ভারতীয় মিডিয়া কার স্বার্থ দেখে

কার্টুনটি করেছেন সুরেন্দ্র - দ্য হিন্দুসেন্টার

  • মেহেদী হাসান
  • ০৮ মে ২০২০, ১৬:৩৫

পক্ষপাতমূলক আর বিতর্কিত ভূমিকার জন্য অনেক দিন ধরে ভারতের কিছু গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে তীব্র সমালোচনা চলছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো গণমাধ্যমের বড় একটি অংশ সরকারের সব ধরনের কর্মকান্ডকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের ব্যর্থতা তারা আড়াল করছে। মিডিয়া পালন করছে বিজেপি সরকারের মুখপত্রের ভূমিকা। বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, আল জাজিরায় অনেক বিশ্লেষণ প্রকাশ হয়েছে। এশিয়া টাইমসের একটি প্রতিবেদনের ভিত্তিতে আমরা আজ ভারতের গণমাধ্যমের ভুমিকা তুলে ধরবো।

অনেক বিশ্লেষক বিজেপি সরকারের প্রতি ভারতীয় মিডিয়ার অন্ধ সমর্থনকে চিয়ার লিডারের সাথে তুলনা করেছেন। এমনকি সরকারের বিভিন্ন ধরনের সাম্প্রদায়িক পদক্ষেপের প্রতি সমর্থনের মাধ্যমে মিডিয়াও সাম্প্রদায়িক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ভারতের গণমাধ্যম স্বাধীন নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করছে না। ভারতের গণমাধ্যমের বর্তমান ভূমিকা নিয়ে খ্যাতিমান বিশ্লেষক ভিম ভুরটেলের একটি প্রবন্ধ প্রকাশ হয়েছে এশিয়া টাইমসে। সেখানে তিনি বলছেন, ভারতের করপোরেট মিডিয়া বিশেষ করে টেলিভিশন নিউজ চ্যানেলগুলো গনতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।

যে গণমাধ্যম গণতন্ত্র আর জনস্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার আর পাহারাদারের ভূমিকা পালন করার কথা সেই গণমাধ্যমই এখন গণতন্ত্রের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে। এটাই হলো এখনকার নির্মম বাস্তবতা এবং তিক্ত সত্য। বাস্তবে ভারতের গণমাধ্যম এখন মোদি সরকারের সাম্প্রদায়িক কর্মসূচীর প্রতি প্রধান সমর্থকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

সংখ্যালঘু বিরোধী, বাম বিরোধী, মানবাধিকার বিরোধী, ভিন্নমত বিরোধী এবং বিরোধী দলের বিরুদ্ধে সব সময় সবার আগে সর্বশক্তি নিয়ে বাজনা বাজানোর ভ‚মিকায় নামে এ মিডিয়া। তারা অব্যাহতভাবে মোদির ব্যর্থতা, দুর্বলতা এবং ভুলভ্রান্তি আড়াল করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভিমের মতে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় বসার পর ভারতের মিডিয়া শাসকদল বিজেপির মুখপাত্রে পরিণত হয়েছে। যেটি সত্য তা হলো করপোরেট মিডিয়ার এলিটদের সাথে রয়েছে শাসক দলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ক্ষমতাশীন শাসকদল আর গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে সহজাত সম্পর্ক।

কার্টুনটি করেছে দেব তিয়াজি। প্রকাশ করেছে র‌্যাপিড লিকস ডটকম
কার্টুনটি করেছেন দেব তিয়াজি। প্রকাশ করেছে র‌্যাপিড লিকস ডটকম

 

ভারতের স্বাধীনতা যোদ্ধারা আর একটি ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্য, অসহিংস এবং সহনশীল জাতির আকাঙ্খা করেছিলেন। দীর্ঘ সময় ভারতে গনতন্ত্রের চর্চা হয়েছে। গনমাধ্যম গণতন্ত্র প্রতিষ্টায় ভূমিকা রেখেছে। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক চর্চা নির্ভর করে মুক্ত, স্বাধীন, নিরপেক্ষ এর ভয়হীন গণমাধ্যমের ওপর। আর ভারতের সংবিধানে এ লক্ষ্য পুরনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভারতের আজকের গণমাধ্যম তা থেকে বহু দূরে।

বাস্তবতা হচ্ছে মোদি সরকারের সব পদক্ষেপে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ভারতের মিডিয়া। যেমন বিশ্বে সবচেয়ে বড় গরুর গোশত রপ্তানিকারক দেশ হলো ভারত। আর বিশ্বে চামড়াভিত্তিক জুতা রপ্তানিকারক দেশের তালিকা ভারতের স্থান দ্বিতীয়। এ দুই রপ্তানি খাত থেকে বছরে ভারতের আয় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ দুই খাতে ২২ লাখ ভারতীয় জনবল নিযুক্ত রয়েছে। কিন্তু বিজেপি শাসিত ভারতের অনেক রাজ্যে নিষিদ্ধ করা হয়েছে গরুর গোশত। আর এতে বিপন্ন হয়েছে অনেকের জীবিকা ব্যবস্থা।

