সুপার পাওয়ার ভারত - স্বপ্ন ও বাস্তবতা

ভারতের পতাকা- সংগৃহীত

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১২:৩৬

আয়তনে বিশাল হলেও  অর্থনৈতিক ও সামরিক - কোনো দিক দিয়েই ভারত এখনও সুপার পাওয়ার হয়ে উঠতে পারেনি। তবে সুপার পাওয়ার হওয়ার স্বপ্ন তাদের আছে এবং দেশটির নেতারা প্রায়ই দেশবাসীকে সেই স্বপ্নের কথা বলে থাকেন। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি  ৫ ফেব্রুয়ারি এই স্বপ্নের কথা বলেছেন।

ভারতের লখনৌয়ে দেশটির একাদশ প্রতিরক্ষা প্রদর্শনী উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী মোদি সেই স্বপ্নের কথাই ফের উচ্চারণ করেন। তিনি বলেন, আগামী পাঁচ বছরে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানির লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা করার পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে ভারত। অস্ত্র নির্মাণ ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সামগ্রী তৈরির জন্য তামিলনাড়– ও উত্তরপ্রদেশে দু’টি হাব তৈরি করছে সরকার।

প্রদর্শনীতে উপস্থিত  বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, কামান, এয়ারক্র্যাফ্ট ক্যারিয়ার, যুদ্ধজাহাজ, সাবমেরিন, লাইট কমব্যাট এয়ারক্র্যাফ্ট, কমব্যাট হেলিকপ্টার এখন ভারতে তৈরি হচ্ছে। ২০১৪ সালে ভারত থেকে ২০০০ কোটি টাকার প্রতিরক্ষা সামগ্রী রফতানি হতো। গত দু’বছরে সেই অঙ্ক ১৭০০০ কেটি টাকায় পৌঁছেছে। আগামী পাঁচ বছরে ভারতের  প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রফতানির  লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

একটি বৃহদায়তন দেশের এমন স্বপ্ন থাকতেই পারে। দেশটির নেতাও দেশবাসীকে এমন স্বপ্ন দেখাতেই পারেন। প্রশ্ন হচ্ছে, এই স্বপ্নের সাথে বাস্তবতার মিল কতটুকু।  সেই প্রতিরক্ষা প্রদর্শনীর কথাই ধরা যাক। ভারতীয় পত্রপত্রিকা লিখেছে, প্রদর্শনীর পোস্টারে তুরস্কের তৈরি দুই আসনবিশিষ্ট একটি হেলিকপ্টারের ছবি ছিল। ছবির সেই কপ্টারটি পাকিস্তানি নৌবাহিনীর জন্য যৌথভাবে জন্য তৈরি করেছে অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ড ও তুরস্কের এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ। চিরবৈরী দেশের জন্য বানানো প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ছবি প্রদর্শনীতে! ভারতজুড়ে এ নিয়ে বয়ে গেছে ক্ষোভ ও হতাশার মৃদু ঢেউ।

নরেন্দ্র মোদির শাসনে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন মোটেও ভালো নয়, বরং বলা যায়, বেশ খারাপ। টাকার টানাটানিতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন কর্মসূচি। অস্ত্রশক্তিতে সুপার পাওয়ার হবে কী, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের নিয়মিত বেতন দেয়াই কষ্টকর হয়ে পড়েছে মোদি সরকারের। তাই বাধ্য হয়ে সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়ন কর্মসূচি কাটছাঁট করছে তারা।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা লক্ষ্য করেছেন, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীথারমন গত ১ ফেব্রূয়ারি সংসদে জাতীয় বাজেট পেশ করেন। তাঁর বাজেট বক্তৃতাটি ছিল ১৯৯১ সালের পর দ্বিতীয় দীর্ঘতম। মজার ব্যাপার হলো, বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতের জন্য বরাদ্দ কত, এত লম্বা বক্তৃতার কোথাও তিনি তার উল্লেখমাত্র করেননি।

কাগজে-কলমে এ বরাদ্দ আগের বছরের তুলনায় নামেমাত্র পাঁচ শতাংশ বাড়লেও মুদ্রাস্ফীতি যোগ করে দেখা যায়, আসলে তো বাড়েইনি, বরং কমেছে। এর মানে দাঁড়ালো, প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ আগের বছরের চাইতে কম।

প্রধানমন্ত্রী মোদি যত হাঁকডাকই করুন না কেন, তাঁর শাসনামলে প্রতিরক্ষা খাতে ভয়াবহ রকমের কম বরাদ্দ প্রদান একটা ট্র্যাডিশনেই পরিণত হয়েছে। গত বছর এ খাতে বরাদ্দ, শতকরা হিসেবে, নেমে আসে ১৯৬২ সালের স্তরে, যে বছর চীনের সাথে এক সীমান্ত যুদ্ধে করুণ পরাজয় বরণ করে ভারত।

তিন বছর আগে ভারতের সেনাবাহিনীর তৎকালীন উপ-প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল সরত চান্দ প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটিকে বলেছিলেন, অস্ত্র আধুনিকীকরণ চুক্তিগুলোতে ব্যয় করার মতো অর্থ এখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নেই। যে পরিমাণ অর্থ আছে তা দিয়ে নতুন কিছু অস্ত্রশস্ত্র কেনা যেতে পারে মাত্র।

ভারতের চলতি বছরের বাজেটেও একই অবস্থার প্রতিফলন দেখা যায়। এবারের বাজেটে তিন বাহিনী ও কোস্ট গার্ডের আধুনিকায়নের জন্য খুব কম অর্থই বরাদ্দ করা হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থের বেশিরভাগই ব্যয় হবে বেতন ও পেনশন খাতে। প্রতি বছর অনেক লোক অবসরে যাওয়ার কারণে পেনশন খাতে ব্যয়ও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। সশস্ত্র বাহিনীর জন্য এটা একটা দুঃসংবাদ বৈকি।

ভারতীয় বিমানবাহিনীর ছিল ৪৫টি কমব্যাট এয়ারক্রয়ফট স্কোয়াড্রন। এখন তা নেমে এসেছে ২৮টিতে। এসব বিমান ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্মিত। সেগুলো এখন পরিত্যক্ত। মানে হলো, যুদ্ধ করার জন্য যত বিমান দরকার, ভারতীয় বিমান বাহিনীর তা নেই। তাদের দরকার ৩০৬টি আধুনিক জঙ্গি বিমান। তার বদলে ২০১৬ সালের এক চুক্তি অনুসারে তারা পেতে যাচ্ছে ৩৬টি রাফায়েল জঙ্গি বিমান।

১০ বছর আগে ১২৬টি জঙ্গি বিমানের স্থলে জরুরি ভিত্তিতে নতুন বিমান কেনার কথা বলা হলেও অপেক্ষার পালা এখনও চলছে। পরীক্ষামূলক উড্ডয়ন শেষে নতুন জঙ্গি বিমান পছন্দ করা হয়েছে। আলাপ-আলোচনাও শেষ। কিন্তু কেনা যাচ্ছে না। কারণ, টাকা নেই। মার্কিন নেভাল ওয়ার কলেজের দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ ও পোস্ট ডক্টরাল ফেলো ফ্র্যাঙ্ক ও' ডোনেল  এ বিষয়ে 'এশিয়া টাইমস'কে বলেন,ভারতের এবারের বাজেট দেশটির বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তা-সহযোগীদের জন্য হতাশার কারণ হবে বলেই তাঁর বিশ্বাস। কেননা, প্রত্যেক বছর দেশকে শক্তিশালী করার জন্য যে ধরনের দামী সামরিক সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি আধুনিকায়ন প্রয়োজন, এ বাজেট সেই প্রয়োজন মেটানোর মতো নয়।

তাহলে ভারতের সেই স্বপ্নের কী হবে?  যে স্বপ্ন ভারত গত প্রায় তিন দশক ধরে দেখে আসছে যে এশিয়ায় তারা হবে একটি আঞ্চলিক শক্তি, এমনকি হয়ে যেতে পারে বিশ্বশক্তিও। এ ইচ্ছা পূরণ প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে একটি আধুনিক সামরিক বাহিনীর ওপর, কৌশলগত অভিলাষ পূরণে যাকে এ অঞ্চলে দ্রূত মোতায়েন করা যাবে। এ ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরে মেরিটাইম অপারেশনের জন্য সক্রিয় অংশীদার হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পেতে চায় ভারত।

ভারত-মার্কিন কৌশলগত সম্পর্কের একজন নিবিষ্ট পর্যবেক্ষক ও'ডোনেল উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের স্বল্প বরাদ্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোকে ভুল বার্তা দেবে। এটা ভারতের জন্য মঙ্গলজনক হবে না। কেননা, ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় ভারতকে প্রধান অংশীদার বলেই বিবেচনা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

ভারতের এবারের বাজেটটি এমন এক সময় পেশ করা হলো, যার মাত্র কয়েক সপ্তাহ পূর্বে দু'জন গুরুত্বপূর্ণ মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন যে ''যুক্তরাষ্ট্র এখন ইন্দো-প্যাসিফিক এলাকায় ভারতের অংশীদার, যা পূর্ব আফ্রিকার উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত।'' তাদের এ বক্তব্যই ইঙ্গিত দেয়, ভারতের সাথে রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা অংশীদারিত্বে মার্কিন আগ্রহ কতটা ব্যাপক।

ভারতের নৌবাহিনীও একই ধরনের টানাপোড়েনের মুখে পড়েছে। এর আছে একটিমাত্র বিমানবাহী জাহাজ - আইএনএস বিক্রমাদিত্য। দ্বিতীয় যে দেশীয় বিমানবাহী জাহাজটি ছিল, সেটি অচল হয়ে পড়ে আছে । এছাড়া নৌবাহিনীর আছে ১০টি সাবমেরিন। তবে সেগুলোও সেই আদ্যিকালের সোভিয়েত-নির্মিত এবং জার্মানির। ছয়টি ফরাশি স্করপিন সাবমেরিনের মাঝে পুরোপুরি চালু আছে মাত্র একটি। চীনের সেনাবাহিনীর সাথে পাল্লা দিতে হলে ভারতের দরকার আরো কমপক্ষে ২০টি সাবমেরিন।

এর বিপরীতে চীন বানিয়ে চলেছে বিমানবাহী জাহাজ। আর তাদের সাবমেরিনকে বিশ্বের সবচাইতে সুরক্ষিত বলা হয়। তাদের সাবমেরিনগুলোর অবস্থান নির্ণয় করা শত্রূর পক্ষে অসম্ভব। এর মানে দাঁড়ালো, ভারত ও তার কৌশলগত মিত্র যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার পক্ষেও চীনের নৌশক্তিকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা খুবই সীমিত।

ভারতের কৌশলগত স্বার্থ পূর্ব দিকে দক্ষিণ চীন সাগর থেকে শুরু করে পশ্চিমে আফ্রিকার শৃঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। এর অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ভারত মহাসাগরের পাশাপাশি দ্য ক্রূসিয়াল সী লাইন অব কমিউনিকেশন বা এসএলওসি।  যার মধ্য দিয়ে আসে ভারতের আমদানিকৃত অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বেশিরভাগ। এসব গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ সংরক্ষণ ভারতের নিজ স্বার্থেই প্রয়োজন।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ব্যবহার করে ইনসাস রাইফেল, যা ১৯৮০র দশকে উদ্ভাবিত। আজকের বিশ্বে এটা সবচাইতে কম ব্যবহৃত ছোট অস্ত্র। এছাড়া ভারতীয় সেনাবাহিনী  এখনো ব্যবহার করে চলেছে সোভিয়েত-নির্মিত টি-৭০ ও টি-৯০ ট্যাঙ্ক। তারা এখনো ব্যবহার করছে বোফর্সের আর্টিলারি গান, যা তারা ১০৮০র দশকে সুইডেনের কাছ থেকে কিনেছিল।

ভারত দেশটির অবস্থান চীন ও পাকিস্তানের মতো দুই প্রতাপশালী শত্রূ দেশের পাশে। অথচ চীন যখন তার সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়ন করে চলেছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্ষমতা তখন নিম্নমুখী।  এ নিম্নগামিতার বড় একটা কারণ হলো, গত বেশ কয়েক বছর ধরে  বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে কম বরাদ্দ। এধরনের কম বরাদ্দ পেয়ে একটি বাহিনী পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে টিকলেও টিকতে পারে, কিন্তু চীনের সাথে পাল্লা দিয়ে কিছুতেই পারবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অর্থনীতির যে বর্তমান হাল, তা সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তি হওয়ার ভারতীয় স্বপ্নের ওপর অশুভ ছায়া ফেলবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে মাত্র পাঁচ শতাংশ। এটা এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন। একটি শক্তিশালী অর্থনীতিই হচ্ছে শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষার ভিত্তি। অর্থনীতির এ অবস্থায় ভারত কী করে সুপার পাওয়ার হওয়ার আশা করতে পারে।