কেজরিওয়ালের জয়

অরবিন্দ কেজরিওয়াল- - সংগৃহীত

  • আসিফ মাহমুদ
  • ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৫:২৭

ভারতের রাজধানী দিল্লিতে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টি বা 'আপ' বিপুল ব্যবধানে বিজেপিকে হারিয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরেছে। এই নির্বাচনের ফলাফলকে দেখা হচ্ছে বিভাজনের বিপরীতে সৎ রাজনীতির একটি উদহারন হিসাবে। একই বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী রাজনীতির প্রতি দিল্লির মানুষের অবস্থান হিসাবে। এই নির্বাচন কী আসলে বিজেপির জন্য একটি সর্তক বার্তা।

মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে আম আদমি পার্টি দিল্লি বিধানসভার ৭০টি আসনের মধ্যে ৬২টিতে বিজয়ী হয়েছে। অন্যদিকে বিজেপি গতবার যেখানে মাত্র তিনটি আসন পেয়েছিল এবার সেখান থেকে তাদের অগ্রগতি খুবই সামান্য। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দিল্লিতে এবারের নির্বাচনকে বিজেপি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের দিকে ঠেলে দিতে চেয়েছিল। তবে তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। শহুরে ভোটাররা শেষ পর্যন্ত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ বা উন্নয়নকেই বেছে নিয়েছেন। মাত্র আট-নয় মাস আগের লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির সাতটি আসনের মধ্যে সাতটিই পেয়েছিলো বিজেপি। ফলে এই বিধানসভা নির্বাচনে আম আদমি পার্টি যে প্রায় ৯০ শতাংশ আসন জিতে নেবে তা বিজেপির কর্মী সমর্থকদের কাছে ছিলো অভাবনীয়।
দিল্লির শাহিনবাগে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মুসলিম নারীদের প্রতিবদা এবারের নির্বাচনে একটা বড় ইস্যু হয়ে উঠেছিল। রাস্তা আটকে শাহীনবাগ দিল্লিবাসীকে যে অসুবিধায় ফেলছে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের নানা চেষ্টা করেছে যোগী আদিত্যনাথসহ বিজেপির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। শাহীনবাগ যে ওখলা কেন্দ্রে অবস্থিত, সেখানে থেকে রেকর্ড ব্যবধানে জেতা আপের আমানাতুল্লা খান বিবিসিকে বলছেন, "এই ঘৃণা ছড়ানোর চেষ্টা আজ হেরে গেছে, জিতেছে উন্নয়ন। এটা তো বুঝতেই পারছেন, ওখলার হিন্দু ভাইরাও আমাকে ভোট না-দিলে আমি এত বড় মার্জিনে জিততেই পারতাম না। দিল্লির এবারের নির্বাচনে আম আদমি পার্টির হয়ে ৫ জন মুসলিম সদস্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তারা সবাই বিজয়ী হয়েছেন।

বিজপের ধর্মবাদী বিভাজনের রাজনীতি দলটির পরাজয়ের একমাত্র কারন নয়। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তার সাফল্য এবং ক্লিন ইমেজ এক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে। তিনি নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বেশ কিছু উন্নয়ন ও সেবামুলক কাজ করেছেন। এছড়া ব্যক্তি জীবনে তার সাদাসিধে জীবন যাপন ভোটারদের আকৃষ্ট করেছে।
দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে দিল্লির ক্ষমতা থেকে দূরে আছে বিজেপি। এবারের দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে দলটিকে এমন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়তে হচ্ছিল, যারা প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করেনি। কেজরিওয়ালের প্রচারনার মুল বিষয় ছিলো তার সময়ে সুশাসন প্রতিষ্টার চেষ্টা করা। পাড়ায় পাড়ায় সরকারি 'মহল্লা ক্লিনিক' চালু করেছেন কেজরিওয়াল। সরকারি স্কুলগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন। মেয়েদের বিনা ভাড়ায় বাসে যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তার সরকারের এসব কর্মকান্ড যে দিল্লির মানুষের মনে ছাপ ফেলতে পেরেছে, সেটা নির্বাচনি ফলাফলে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তবে প্রচারনার শুরু থেকেই বিজেপি কেজরিওয়ালের সুশাসনের দাবিকে মিথ্যা প্রমানের জন্য জোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা দারুণভাবে ব্যর্থ হয়। এরপর নরেন্দ্র মোদির দল বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন, কাশ্মীর পরিস্থিতি ও বড় পরিসরে নতুন মন্দির নির্মাণের ইস্যুতে ভোটের প্রচারনা শুরু করে। একই সঙ্গে তীব্র ঘৃণা ছড়াতে শুরু করেন দলটির সদস্যরা। কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে বিজেপি রাষ্ট্রদ্রোহীতার অবিযোগ করেন। শাহিনবাগে নারীদের আন্দোলন সমর্থন দিয়ে তিনি ভারত ভাগের চেষ্টা করছেন এমন অভিযোগ করা হয়। কিন্তু এ ধরনের প্রচারনা এএপি তথা কেজরিওয়ালের বিজয়রথ থামাতে সমর্থ হয়নি। এর মধ্য দিয়ে বিজেপির বিভাজনমূলক রাজনীতির প্রতি যে দেশটির বড় অংশের সমর্থন নেই তা প্রমান হলো।

