ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক দ্বীপ

ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ - সংগৃহীত -

  • মেহেদী হাসান
  • ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৮:৫২

বর্তমানে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের অন্যতম কেন্দ্র সমুদ্র। বানিজ্য রুট, সমুদ্র সীমা, সমুদ্র সম্পদকে কেন্দ্র করে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াই চলছে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে। সমুদ্রকেন্দ্রিক আধিপত্যের লড়াইয়ে কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ছোট ছোট অনেক দ্বীপ আর দ্বীপপুঞ্জ। এরকম একটি দ্বীপ হলো ভারত মহাসাগরে অবস্থিত দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ।

দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপটি বৃটেনের নিয়ন্ত্রনে হলেও দ্বীপটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে লিজ দেয়া হয়েছে। এখানে রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটি সামরিক ঘাটি। চীন ও ভারতের মধ্যে ভারত মহাসহাগর ও বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক আধিপত্য লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এ দ্বীপ। এ ছাড়া আরো একটি কারনে এ দ্বীপ আলোচনা এসেছে তা হলো দ্বীপে বৃটিশ শাসন অবসান বিষয়ে জাতিসংঘের প্রস্তাব পাস ও আন্তর্জাতিক আদালতের একটি রুল।

দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ ভারত মহাসাগরের মাঝখানে অবস্থিত চাগোস দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ। ৬০টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত চাগোস দ্বীপপুঞ্জ। আর এর মধ্যে সবচেয় বড় হলো দিয়েগো গার্সিয়া। পর্তুগীজরা এ দ্বীপ আবিষ্কার করে এবং তারাই এ দ্বীপের নামকরণ করে। ১৭৯০ সালে ফরাসিরা এখানে প্রথমে বসতি স্থাপন করে।
১৮১৪ সালে নেপোলিয়ানিক যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে প্যারিস ট্রিটি অনুযায়ী ফ্রান্স এ দ্বীপ বৃটিশদের কাছে হস্তান্তর করে।

দিয়েগো গার্সিয়াসহ চাগোস দ্বীপপুঞ্জ এক সময় মরিশাসের অন্তর্ভুক্ত ছিল । মরিশাস ও চাগোস দ্বীপপুঞ্জ ছিল বৃটিশ কলোনীর একটি ইউনিট বা একজন গর্ভনরের অধীন। ১৯৬৫ সালে গঠিত হয় ‘বৃটিশ ইন্ডিয়ান ওশেন টেরিটরি’ । এসময় চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাস থেকে আলাদা হয়ে নতুন গঠিত বৃটিশ ইন্ডিয়ান ওশেন টেরিটরির অধীনে আসে এবং এখন অবধি যা অব্যাহত রয়েছে। অপর দিকে মরিশাস ১৯৬৮ সালে বৃটিশের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে মার্কিন সামরিক ঘাটি গড়ে তোলার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লিজ দেয় যুক্তরাজ্য। এর মেয়াদ ২০৩৬ সাল পর্যন্ত। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেখানে সামরিক ঘাটি গড়ে তোলে। এসময় বৃটিশরা দিয়েগো গার্সিয়ার অনেক অধিবাসীকে জোরপূর্বক মরিশাসে পাঠায়।

বৃটিশ ইন্ডিয়ান ওশেন টেরিটরির অধীনে এক হাজার ছোট ছোট দ্বীপ রয়েছে। এর মধ্যে কেবল মাত্র দিয়েগো গার্সিয়ায় ২০১৮ সাল পর্যন্ত লোকজনের বসতি ছিল। দিয়েগো গার্সিয়ার জনসংখ্যার প্রায় সবাই মার্কিন ও বৃটিশ সৈন্য এবং তাদের সহযোগী কনট্রাক্টর। ্উইকিপিডিয়ায় বলা হয়েছে সেখানে ৩ থেকে ৫ হাজার মানুষ রয়েছে।
দ্বীপটির আয়তন ১২ বর্গমাইল।

২০১৯ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের ইন্টারন্যশনাল কোর্ট অব জাস্টিস রায় দেয় বৃটেনকে অবশ্যই দিয়েগো গার্সিয়াসহ চাগোস দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। আদালতের রুলে বলা হয় ১৯৬৫ সালে এ দ্বীপপুঞ্জকে মরিশাস থেকে আলাদা করা ছিল বেআইনী। তবে আদালতের এ রুল মানতে আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ফলে এ রায় বৃটেনের পক্ষে যায় বলে মনে করা হচ্ছে।