বিজেপি আর তাদের বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের গোরক্ষা বাহিনীর উসকানীতে ঘটেছে পিটিয়ে মানুষ হত্যার ঘটনা। গরু জবাই আর গরুর গোশত খাওয়ার কারণে ২০১৫ সাল থেকে অনেককে হত্যা করা হয়েছে। এই গোরক্ষা বাহিনী ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০০ জনকে হত্যা করেছে। কিন্তু ভারতের টিভি নিউজ চ্যানেলগুলো এ কারণে কখনো বিজেপি সরকারকে প্রশ্ন করেনি। উল্টো তারা দোষারোপ করেছে নিহত আর ভুক্তভোগীদের। তারা বলতে চেয়েছে তারা যদি গরুর গোশত না খেতো তাহলে তো তাদের হত্যা করা হতো না।

ভিম ভুরটেলের অভিযোগ, ভারতে সংখ্যালঘু মুসলমান এবং দলিত শ্রেণির ওপর পদ্ধতিগতভাবে নিপীড়ন চলছে। উচ্চবর্ণের হিন্দু কর্তৃক দলিতদের বিরুদ্ধে বৈষম্য, হয়রানি এমনকি হত্যার ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। কিন্তু ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমে এসব ঘটনা তেমন গুরুত্ব পায় না। এমনকি অনেক টিভি চ্যানেলে গোরক্ষা নিয়ে বিতর্কের সময় অতি উৎসাহী উপস্থাপকরা সংখ্যালঘু প্যানেলকে ধমকিয়ে বসিয়ে দিয়েছে। তাদের আখ্যায়িত করেছে বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে।

ভারতে বামপন্থীদের দমনে ২০১৬ সালে মোদি সরকার বেশ কয়েক দফা দমনমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফেডারেল সরকার ফান্ডে পরিচালিত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী শিক্ষার্থীদের দমনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। বামপন্থী শিক্ষার্থীদের দমনের কারন হলো তারা বাম রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করে। ২০১৬ সালে জওয়াহারলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রতিবাদ দমনের কথা উল্লেখ করা যায়। এসময় গ্রেফতার করা হয় ছাত্রনেতা কানাহায়া কুমারকে । তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহীতার অভিযোগ আনা হয়। সরকার, বিজেপি নেতৃবৃন্দ তাদের বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করে। ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলও তাদেরকে বিশ্বাস ঘাতক হিসেবে চিত্রিত করে এবং তারা ভারতের চির দুশমন পাকিস্তানের টাকায় পরিচালিত হচ্ছে মর্মে প্রচার চালায়।

একই কায়দায় অনেক ভারতীয় মিডিয়া মানবাধিকার বিরোধী পুলিশী নির্যাতন এবং অবৈধ হত্যার পক্ষে দাঁড়ায়। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের তারা জাতীয় হিরো হিসেবে চিহ্নিত করে। এর একটি উদহারন মেজর লিতুল যোগীর কর্মকান্ড। ২০১৭ সালের এপ্রিলে এই মেজর একটি মিলিটারি জিপের সামনের বাম্পারে কাশ্মিরী কে যুবককে বেধে গ্রামে ঘোরায়। তিনি তাকে ব্যবহার করেন মানবঢাল হিসেবে যাতে গাড়িতে বিক্ষোভকারীরা পাথর না ছুড়ে। এ সময় সেনাপ্রধান বিপিন রাওয়াত যোগীকে উদ্ধারে এগিয়ে আসেন এবং তার ব্যতিক্রমী এ ভূমিকার জন্য প্রশংসা করেন।

এ ঘটনায় ভারতীয় গণমাধ্যম পুরোপুরি নিরব ভূমিকা পালন করে। বিজেপি নেতা এবং অভিনেতা পরেশ রাওাল এক টুইট বার্তায় লিখেন, অরুন্ধতী রায়কেও একইভাবে আর্মি জিপে বাধা উচিত। আবার এবিপি নিউজে প্রশংসা করা হয় এ টুইট বার্তার।

২০১৬ সালে মোদি সরকার ১০০০ ও ৫০০ রুপির নোট বাতিল করে। এর উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় অর্থনীতিকে কালো টাকা মুক্ত করা। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্ত শুধু ভারতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেনি বরং লাখ লাখ ভারতীয়কে চাকরি হারাতে হয়েছে। ২০১৭ সালের ১ জুলাই সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে গুডস এন্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স বা জিএসটি চালু করা হয়। ভারতীয় মিডিয়া একে স্বাধীনতার পর ভারতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে অতিমূল্যায়ন করে।

কার্টুনটির শিরোনাম ‘ডোন্ট বি কনফিউজড, আইএম ইন্ডিয়ান মিডিয়া ... অ্যান্ড আইএম অন মাই ডিউটি...!’। এঁকেছেন ইউসুফ মুন্না। প্রকাশ করেছে কার্টুনমিরর ডটকম
কার্টুনটির শিরোনাম ‘ডোন্ট বি কনফিউজড, আইএম ইন্ডিয়ান মিডিয়া ... অ্যান্ড আইএম অন মাই ডিউটি...!’। এঁকেছেন ইউসুফ মুন্না। প্রকাশ করেছে কার্টুনমিরর ডটকম

