নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে ভারত

ভারতের পতাকা- সংগৃহীত -

  • আসিফ মাহমুদ
  • ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ১৩:১৪

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার হরনের পর কূটনৈতিকভাবে বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, তুরস্ক ও মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলো এই আইনের সমালোচনা করেছে। অপরদিকে প্রতিবেশি দেশ বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান এই আইনে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। ভারতের ভেতরে বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলো সরকারের সমালোচনা করে এই আইন বাস্তবায়ন না করার কথা বলছে।

ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বৈষম্যমুলক ও মানবাধিকারের পরিপন্থী বলে দীর্ঘদিন থেকে সমালোচনা হচ্ছে। ভারতের সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনে বাংলাদেশে, আফগানিস্তান ও পাকিস্তান থেকে ২০১৫ সালের আগে আগত অমুসলিম শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। নাগরিকদের রেজিস্ট্রেশনের নামে আসলে বিরাট সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্টীকে বিতাড়নের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এই আইনের পর নভেম্বর মাস থেকে ভারত জুড়ে বিক্ষোভ শুরু হয়। এর প্রভাব পড়ে আর্ন্তজাতিক সর্ম্পকের ওপর।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের সাথে নরেন্দ্র মোদির নির্ধারিত একটি বৈঠক বাতিল হয়ে যায়। এই বৈঠকের স্থান নির্ধারন করা হয়েছিলো আসামে। কিন্তু আসাম তখন ছিলো বিক্ষোভে উত্তাল। ফলে জাপানের প্রধানমন্ত্রী সফরটি বাতিল করেন। জার্মানীসহ ইউরোপীয় কয়েকটি দেশ ভারতের নাগরিকত্ব আইনে নাগরিক অধিকার হরনের অভিযোগ করেছে। নাগরিকত্ব আইন নিয়ে সমালোচনা করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। এর প্রতিক্রিয়ায় মালয়েশিয়া থেকে পামওয়েল আমদানি বন্ধ করেছে ভারত। কিন্তু মাহাথির তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি। ভারতকে এখন ইন্দোনেশিয়া থেকে পামওয়েল আমদানি করতে হচ্ছে। আর ইন্দোনেশিয়ার পামওয়েলের বাজার নিয়ন্ত্রন করে মালয়েশিয়ার কোম্পানিগুলো। ফলে মালয়েশিয়া কোনো চাপে পড়ছে এমন নয়।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য না করলেও মুসলিম বিদ্বেষী নীতি সমর্থন দেয়ার কোনো কারন নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ফলে আর্ন্তজাতিক অঙ্গনে এই ইস্যুতে বেশ খানিকটা একা হয়ে পড়ছে ভারত।

ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে প্রতিবেশি দেশগুলো মোটেও সন্তুষ্ট নয়। ভারতের সবচেয়ে মিত্র দেশ বাংলাদেশ। কিন্তু এই আইনের সবচেয়ে বাজে প্রভাব পড়তে পারে বাংলাদেশের ওপর। এ নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন মহল উদ্বিগ্ন। আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ভারতের একজন ভালো বন্ধু হিসাবে পরিচিত। তিনিও এই আইনের সমালোচনা করেছেন। প্রতিবেশি দেশ দুটিতে ভারতের অবস্থান দূর্বল হয়ে পড়ছে।

ভারতের নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের প্রয়োজন ছিল না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংযুক্ত আরব আমিরাতের সংবাদপত্র গালফ নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গালফ নিউজের সাথে সাক্ষাতকারে বলেছেন, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। তিনি বলেন, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা সিএএ নিয়ে ভারত সরকারের উদ্দেশ্য কী, তা বুঝতে পারছি না। কেন ভারত সরকার এটা করল। এটার প্রয়োজন ছিল না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতে পাড়ি দেয়া কেউ বাংলাদেশে ফিরে এসেছে, এমন ঘটনা ঘটেনি। তবে ভারতে তাদের অনেকে সমস্যার মধ্যে আছেন।’ তিনি আরও বলেন, তারপরও এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ সব সময়ই সিএএ এবং এনআরসিকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে আসছে।
‘ভারত সরকারও সব সময় তাদের পক্ষ থেকে বলে আসছে, এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ব্যক্তিগতভাবে গত বছরের অক্টোবর মাসে নয়াদিল্লি¬ সফরকালে আমাকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন।’ শেখ হাসিনার মতে, যেকোনো বৃহত্তর ক্ষেত্র বিবেচনায় বর্তমানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সর্বোচ্চ সুসম্পর্ক বজায় রয়েছে।

