বিশ্ব অর্থনীতির তান্ডবে কী হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে

ছবি - সংগৃহীত

  • সাকিব ফারহান
  • ১৩ এপ্রিল ২০২০, ২৩:০৭

করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর সাথে বিশ্ব অর্থনীতিতে তান্ডবলীলা চালাচ্ছে। অভূতপূর্ব এক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বৈশ্বিক শিল্পোৎপাদন খাত। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির রথী-মহারথী সব দেশেরই উৎপাদন খাত এখন পুরোপুরি ধরাশায়ী। ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে পুঁজি, মুদ্রা ও পণ্যবাজার। অর্থনৈতিক এ মহাদুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে নিজ নিজ দেশের আর্থিক খাত, ব্যবসা প্রতিষ্টান সর্বোপরি নিজ জনগণকে সুরক্ষা দিতে বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে নেয়া হয়েছে প্রনোদনামূলক নানা পদক্ষেপ। কিন্তু তা কতটা কাজে আসবে তা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারন এই দুর্যোগ কবে শেস হবে কেউ জানেনা। এরমধ্যে বিশ্বজুড়ে খাদ্য সংকটের আভাষ দেয়া হয়েছে।

করোনা ভাইরাসের কারনে ৮০টিরও বেশি দেশ এরই মধ্যে আংশিক বা পূর্ণভাবে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে। এসব দেশ আভ্যন্তরিনভাবে লকডাউনে রয়েছে। পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত চালু থাকলেও বিদেশীদের ঢুকতে দিতে চাচ্ছে না কোনো দেশই । বৈশ্বিক পর্যটন, শিল্পোৎপাদন, সেবা ও আর্থিক খাতকে পুরোপুরি তলানিতে এনে ফেলেছে নভেল করোনাভাইরাস। চলমান পরিস্থিতি পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের জন্য প্রতিটি দিনকে করে তুলেছে নরকসম। একই মাপের ধসের মধ্য দিয়ে গেছে এশীয় শেয়ারবাজারও। ধস নেমেছে জ্বালানি তেলের বাজারেও। অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক দুই বাজারে দাম নেমে এসেছে কয়েক বছরের সর্বনিম্নে, ব্যারেল প্রতি ২৫ ডলারে। একই দশা মুদ্রা বাজারেরও।

চলমান মন্দা কাটাতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো নানা অর্থনৈতিক প্রনোদান কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় মার্কিন সিনেটে দুই লক্ষ কোটি বা দুই ট্রিলিয়ন ডলারের অনুমোদন দিয়েছে। বিল পাস হয়েছে ।মহামারিতে চাকরি হারানো কর্মী ও ক্ষতিগ্রস্ত শিল্পকে সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার জন্য এই অর্থ ব্যয় করা হবে।
এরই মধ্যে মার্কিন অর্থনীতিকে বাঁচাতে ৮৫ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি প্যাকেজ বাস্তায়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু ৩০ হাজার কোটি ডলার দেয়া হবে এয়ারলাইনস খাত ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে। দুর্যোগকালীন ভাতা হিসেবে নগদ ও করছাড়ের আকারে ৫০ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা পাবে মার্কিন জনগণ। পরিকল্পনা সফলভাবে বাস্তবায়ন না করা গেলে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মহীনতার হার বেড়ে ২০ শতাংশে দাঁড়াবে বলে শঙ্কিত মার্কিন অর্থমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোও দেশটির নাগরিক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৮ হাজার ২০০ কোটি ডলারের প্যাকেজ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন।
বড় পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যুক্তরাজ্যও। দেশটির অর্থমন্ত্রী এরই মধ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ৩৩ হাজার কোটি পাউন্ড ঋণ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। সাড়ে ৪ হাজার কোটি ইউরোর সহায়তা প্যাকেজ হাতে নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে ইংলিশ চ্যানেলের ওপারের দেশ ফ্রান্সও।

পিছিয়ে নেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও। করোনাভাইরাস আক্রান্ত অর্থনীতিকে মন্দার হাত থেকে বাঁচাতে নীতি ও রাজস্ব সহায়তা নিয়ে নিজ জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে কাতার। এরই মধ্যে ঋণের কিস্তি পরিশোধ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করে দিয়েছে দেশটি। ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় খাতগুলোর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ডলার। এর মধ্যে ব্যক্তি খাত বরাদ্দ পেয়েছে ২ হাজার ৬০ কোটি ডলার। পুঁজিবাজারকে স্থিতিশীল রাখতে প্রনোদান দেয়া হয়েছে ২৭৫ কোটি ডলার। বিপুল পরিমান ভর্তুকি দিয়েছে সৌদি অরব।
কম-বেশি সব দেশই এখন রুগ্ন অর্থনীতিকে বাঁচাতে নানা পদক্ষেপ হাতে নিচ্ছে। তার পরও পরিস্থিতি কবে নাগাদ নিয়ন্ত্রণে আসবে, সে বিষয়ে সন্দিহান সবাই। আস্থা পাচ্ছেন না বিভিন্ন দেশের বিনিয়োগকারীরাও। বিশ্ববাজারের প্রতিদিনের চিত্র এখন বৈশ্বিক অর্থনীতির দুর্যোগ গ্রস্তততারই প্রতিফলন। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো পড়েছে সবচেয়ে ঝুকিতে

করোনা প্রার্দুভাবের আগে থেকেই নানামুখী সমস্যার মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৭৫ হাজার কোটি টাকার একটি প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। তার বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। প্রান্তিক পর্যায়ে এই প্যাকেজের সুবিধা পৌছে দেয়াও চ্যালেঞ্জ। তবে এই প্যাকেজ ঘোষণার পর আস্থা তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকের রফতানি এখন নিম্নমুখী। ঘাটতি কাটাতে পারছে না রাজস্ব খাত। খেলাপি ঋণের চাপ ও তারল্য সংকটের কারণে আর্থিক খাতের দশাও বেহাল। বিদেশী বিনিয়োগও আসছে না কাঙ্খিত হারে। কৃষি খাতে উৎপাদন বাড়লেও বিপণন ও কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতে দুর্বলতা আরো বাড়বে। করোনাভাইরাসের কারনে রেমিট্যান্সের বৃহত্তম উৎস মধ্যপ্রাচ্য নিয়েও তৈরি হয়েছে বড় ধরনের শঙ্কা। অনেক দেশ এখন শ্রমিকদের দেশে ফেরত পাঠাতে চাইছে।

আসলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে করোনার আঘাত এসেছে অনেক আগেই। পুরোপুরি স্থবির হয়ে গেছে দেশের শীর্ষ আমদানি, রফতানি ও রেমিট্যান্সের বাজারগুলো। প্রতিনিয়ত বাতিল হচ্ছে তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের রফতানি আদেশ। আগে থেকেই বিপর্যস্ত ছিল পুঁজিবাজার। করোনার অভিঘাতে ক্রমাগত রক্তক্ষরণের ধারাবাহিকতায় এখন তা নির্জীব হয়ে পড়েছে পুরোপুরি। দেশের ব্যাংকিং খাত এমনিতেই খেলাপি ঋণের ভারে বিপর্যস্ত । এখন করোনার ধাক্কায় অনেক শিল্প খাতই নতুন করে খেলাপির ঝুঁকিতে পড়বে।
অনেক অর্থনীতিবিদ বলছেন, বাংলাদেশের সক্ষমতা খুব সীমিত। অনেক উন্নত দেশও যেখানে হিমশিম খেয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের সমস্যা হওয়ারই কথা। তার পরও একটা চেষ্টা হচ্ছে পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। এ জন্য দরকার হবে সুষ্টু ব্যবস্থাপনার। আমদানি-রফতানির বাজার এরই মধ্যে ব্যাহত হয়েছে। এখন আভ্যন্তরিন বাজার নিয়ন্ত্রনে রাখা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। আভ্যন্তরিন বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থা যদি ঠিক রাখা না যায় তাহলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে হু হু করে। মাঠ পর্যায়ে পন্য থাকার পরও মানুষের হাতে পৌছেবে না। এর ফলে দেখা দিতে পারে নীরব দুর্ভিক্ষ।

কর্মসংস্থানের সংকট অবশ্য এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ব্যয় সংকোচনের জন্য ধুঁকতে থাকা প্রতিষ্টানগুলো কর্মী ছাঁটাইয়ের নীতি নিয়ে এগোচ্ছে। এর কারণে দুনিয়া জুড়ে চাকরি হারাচ্ছে লাখ লাখ মানুষ। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়তে শুরু করেছে।
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে বৈশ্বিক বাণিজ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়েছে। বৈশ্বিক মহামারী ঠিক কতদিন দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে, তা এখনো অনিশ্চিত। ফলে ভোক্তাদের মধ্যে বিরাজ করছে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ সংকটের আশঙ্কা। এ পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ভোক্তারা ঝুঁকেছেন অতিরিক্ত খাবার ক্রয়ে। অন্যদিকে মহামারীর মধ্যে জনগণকে সাশ্রয়ী মূল্যে খাবার সরবরাহের তাগিদে খাদ্যপণ্য রফতানি বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছে বিভিন্ন দেশ। একই পথে হাঁটছে এশিয়ার শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশগুলোও। ফলে এ অঞ্চল থেকে খাদ্যপণ্যটির রফতানি হুমকির মুখে পড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ ভিয়েতনাম। চাল রফতানিকারী দেশগুলোর বৈশ্বিক তালিকায় ভিয়েতনামের অবস্থান তৃতীয় শীর্ষ। প্রতিকুল পরিবেশের জেরে কয়েক বছর ধরে দেশটিতে চাল উৎপাদনে মন্দা চলছে। তার ওপর পড়েছে বৈশ্বিক মহামারীর প্রভাব। ফলে অভ্যন্তরীণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে দেশটি সম্প্রতি খাদ্যপণ্যটির নতুন রফতানি বিক্রয় চুক্তি সাময়িকভাবে বন্ধ রেখেছে। দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত চালের রফতানিতে নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন।

ভিয়েতনাম বাদেও চালের রফতানি সাময়িকভাবে বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ চাল রফতানিকারক দেশ কম্বোডিয়া। একই আভাস দিয়েছে মিয়ানমারও। অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলায় খাদ্যপণ্যটির রফতানি কমিয়ে দিতে পারে দেশটি।
অনেক দেশ আবার মনোনিবেশ করেছে বাড়তি আমদানির দিকে। ফিলিপাইন এশিয়ার অন্যতম শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ। তবে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে প্রতি বছর দেশটি আন্তর্জাতিক বাজার থেকে প্রচুর চাল আমদানি করে থাকে। নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপে খাদ্য সংকটের আশঙ্কায় দেশটি চালের আমদানি বাড়াতে পারে। অভ্যন্তরীণ খাদ্য নিরাপত্তায় ফিলিপাইন এরই মধ্যে ৬০ কোটি ডলার অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি তিন লাখ টন চাল ক্রয়ের পরিকল্পনা করেছে। ভিয়েতনামের শীর্ষ চাল রফতানির বাজার দেশটি।

চীনের অবস্থাও একই। চীন বিশ্বের শীর্ষ চাল উৎপাদনকারী দেশ। একই সঙ্গে দেশটি খাদ্যপণ্যটির শীর্ষ ভোক্তা দেশ। পর্যাপ্ত চাল উৎপাদন হওয়ায় অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে দেশটি খুব একটা চাল আমদানি করে না। রফতানিও করে কম। তবে নভেল করোনাভাইরাসের ধাক্কা সামলে বাজারে খাদ্যপণ্যটির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এ বছর দেশটি রেকর্ড চাল কিনতে পারে বলে আভাষ পায়া গেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে চাল রফতানি বন্ধের মতো পরিস্থিতি কি আদৌ তৈরি হয়েছে? বাস্তক পরিস্থিতি পুরো উল্টো। এ মুহূর্তে চালের আসলে কোনো সংকট নেই। বিশ্বের বৃহত্তম রফতানিকারী দেশ ভারতের গুদামগুলোতে পর্যাপ্ত চাল মজুদ রয়েছে। এছাড়া চলতি মৌসুমে দেশটিতে রেকর্ড চাল ও গম উৎপাদন হতে পারে। চাঙ্গা থাকতে পারে খাদ্যপণ্যটির বৈশ্বিক উৎপাদনও। মার্কিন কৃষি বিভাগ ইউএসডির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ মৌসুমে বিশ্বজুড়ে মোট ৫০ কোটি টন চাল উৎপাদিত হতে পারে। এ মৌসুমে কৃষিপণ্যটির বৈশ্বিক মজুদ বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১৮ কোটি টনে, যা এ যাবতকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ইন্দোনেশিয়া জানিয়েছে, এ মুহূর্তে দেশটির বাজারে পণ্যটির পর্যাপ্ত সরবরাহ রয়েছে।

যথেষ্ট মজুদ থাকার পরও রফতানি চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারনে আর্ন্তজাতিক বাজারে চালের দাম উর্ধ্বমুখি। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার একজন অর্থনীতিবিদ ডেভিড ডাউই মনে করেন স্বল্পমেয়াদে চালের দাম বাড়লেও তা খুব দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এমন পরিস্থিতিতে দেশগুলোকে আভ্যন্তরিন বাজার নিয়ন্ত্রনের দিকে নজর দিতে যাবে। বাংলাদেশে যথেষ্ট চালের মজুদ রয়েছে। সরবরাহ ও বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন রাখা সম্ভব হলে বাংলাদেশে খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা নেই।