বিজেপির এক সময়ের রাজনৈতিক সহযোগী শিবসেনা নেত্রী প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদীর বিবিসিকে বলেন " দিল্লির নির্বাচন এটাই প্রমান করে দিলো যে, বিজেপির চেয়ে ভালো বিকল্প থাকলে মানুষ তা বেছে নিতে দ্বিধা করবে না। লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির কোনও চ্যালেঞ্জার ছিল না। কিন্তু এখানে বিজেপির সামনে কেজরিওয়াল ছিলেন। শুধু শাহীনবাগে নজর দিয়ে তারা যে বিভাজনের রাজনীতি করতে চেয়েছিল মানুষ তা প্রত্যাখান করেছে। বিজেপি মুখপাত্র বিবেক রেড্ডি বিজেপির পরাজয়ের কারন হিসাবে বিবিসিকে বলেছেন, স্থানীয় পর্যায়ে কেজরিওয়ালের জুৎসই কোনও প্রতিদ্বন্দ্বি তুলে ধরতে পারেনি তার দল। এছাড়া আপ সরকার বিনামূল্যে পানি-বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগ নেওয়ায় লোকজন তাদের দিকেই ঝুঁকেছে। ফলে সেখানকার নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় ঘটেছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিযোগ খন্ডন করে বিজেপি মুখপাত্রের যুক্তি, "শাহিনবাগে যেভাবে ভারত ভাঙার কথা বলা হচ্ছিল তার প্রতিবাদ আমাদের করতেই হতো।"

দিল্লিতে বিজেপির এই পরাজয় আগামি দিনে ভারতের রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে চলছে নানা মুখী আলোচনা। ভোটের রাজনীতির খাতিরে বিজেপি নাগরিকত্ব আইনের মতো নানা ধরনের বিভাজনমুলক রাজনৈতিক কৌশল থেকে সরে আসবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তবে এই ফল যে বিজেপির জন্য সর্তক সংকেত সে ব্যাপারে সবাই একমত। অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও তার দলের বিপুল বিজয় ভারতে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে নিঃসন্দেহে বাড়তি মনোবল জোগাবে। এর আগে ঝাড়খন্ডে বিজেপির প্রার্থী পরাজিত হয়েছে। এতে বিরোধী দলগুলো আশার আলো দেখছে। অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে এর মধ্যেই অভিনন্দন জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিরোধী নেতারাও। পশ্চিমবঙ্গে এক সভায় মমতা বলেন, "এই তো আসার আগে দিল্লিতে আমাদের বন্ধু অরবিন্দকে ফোন করে বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে অজস্্র অভিনন্দন জানিয়ে এলাম। আমরা কিন্তু সব সময় একসঙ্গেই কাজ করি। ওদিকে বিজেপিকে দেখুন! পুরো সরকার নিয়ে, সব মেশিনারি নিয়ে, টাকার জোর নিয়ে, সব এজেন্সিকে সঙ্গে নিয়েও একেবারে ভোঁকাট্টা হয়ে গেছে। পুরো ভরাডুবি হয়েছে ওদের!"

কেজরিওয়ালের বিজয়ে মমতা যে শক্তি পাচ্ছেন তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। কারন বিজেপির নজর এখন পশ্চিম বাংলার দিকে। এই রাজ্যে বিজেপির ভোট ও আসন সংখ্যা বেড়েছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন বিজেপির উন্থানের বিপরীতে ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলো আরো শক্তিশালী হবে। আম আদমি পার্টির বিজয় তার ইঙ্গিত মাত্র। সর্বভারতীয় দল হিসাবে কংগ্রেস বিজেপিকে মোকাবিলার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। দিল্লির নির্বাচনে এর বড় প্রমান। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে ৭০ আসনের মধ্যে ৬৬টিতে প্রার্থী দিয়েছিল কংগ্রেস। তবে এর মধ্যে একটিতেও জয় পায়নি দলটি। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার কংগ্রেসকে শূন্য হাতে ফেরালো দিল্লি। শুধু তাই নয় নির্বাচনে দলটির মাত্র তিন জন প্রার্থী জামানত রক্ষা করতে পেরেছেন। জামানত জব্দ হয়েছে ৬২টি আসনে। দেখা যাচ্ছে বিজেপিকে মোকাবিলার ব্যাপারে কংগ্রেসর ওপর মানুষ আর আস্থা রাখতে পারছে না। বরং আঞ্চলিক দলগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা বাড়ছে। বিজেপির বিরুদ্ধে তারা বড় ধরনের প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। যেমন নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন না করার ব্যাপারে অনেকগুলো রাজ্যে প্রস্তাব পাস হয়েছে। বিজেপির বিভাজনের রাজনীতি মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক দলগুলোর দিকে মানুষ তাকিয়ে আছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন ভারতে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতির প্রতি সমর্থন কমছে এমন নয়। আসলে আম আদমি পার্টি বা অন্য অনেক আঞ্চলিক দল উন্নয়নের দিকে নজর দিয়েছে। এর ফলে সাধারন মানুষ তাদেরকে ভোট দিয়েছে।

দিল্লিতে আম আদমি পার্টির বিজয় নিয়ে দলটির একজন সমর্থক বলছেন "আসলে কাজ করলে যে ভোট মেলে, দিল্লি সেটা আবার প্রমান করে দিলো।" তার মতে আগামী টার্মেও পরিবহন, ২৪ ঘণ্টা পানি, বায়ু দূষণ কমানো এবং এবার উচ্চশিক্ষায় জোর দেওয়াটাই হবে দলের অগ্রাধিকার। জনকল্যাণমূলক নীতি ও কার্যকর শাসন ব্যবস্থার প্রতি সাধারন মানুষ সমর্থন দিয়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন বিজেপির হিন্দুত্ববাদি প্রচারনার বিরুদ্ধে ভারতের শিক্ষিত সমাজের বিরাট অংশ সোচ্চার হয়েছে। বিশেষ করে নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভারত জুড়ে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার প্রভাব আগামি নির্বাচনে পড়বে। বিজেপির জন্য তা মোটেই সুখকর হবে না। আগামি দিনে রাজ্য বিধান সভা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া অনেক কঠিন হবে।