 

২০১৮ সাল থেকে ভারতীয় অর্থনীতি ব্যাপকভাবে নিম্নমুখী হতে থাকে। বিশ্লেষকদের মতে এটি হয়েছে ব্যাংকনোট বাতিল আর জিএসটির কারনে। ভারতীয় মূল ধারার গণমাধ্যম ব্যাংক নোট বাতিল আর জিএসটি পদক্ষেপের ভয়ানক প্রভাবের বিষয় শুধু চেপেই যায়নি, প্রশংসা করেছে। এভাবে তারা বিভ্রান্ত করে ভারতীয় অনেক ভোটারদের। ২০১৯ সালের এপ্রিল এবং মে মাসের লোকসভা নির্বাচনের মোদির বিপুল বিজয়ের পেছনে মিডিয়ার সবচেয়ে বেশি সহায়ক ভূমিকা ছিলো।

মোদি সরকার জনসাধরনের সামনে নির্বাচনের আগে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু সে সব প্রতিশ্রুতি নিয়ে মিডিয়ার সামনে কোনো জবা দিহি করতে হয় না। বিরোধী দল যখন এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছে তখন তাদের কে ভিন্নভাবে চিত্রায়িত করেছে মিডিয়া। অথচ বিদেশ থেকে টাকা ফেরত আনা, অধিক ব্যয়ে ফ্রান্সের কাছ থেকে রাফালে যুদ্ধ বিমান ক্রয়ের ক্ষতি নিয়ে সমালোচনা করে বিরোধী দল। এর ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের নভেম্বর এবং ডিসেম্বরে নির্বাচনে ৫টি রাজ্যে পরাজিত হয় বিজেপি। পরে মোদি আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে যেতে বাধ্য হয়।

পুলওয়ামা হামলার পর ভারতীয় এয়ার ফোর্স পাকিস্তানের বালাকোটে সার্জিক্যাল হামলা চালায়। মোদিবিরোধীরা এ হামলার প্রমান চান। যারা এই হামলা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাদেরকে দেশবিরোধী, দেশের শত্রু এবং বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যায়িত করে। এমনকি রাফায়েল বিমান কেনা নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন তাদেরকেও একই ভাবে চিত্রিত করা হয়।

২০১৯ সালের নির্বাচনে জয়লাভের পর জম্মু এবং কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হলে বিরোধী দলসহ অনেক খ্যাতিমান ভারতীয় এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে। গতানুগতিকভাবে এসময়ও ভারতীয় টিভি নিউজ চ্যানেলগুলো তাদের পাকিস্তানপন্থী এবং ভারত বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে।

মোদি সরকার ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নাগরিকত্ব আইন জারি করে। ঘোষণা করে ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেন বা এনআরসি। সংখ্যালঘূদের দমনে এগুলোকে পদ্ধতিগত নিপীড়ন হিসেবে মনে করা হয়।

নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসির বিরুদ্ধে দেশে বিদেশে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় টিভি নিউজ চ্যানেল এদেরকে জাতি বিরোধী এবং পাকিস্তানের দোসর হিসেবে চিত্রিত করে।

মাত্র চার ঘণ্টা হাতে রেখে মোদি ২৪ মার্চ ঘোষণা করেন দেশব্যাপী লকডাউন। ওই দিন মধ্যরাত থেকে তা কার্যকর হয়। সমস্ত টিভি নিউজ চ্যানেল মোদীর এ আাকস্মিক ঘোষণায় সমর্থন প্রদান করে। লাখ লাখ শ্রমিক পায়ে হেটে বাড়ির পথে রওয়ানা দেয়। অনেক টিভি নিউজ চ্যানেল এসব দরিদ্র শ্রমিকদের করোনা ছড়ানো কারী হিসেবে অভিহিত করে।

করোনা ছড়ানোর জন্য মুসলমানদের দায়ী করার সমালোচনার জন্য পুলিশ সমন জারি করেছে সাংবাদিক সিদ্ধার্থ ভরদারঞ্জনের বিরুদ্ধে। অরুন্ধতী রায়ও মুসলমানদের দায়ী করার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। মোদি এ সমালোচকদের আখ্যায়িত করেছেন শহুরে নক্সালী হিসেবে। টেলিভিশন চ্যানেল তাদের অভিহিত করছে জাতির শত্রু হিসেবে। ভারতের খ্যাতিমান হিন্দি কবি সামপাত সারাল বলেন, ভারতের আজকের টিভি চ্যানেলগুলো যদি ১৯৪৭ সালে থাকতো তাহলে ভারত বৃটিশের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা পেতো না। এখন পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে, নরেন্দ্র মোদি যদি নিজেকে ভারতের অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন তাহলে ভারতের মিডিয়া তাকে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে স্বাগত জানাবে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন