নরেন্দ্র মোদি - ইন্টারনেট

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ১৩ মে ২০২০, ১০:৫৬

করোনা ভাইরাস, ছড়িয়েছে চীন থেকে। কীভাবে ছড়ালো, কেমন করে মানুষের শরীরে প্রবেশ করলো, এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতেই বিশ্বজুড়ে প্রলয় শুরু করে দিয়েছে নতুন এই ভাইরাস।

একদিকে প্রলয় । অন্যদিকে চলছে গবেষণা। দুটোই চলছে সমান্তরাল। কিন্তু কোনো গবেষণাই দিতে পারছে না প্রলয় থামানোর দাউয়াই। উন্নত কয়েকটি দেশ এর প্রতিষেধক আবিষ্কারের কথা জানিয়েছে। তারা বলছে প্রতিষেধকগুলোর পরীক্ষা চলছে। উৎরে গেলে ছাড়া হবে বাজারে।

কিন্তু ততদিন অপেক্ষা করতে রাজি নন অনেকেই। তারা নিজেদের মতো করে ওষুধ তৈরি করছেন। প্রয়োগ করছেন। এবং অন্যকেও ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। অনেকেই দাবি করছেন, বেশি করে অ্যালকোহল পান করলে ভাইরাসের মৃত্যু হয়। এই প্রচারে বিশ্বাস করে কয়েকটি দেশে অতিরিক্ত মদ খেয়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

ভারতে লকডাউনের মধ্যে মদের দোকান খুলে দেওয়ায় শুরু হয়েছে দেশজুড়ে উৎসব! এতে দেশটিতে থমকে যাওয়া অর্থনীতি অনেকাংশে চাঙ্গা হয়েছে বলে খবর প্রকাশ করেছে বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম।

মদের দোকান খুলে দেওয়ায় উপচেপড়া ভিড় সামলাতে দিল্লিতে খুঁচরা বিক্রির ওপর ৭০ শতাংশ করও আরোপ করা হয়েছে। তবুও সামলানো যাচ্ছে না পরিস্থিতি। মদের দোকানে লেগে যায় যুদ্ধাবস্থা। মদ কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়া লোকদের থামাতে লাঠিচার্জ করেছে পুলিশ।

মদ নিয়ে এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে মন্তব্য করতে হয়েছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতকেও। মদের পরোক্ষ বিক্রি বা হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা করা যায় কি না সে বিষয়টি বিবেচনায় নিতে পরামর্শ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

করোনা ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাতে ভিড় এড়িয়ে কীভাবে মদ বিক্রি করা যায়, রাজ্যগুলোকে সে উপায় বের করার পরামর্শ দিয়েছে আদালত। লকডাউন চলাকালীন সরাসরি মদ বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

এর প্রেক্ষিতে কয়েকটি রাজ্য হোমডেলিভারির ঘোষণাও দিয়েছে। একটি নির্ধারিত সময়ে মদ কেনার জন্য ওয়েবসাইটে ই-টোকেন ব্যবস্থাও চালু করা হয়েছে।

যারা নিয়মিত মদ কেনেন, তারা লকডাউনের সময় কিনছিলেন আড়ালে-আবডালে। এবার দোকান খুলে দেওয়ায় উৎসবমুখর পরিবেশে কিনছেন, বাড়িতে বসে অর্ডার করছেন। সেইসঙ্গে করোনার সংক্রমণ হালকা করার আশায় মদের অর্ডার দিচ্ছেন অনিয়মিতরাও।

করোনার চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত না হলেও ভারতে সামাজিক পর্যায়ে এ নিয়ে চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অনেকটা দিশেহারার মতোই নানাজন হাতড়ে বেড়াচ্ছেন নানা দিক। ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে কয়েকজন বিজেপি নেতা ঘোষণা দিয়েছিলেন, গো-মূত্রই পারে করোনা থেকে রক্ষা করতে।

কার্টুনটি করেছেন ইউসুফ মুন্না। প্রকাশ করেছে কার্টুনমিরর
কার্টুনটি করেছেন ইউসুফ মুন্না। প্রকাশ করেছে কার্টুনমিরর

এই ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গো-মূত্র খাওয়ার ভিডিও ভাইরাল হতে দেখা গেছে। কিছু ছবিতে দেখা গেছে, গোবরের ঢিবিতে শরীর ডুবিয়ে বাইরে মাথা বের করে রেখেছেন অনেকে। তাদের বিশ্বাস ছিলো, গো-মূত্র আর গোবরই পারে চীন দেশের এই ভাইরাস থেকে ভারতীয়দের রক্ষা করতে।

চীন থেকে উৎপত্তি হলেও ভারতে এর প্রাদুর্ভাব ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। ইউরোপ-আমেরিকা হয়ে ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে প্রবেশ করলো ভারতে। একের পর এক আক্রান্তর খবর আসতে শুরু করলো। ঘোষণা এলো লকডাউনের। সেইসঙ্গে খোঁজ চলতে থাকলো প্রতিষেধকের। গবেষণাগারে মন দিলেন চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা। একধাপ এগিয়ে মত প্রকাশ করতে থাকলেন অন্যরাও। গঙ্গার পানিতে করোনা রোগ সারে বলে দাবি করে বসলো গঙ্গা সাফাই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত একটি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থা। তারা এর একটি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দাখিল করলো সরকারের কাছে। প্রস্তাবটি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঠানো হয় পানিশক্তি মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে পাঠানো হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মেডিক্যাল রিসার্চ’ বা ‘আইসিএমআর’ এর কাছে। প্রতিষ্ঠানটি এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।

গঙ্গার পানির পর আলোচনায় আসে ‘কাধা’ নামের ভেষজ ওষুধ। এই ওষুধ সেবনের পরামর্শ দেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তুলসি পাতা, শুকনো আদা, দারুচিনি, গোল মরিচ ও কিশমিশসহ আরো কিছু উপাদান মিশিয়ে ওষুধটি তৈরি করা হয়।

নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, জনগণের উচিত বিশেষ এই ওষুধ ব্যবহারের ব্যাপারে সরকারের নির্দেশনা অনুসরণ করা।

করোনা রোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি ওষুধের অনুমোদনও দিয়েছে দেশটির কর্তৃপক্ষ। এর প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় হোমিওপ্যাথিক কাউন্সিল কিছু কিছু হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগ করে যাচ্ছে। কলকাতার দু’টি হোমিওপ্যাথিক মিেডক্যাল কলেজ করোনা রোগীদেরকে বিতরণ করছে ‘আর্সেনিকাম অ্যালবাম ৩০’।
‘ডি এন দে হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ’-এর অধ্যক্ষ ডা. শ্যামল কুমার মুখার্জি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, প্রায় এক লাখ ওষুধ বিলি করেছেন তারা।

করোনা মোকাবেলায় বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহারের নির্দেশিকা প্রকাশ করেছে আইসিএমআর। এতে বলা হয়েছে, এইচআইভি চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত লোপিনাভির নির্দিষ্ট ডোজের ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে। কোন মাত্রার আক্রান্তকে এই ওষুধ দেওয়া যাবে, সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ইবোলা চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ রেমডেসিভির প্রয়োগের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তাদের পরামর্শে রয়েছে আরো ডজনখানে ওষুধের নাম। এদের মধ্যে কোনোটি কুষ্ট রোগের চিকিৎসায় প্রয়োগ করা হয়। কোনোটি দিয়ে সোরিয়াসিস এর চিকিৎসা হয়। অর্থাইরাইটিস রোগে ব্যবহৃত টোসিলিজুমার, ডায়েরিয়ার ওষুদ লোপারমাইড, অ্যালকোহলে আসক্তদের স্বাভাবিক করার জন্য ব্যবহৃদ ডিসালফিরাম ওষুধও বাদ যায়নি তাদের পরামর্শ থেকে। তবে কোনো ওষুধকেই চ’ড়ান্ত কার্যকর বলে ঘোষণা দেয়নি প্রতিষ্ঠানটি।

সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত এই প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ ছাড়াও ভারতের আনাচে-কানাচে চলছে নিজেদের মতো করে দাউয়াই। কেউ কেউ প্রচার করছেন বেশি বেশি চা খেলে করোনা ভাইরাস ভালো হয়ে যায়। প্রকোপের প্রথম দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চা-এর সুফল নিয়ে অনেক পোস্ট দেখা গেছে। পোস্টগুলোতে দাবি করা হয়েছৈ চীনের চিকিৎসক লি ওয়েনিলিয়াং মানুষকে উপদেশ দিয়েছেন বেশি করে চা খেতে। লি ওয়েনিলিয়াং চীনের উহান শহরের সেই চিকিৎসক, যিনি ভাইরাসটির ব্যাপারে প্রথম সতর্ক করেছিলেন। পরে এই ভাইরাসের আক্রমণেই তার মৃত্যু হয়।

ভারতীয় অনেকেই দাবি করেন, এই চিকিৎসক সবাইকে ঘন ঘন চা খাওয়ার উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি চায়ের মধ্যে ভাইরাসের প্রভাব কমানোর মতো উপাদান পেয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি করা হয়, চীনে করোনায় আক্রান্ত রোগীদেরকে তিনবেলা চা খেতে দেওয়া হতো।

উহানের চিকিৎসক লি যে এই পরামর্শ দিয়ে গেছেন, এর পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। লি ভাইরাসের বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। তিনি ছিলেন চক্ষু বিশেষজ্ঞ। এছাড়াও চীনে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চা খেতে দিয়েও চিকিৎসা করা হয়নি।

হোমিওপ্যাথির মতো আয়ুর্বেদ চিকিৎসার প্রতিও জোর দিয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেইসঙ্গে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যোগ ব্যায়ামের কিছু অনুশীলনেরও।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণলয়ের জারি করা একটি বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র করোনা প্রতিরোধই নয়, করোনা পজেটিভ রোগীর চিকিৎসায়ও আয়ুর্বেদ, যোগ, ইউনানি, হোমিওপ্যাথি পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে।

এর পর থেকে এই শাখাগুলোর চিকিৎসকরা লেগে গেছেন করোনায় আক্রান্ত রোগীদের সেবায়। পশ্চিমবঙ্গের আর্য়ুবেদ চিকিৎসক পুলক কান্তি কর কলকতাতার প্রভাবশালী পত্রিকা আনন্দবাজারকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সরকারের এমন নির্দেশিকা প্রকাশের পর আর্য়ুবেদ মতে কোভিড-১৯ চিকিৎসায় আর কোনও বাধা রইলো না। আমাদের আশা, রাজ্য আমাদের করোনা চিকিৎসায় যুক্ত করবে। গবেষণার নতুন দরজা খুলে দেবে।’

ভারতের এইসব পদক্ষেপকে সমালোচকরা দেখছেন ভিন্নভাবে। তারা মনে করছেন, ধর্মীয় আবেগকে গুরুত্ব দিয়ে কোনো একটি কার্যকর দাউয়াই খুঁজতে মরিয়ে হয়ে উঠেছে দেশটির সরকার। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় রীতির মাহাত্ম তুলে ধরতে চাইছেন তারা। এর সুযোগে নতুন করে জেগে উঠেছে পুরনো কিছু কু-সংস্কারও।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে