লকডাউনে ভারতজুড়ে হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি

লকডাউনে ভারত-সংগৃহীত -

  • মেহেদী হাসান
  • ০৩ এপ্রিল ২০২০, ১১:১২

লকডাউনে গোটা ভারতজুড়ে হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। দেখা দিয়েছে ভয়াবহ এক মানবিক সঙ্কট। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ভারত। লকডাউনের কারনে মানবিক বিপর্যয়কে হিউম্যান ট্রাজেডি এবং হিউম্যানিটারিয়ান ক্রাইসিস হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যমে। করোনা ভাইরাস নয় বরং লকডাউনে বিপর্যস্ত ভারত এখন বিশ্বের বিভিন্ন গণামাধ্যমে উদ্বেগজনক খবর হিসেবে স্থান পাচ্ছে। 

ভারতে লকডাউন ঘোষনার পর থেকে লাখ লাখ শ্রমিক শহর ছেড়ে বের হয়ে পড়েছে। শত শত মাইল পায়ে হেটে বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছে তারা। কিন্তু শত শত মাইল পথ পাড়ি দিয়েও অনাহারী এসব মানুষের অনেককে নিজ গ্রামে প্রবেশ করতে পারছেন না। কারন তাদেরকে গ্রামে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে গ্রামের লোকজন। ম্যাস মাইগ্রেশন ঠেকাতে এক পর্যায়ে সরকার বন্ধ করে দেয় বিভিন্ন রাজ্যের সীমান্ত। ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত।
ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে রয়েছে লাখ লাখ শ্রমিক। এদের বড় অংশ আসে অন্য রাজ্য। বিভিন্ন রাজ্যের অর্থনীতির মেরুদন্ড এসব শ্রমিক। কিন্তু ২৪ মার্চ এক রাতের ঘোষনায় তারা এখন নিজ দেশে শরনার্থীতে পরিণত হয়েছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে ভারতে লকডাউনের কারনে সৃষ্ট ম্যাস মাইগ্রেশনকে ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের সময়কার মাইগ্রেশনের সাথে তুলনা করা হয়েছে। লাখ লাখ এসব শ্রমিকের হেটে বাড়ি ফেরার ঘটনা বিষয়ে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকায় হেডলাইন দেয়া হয়েছে ‘ইন্ডিয়া ইজ ওয়াকিং হোম’। মানে ভারত হাটছে বাড়ির পথে।
২৪ মার্চ রাতে লকডাউন ঘোষণা করা হয় ভারতে। ওই দিন রাত ১২টার পর থেকে কার্যকর করা হয় লকডাউন। লকডাউন ঘোষনার পর তা কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত সময় ছিলো মাত্র চার ঘন্টা । ভারতে রয়েছে ৪৭ কোটি শ্রমিক। লক ডাউন ঘোষনার সাথে সাথে গোটা ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যবসায় বানিজ্য ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ হয়। এক রাতে বেকার হয়ে পড়ে কোটি কোটি শ্রমিক। পাওনা পরিশোধ ছাড়া উধাও হয়ে যায় অনেক নিয়োগ কর্তা ও মালিক। অন্ধকার নেমে আসে অগণিত নি¤œ আয়ের মানষের জীবনে।

লকডাউনের কারনে বিভিন্ন রাজ্যে আটকা পড়ে লাখ লাখ শ্রমিক। মুহূর্তে অসহায় হয়ে পড়ে তারা। অসহায় এসব লাখ লাখ শ্রমিক সকাল হতেই শহর ছেড়ে বের হয়ে পড়ে । কারন সেখানে তাদের কোনো কাজ নেই। আয়ের কোনো পথ নেই। আর দীর্ঘদিন ভিন্ন রাজ্যে অবস্থানের মত টাকা পয়সা বা খাবার কোনটাই নেই তাদের কাছে। চিন্তিত হয়ে পড়ে তাদের ওপর নির্ভরশীল বাড়ির পরিবারের সদস্যদের নিয়ে।
দশেহারা এসব লাখ লাখ শ্রমিক রওয়ানা দেয় নিজ নিজ রাজ্যের গ্রামের উদ্দেশে। কিন্তু তাদের বাড়ি ফেরার নেই কোনো যানবাহন। বাধ্য হয়ে অনেক শ্রমিক পায়ে হেটে রওয়ানা দেয় বাড়ির পথে। এদের মধ্যে রয়েছে নারী শিশু। অনেক মা বাবার কোলে রয়েছে শিশু। এক মাইল দুই মাইল নয় শত শত মাইল এভাবে পাড়ি দিতে হচ্ছে তাদের। অনেকের কাছে নেই কোনো খাবার। তীব্র গরমে দিন রাত হাটছে অগণিত মানুষ। পথেই কাটাতে হচ্ছে রাত। পথেই কারো কারো ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। পায়ে হেটে বাড়ি ফেরার পথে ইতোমধ্যে ২০ জন শ্রমিক পথে মৃত্যু বরণ করেছে। ম্যাসমাইগ্রেশন নিয়ে সৃষ্টি হয় এক ট্রাজিক পরিস্থিতি।