২০১৯ সালের মে মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাসিস্টসের রুলের পক্ষে এক প্রস্তাব পাস করা হয়। প্রস্তাবে চাগোস দ্বীপপুঞ্জ থেকে বৃটেনের কর্তৃত্ব অবসানের দাবি জানানো হয়। একই সাথে বৃটেনকে মরিশাসের অধিবাসীদের পুনর্বাসনে সহায়তারও আহবান জানানো হয়।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে লিখিত বিবৃতিতে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্র বা বৃটেন কারোর তরফ থেকেই সেখানে সামরিক ঘাটি ব্যবহার বন্ধের কোনো পরিকল্পনা নেই। ২০১৬ সালে উভয় সরকার এ ঘাটির কৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করে । ২০৩৬ সালের আগে দ্বীপ লিজের চুক্তি থেকে ফিরে আসারও কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছে না।
আন্তর্জাতিক আদালতের রায় মানতে বৃটিশ সরকার বাধ্য না হলেও জাতিসংঘের এ প্রস্তাবে বৃ্েটন দ্বীপের আধিপত্য বজায় রাখা নিয়ে নৈতিকভাবে পরাস্ত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের প্রক্ষিতে তাদেরকে এখন এ দ্বীপ হয়তো এক প্রকার জোর করেই দখলে রাখতে হবে।

প্রশান্ত মহাসাগর এলাকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিমান ঘাটি রয়েছে। এটি হলো গুয়াম দ্বীপে। গুয়াম আর ভারত মহাসাগরের দিয়েগো গার্সিয়া এ দুটি ঘাটিই বর্তমানে কৌশলগত কারনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

গুয়াম দ্বীপে মোতায়েন করা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরমানু বোমা বহনে সক্ষম সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধ বিমান বি-২ বম্বার। আর দিয়েগো গার্সিয়া থেকে ইরাক অভিযানের সময়ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে বি-২ বম্বার। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ এ দ্বীপ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এর আগে আফগানিস্তানেও অভিযান পরিচালনা করে। আফ্রিকান পারমানবিক অস্ত্র মুক্ত জোন চুক্তির আওতাভুক্ত চাগোস দ্বীপপ্ঞ্জু। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য এই চুক্তি গ্রাহ্য করছে না। এ দ্বীপে পারমানবিক বোমা কখনো মজুদ করা হয়েছে কি না তা জানা যায় নি। খ্যাতিমান মার্কিন বুদ্ধিজীবী নোয়াম চমস্কি এবং পেটার স্যান্ড দাবি করেছেন আফ্রিকান পরমানু অস্ত্রমুক্ত চুক্তি পুরো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য অন্তরায়।

ভারত মহাসাগর আর বঙ্গোপসাগরে চীন-ভারতের আধিপত্য লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে এ দ্বীপ এখন আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কারন এ দ্বীপের কৌশলত অবস্থান। দিয়াগো গার্সিয়ায় মার্কিন ঘাটির কারনে চীন ভারত লড়াইয়ের মাঝে এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি পক্ষ হয়ে দাড়িয়ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে এখন শুধু একটি পক্ষ নয় বরং কলকাঠি নাড়ার অবস্থানে রয়েছে। পুরনো প্রবাদ অনুযায়ী ভূগোলই হলো নিয়তি । এই দ্বীপ নামে বৃটিশের হলেও এ দ্বীপে এখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মার্কিন সামরিক কর্তৃত্ব।

রোড আইল্যান্ডে অবস্থিত নেভল ওয়ার কলেজের প্রফেসর নৌ কৌশলবিদ মিলান ভেগনের মতে ‘ সামনে খোলা সমুদ্র থাকা ঘাটি বহুমুখী অপারেশনে ব্যবহার করা যায়।’ আর দিয়েগো গার্সিয়া হলো সেরকম একটি ঘাটি। অতীতে এখান থেকে পরিচালিত মার্কিন অপারেশন ডেজার্ট র্স্টম এবং অপারেশন ইরাক ফ্রিডমের সময় সেটি প্রমানিত হয়েছে। পশ্চিমে আরব সাগর তীরবর্তী গোটা মধ্যপ্রাচ্য আর পূর্বে দক্ষিন চীন সাগর এলাকা এ দ্বীপের অপারেশন পরিচালনার আওতায়।এ ছাড়া সম্প্রতি কাউন্টার টেরোরিজম এবং আফ্রিকা উপকুলে এন্টি-পাইরেসি অভিযান সফলভাবে পরিচালনা করা হয় এখান থেকে। ২০১৮ সালে দক্ষিন চীন সাগরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রিডম অব নেভিগেশন মিশনে এ দ্বীপ থেকে বি-৫২ বম্বার উডডয়ন করে।

দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপের অবস্থান আরেকটি কারনে গুরুত্বপূর্ণ। আর তা হলো এর বিচ্ছিন্ন অবস্থান। এটি ভারত থেকে ১ হাজার ৬শ মাইল দক্ষিনে। উত্তর আরব সাগর থেকে এ দ্বীপ সাড়ে তিন হাজার মাইল দূরে। উত্তর আরব সাগর এ দ্বীপ থেকে সম্ভাব্য অপারেশন ক্ষেত্রে। অপর দিকে দূরে অবস্থানের কারনে এ দ্বীপের ঘাটি শত্রুর আক্রমন থেকে অনেক নিরাপদ।

মাঝারি পাল্লার ব্যালিস্টক মিসাইল এবং ক্রুজ মিসাইল দিয়েও এই দ্বীপের নাগাল পাওয়া যাবে না। অপর দিকে শত্রু রণতরী এখানে পৌছতেও কয়েক দিন লেগে যাবে। এখানে পৌছতে লাগবে শক্তিশালী কৌশলগত বম্বার। এই যুদ্ধ বিমানেরও প্রয়োজনে হবে পুনজ্বালানি সংগ্রহের।

দ্বীপটিতে সরকার, রাজনীতি এবং সাধারণ মানুষ না থাকায় এখান থেকে অপারেশন পরিচালনা এক কথায় স্বর্গীয়। ২০০৩ সালে ইরাক অপারেশনের ক্ষেত্রে তুরস্ক সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ঘাটি ব্যবহার করতে দেয়নি। দ্বীপটিতে মার্কিন বিরোধী কোনো রকমের সন্ত্রাসী হামলারও কোনো আশঙ্কা নেই। এখান থেকে মার্কিন ঘাটিও সহসা সরানো যাচ্ছে না। কারন বৃটেন বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম সঙ্গী।

দূর ভবিষ্যতে মরিশাস যদি এ দ্বীপের কর্তৃত্ব পায়ও তবু পরিস্থিতি খুব বদল হবে না। মরিশাস হয়তো অর্থের বিনিময়ে এটিকে আবার লিজ দেবে। হতে পারে সেটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে অন্য কেউ। ঘাটি স্থাপনের সময় দিয়েগো গার্সিয়া থেকে জোর করে লোকজনকে মরিশাসে স্থানান্তর করার সময় মরিশাস তাতে বাধা দেয় এবং পুনর্বসানের জন্য অর্থের দাবি করে। বৃটেন তখন মরিশাসকে অর্থ দিয়েছিল উৎখাত হওয়া লোকজনকে মরিশাসে পুনর্বসানে।

প্রশান্ত মহাসাগরসহ ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তারে চীন সচেষ্ট রয়েছে। এ লক্ষ্যে সে ইতোমধ্যে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান এবং মিয়ানমারকে বেশ ভালভাবে পক্ষে রেখেছে। আরো লক্ষ্যনীয় মরিশাস ২০১৮ সালে চীনের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পে সাক্ষর করেছে। চাগোস দ্বীপে চীনের পদচারনার মানে হলো এ দ্বীপ তেল সমৃদ্ধ পারস্য উপসাগর আর চীনের মধ্যে যোগাযোগে একটি গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ। আর এ বানিজ্য রুটে চলাচলরত জাহাজের নিরাপত্তায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। ২০০৪ সালে মার্কিন নেভিতে নিয়োগে প্রলুব্ধ করার জন্য দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ সম্পর্কে একটি বিবরণ লেখা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে গোপনে থাকা দ্বীপ, রয়েছে বিনোদনের অপূর্ব আয়োজন, অপরুপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর বসবাসের চমৎকার পরিবেশ।