ভারতের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন দেশটির ঘনিষ্ঠ মিত্র আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই। তিনি আহ্বাজন জানিয়েছেন, দিল্লি যেন মুসলমানসহ সব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সমান দৃষ্টিতে দেখে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনও হিন্দুর ওপর নির্যাতন করিনি। আমাদের পুরো দেশটাই নিপীড়নের শিকার। আফগানিস্তানের তিনটি প্রধান ধর্মের মানুষ, মুসলমান, শিখ ও হিন্দুদের একইভাবে তা সহ্য করতে হয়েছে।’
নাগরিকত্ব বিল পেশের সময় পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই বারবার পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তানের তুলনা করেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে কাবুল কিছু না বললেও এ নিয়ে কারজাই-এর মন্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আফগান বীর আহমাদ শাহ আবদালির চরিত্র হরন করে একটি সিনেমা বানানোর কারনে এর আগে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে কাবুল।

অনেক ভারতীয় বিশ্লেষকের শঙ্কা প্রতিবেশি দেশগুলোতে বন্ধু হারাচ্ছে ভারত। ভারতের এক সময়ের ঘনিষ্ট্র মিত্র নেপাল চলে গেছে চীনের বলয়ে। ভুটানে বাড়ছে চীনের প্রভাব। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া চলছে। এরপর বদলে যাবে সেখানকারন চিত্র। বাংলাদেশও খুশী নয় ভারতের আচরনে।

কাশ্মির ও বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষায় মরিয়া ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের ভাবমূর্তি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য বেশ কিছু দিন ধরেই সক্রিয় দিল্লি। রাষ্ট্রদূতদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নেতৃত্বের কাছে ভারতের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে। কিন্তু কতটা কাজে লাগছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দিল্লি সফরের কথা রয়েছে। এরমধ্যে তিনি তিন দফা কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছেন।

সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনের সাইডলাইনে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডেনাল্ট ট্রাম্প। পরে পাকিস্তানি নেতাকে পাশে বসিয়ে সাংবাদিকদের সামনে এ ইস্যুতে নিজের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন ট্রাম্প।
সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জানান, কাশ্মির ইস্যুতে তিনি সাহায্য করতে চান। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি-র খবরে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগে আগ বাড়িয়ে কাশ্মির সমস্যা সমাধানের প্রস্তাব দেন ট্রাম্প।
২০১৯ সালের আগস্টে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে অঞ্চলটিকে দুই টুকরো করে দেয় ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার। রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নিয়ে পরিণত করা হয় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে। এ নিয়ে তীব্র আপত্তি জানায় পাকিস্তান। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সর্ম্পকের অবনতি ঘটে। কাশ্মিরের ওপর আরোপিত বিধিনিষেধ দ্রুত প্রত্যাহারে দিল্লির প্রতি আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের মানবিক বিপর্যয় নিয়ে জাতিসংঘে কথা বলেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান এবং মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ। ভারতকে কাশ্মিরের দখলদার শক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেন মাহাথির। তবে দিল্লি বরাবরই দাবি করে আসছে, কাশ্মির ইস্যু পুরোপুরি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ নিয়ে কারও মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই।

দিল্লি সফরের এক মাস আগে আবারো ট্রাম্প বললেন ‘আমরা কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কী চলছে সে সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আমরা যদি কোনও সাহায্য করতে পারি, তবে অবশ্যই সেটা করবো। আমরা পরিস্থিতির দিকে অত্যন্ত মনোযোগসহকারে লক্ষ রাখছি।’ এর আগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সাইডলাইনে ইমরান খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে কাশ্মির ইস্যুতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দেন ট্রাম্প। তিনি বলেন, পাকিস্তান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী চাইলে তিনি এ নিয়ে মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত, ইচ্ছুক এবং সক্ষম’।
ট্রাম্প বলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও তার ‘খুব ভালো সম্পর্ক’ রয়েছে। অতীতে কখনও তিনি মধ্যস্থতায় ব্যর্থ হননি এবং চাইলেই তিনি সাহায্য করবেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, পাকিস্তানের প্রতি আমার আস্থা রয়েছে। তবে হোয়াইট হাউসে আমার পূর্বসূরিদের দেশটির প্রতি এমন আস্থা ছিল না। কিন্তু তারা জানতো না, তারা কী করছিল। পাশে বসা ইমরান খানকে দেখিয়ে ট্রাম্প বলেন, এই ভদ্রলোককে আমি বিশ্বাস করি। নিউ ইয়র্কে আমার বহু পাকিস্তানি বন্ধু রয়েছে, যারা স্মার্ট এবং দুর্দান্ত মধ্যস্থতাকারী। দখলকৃত কাশ্মিরের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আপনি কি উদ্বিগ্ন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, অবশ্যই। আমি চাই সবার সঙ্গে ভালো আচরণ করা হোক।