গোটা বিশ্বের বড় বড় গণমাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে ভারতে লকডাউনের কারনে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় এবং এসব মানুষের দুর্দশার চিত্র। বৃটেনের গার্ডিয়ান পত্রিকার এ বিষয়ক সরেজমিন একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে দুর্ভোগের শিকার কয়েকজনের কথা।
মমতা তার স্বামী এবং চার সন্তান নিয়ে দিল্লীর গুরগাও থেকে রওয়ানা দিয়েছে নিজ রাজ্য উত্তর প্রদেশের সিদামানি গ্রামের উদ্দেশে। ১২৫ মাইল হাটতে হয়েছে তাদের। মমতার আট বছর বয়সী ছেলে সুমিত প্রতিবন্ধী। মমতা গার্ডিয়ানকে বলেন মনে হয়েছে রাস্তা শেষ হবে না। আমাদের সাথে কোনো টাকা নেই। আর নেই কোনো খাবার। ছেলে মেয়েরা রাস্তায় মাটিতে ঘুমিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়েছে। গোটা ভারতজুড়ে মমতার মত লাখ লাখ নারী পুরুষ আর অসহায় শিশু এভাবে ছুটছে এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে।

মমতা আর তার স্বামী গুরগাওয়ে একটি অটোমোবাইল কারখানায় কাজ করেন। কিন্তু লকডাউন ঘোষনার সাথে সাথে তাদের কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আর তাদের বেতনও দেয়া হয়নি। ফলে তাদের কাছে যেমন ছিল না বাড়ি ভাড়া তেমনি নেই খাবার কেনার টাকা। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় বাড়ি ফেরা ছাড়া তাদের আর কোনো পথ ছিল না। মমতা তার ৬ সদস্যের পরিবার নিয়ে ৫ দিন পায়ে হেটে বাড়ি ফিরতে সক্ষম হন। ৫ দিন পায়ে হাটার অভিজ্ঞতাকে জীবনের সবচেয়ে কষ্টের একটি অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করেন মমতা।

কিছু মুড়ি আর শূকনো রুটি সাথে নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দেন মমতা। মমতা জানান রাতেও তারা শিশু সন্তান সাথে নিয়ে হেটেছেন। পথে তারা খুব সামান্যই ঘুমিয়েছেন মাঝে মাঝে। তা না হলে ৫ দিনেও তারা বাড়ি ফিরতে পারতেন না। এমনকি তাদের সন্তানরা হয়তো পথে মারা যেত। সারা পথই তিনি তীব্র উৎকন্ঠায় ছিলেন হয়তো তার কোনো সন্তান পথেই মারা যেতে পারে।

ম্যাস মাইগ্রেশন ঠেকাতে ভারত বিভিন্ন রাজ্যের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়। পুলিশ বিভিন্ন হাইওয়ে থেকে গ্রেফতার শুরু করে যারা পায়ে হেটে বাড়ি ফিরছিল তাদের অনেককে। আবার ছোট ছোট শিশু সন্তানসহ শত শত মাইল পায়ে হেটে নিজ রাজ্যে ফেরার পরও অনেকে নিজ বাড়িতে পৌছতে পারেনি। কারণ বিভিন্ন স্থানে প্রবেশ পথে এসব লোকদের প্রবেশে বাধা দিচ্ছে এলাকার লোকজন। তাদের দাবি পরীক্ষা না করে তাদের গ্রামে ঢুকতে দেয়া হবে না। এ নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘাত।

অন্য রাজ্য থেকে যারা নিজ রাজ্যে ফিরেছে তাদের জন্য সরকার স্কুল এবং সরকারি ভবনকে কোয়ারেন্টিন কেন্দ্রে পরিণত করেছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই সংঘাত। ঝাড়খন্ড পালামু জেলার চক উদয়পরে সংঘাতে একজন নিহত হয়েছে।

অনেক গ্রামবাসী বলছে যারা বাইরে থেকে আবার গ্রামে আসছে তাদের মাধ্যমে পুরো গ্রামকে ঝূকির মধ্যে ফেলা যায় না। এ কারনে ভাইরাস পরীক্ষার দাবি তোলা হচ্ছে। ভারত ১৩৪ কোটি মানুষের দেশ। আয়তনেও ভারত অনেক বড় একটি দেশ। এত বড় আর এত বিপুল জনসংখ্যার একটি দেশে টানা ২১ দিন লকডাউন ঘোষণা একটি বিরল ঘটনা।

দেশটি পশ্চিমা বিশ্বের মত উন্নত নয়। দেশটিতে রয়েছে কোটি কোটি নি¤œ আয়ের মানুষ । সমগ্র ভারত জুড়ে রয়েছে অগণিত শ্রমিক যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করেন। প্রতিদিন ঘর থেকে বের না হলে তাদের পরিবার চলে না। লকডাউনের সাথে সাথে সীমাহীন ভোগান্তি আর করুণ ট্রাজেডি নেমে এসেছে এসব মানুষের জীবনে।

লকডাউন ঘোষনায় এমন পরিস্থিতির কথা অনেকেই আগে ভাবতে পারেননি। পরিস্থিতি অনেকটা চলে যায় নিয়ন্ত্রনের বাইরে। অসহায় দিশেহারা এসব মানুষ সামাল দিতে বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়েছে মারমুখী ভূমিকা। ভোগান্তির শিকার দিশাহীন আর নিরুপায় এসব মানুষকে নির্দয়ভাবে পেটানোর ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বে।

সব মিলিয়ে দিশেহারা এক অবস্থা। লকডাউনে থেমে গেছে গোটা ভারত। অর্থনীতিতে এর প্রভাব সুদুর প্রসারী, অনেক গভীরে। অনেকে চিন্তিত ভারতের ভবিষ্যত পরিস্থিতি নিয়ে। বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ২১ দিন লকডাউনের ক্ষতি আদৌ ভারতের পক্ষে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব কি না তা ভেবে অনেকের কপালে ভাঁজ পড়েছে।