সংশোধিত-নাগরিকত্ব-আইন-নিয়ে-ভারতে রহস্যজনকভাবে নীরব তিনজন

সুপারস্টার - আমীর খান, সালমান খান ও শাহরুখ খান। (সংগৃহীত) -

  • সুব্রত সুত্রধর
  • ২৫ জানুয়ারি ২০২০, ১৫:৩৯

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ভারতে এখন কী ঘটে চলেছে, তা আজ কারো অজানা নেই। প্রতিদিন ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হচ্ছে, গুলি চলছে, মানুষ মরছে। রাজনীতিক শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে একেবারে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই আইনটির প্রতিবাদে নেমে এসেছে রাজপথে। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে জানাচ্ছে প্রতিবাদ।

কিন্তু রহস্যজনকভাবে নীরব শুধু তিনজন। তারা হলেন মুম্বাই সিনেমাজগতের ''তিন খান'' নামে খ্যাত তিন সুপারস্টার - আমীর খান, সালমান খান ও শাহরুখ খান। ভারত যখন চরম অমানবিক ও বৈষম্যমূলক আইনটির বিরুদ্ধে সোচ্চার, তিন খান সাহেব তখন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। তাদের এ ভূমিকায় হতভম্ব অনেকেই। তাদের মতে, মানবতাবিরোধী আইন হিসেবে তো বটেই, এমনকি খান সাহেবদের আপন সম্প্রদায় অর্থাৎ মুসলিমবিরোধী আইন হিসেবেও এর প্রতিবাদ করা উচিত ছিল খান সাহেবদের। 

কিন্তু তারা তা করেননি। কেন করেননি বা করতে পারেননি, তার পেছনে আছে দীর্ঘ ইতিহাস। সে আলোচনায় পরে আসছি, তার আগে যা বলছিলাম। খান সাহেবদের অনাকাঙ্ক্ষিত নীরবতায় ক্রোধ চেপে রাখতে পারেননি একজন। তিনি চিত্রপরিচালক অনুভব সিনহা। ২০১১ সালে নিজের বানানো একটি চলচ্চিত্রে শাহ্রুখ খানকে নায়কও করেছিলেন তিনি। 

অনুভব সিনহা বলেন, এদের নীরবতা দেখে আমি সত্যিই আর রাগ চেপে রাখতে পারছি না। এরা কী ভাবছে? এদের মুখের একটি কথা মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে প্রভাবিত করে, তা কি তারা জানে না?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তার সরকার ও দলের কঠোর সমালোচক হিসেবে পরিচিত অনুভব সিনহা একেবারেই ভুল বলেননি। শুধু টুইটারেই শাহ্রুখ, সালমান ও আমীর খানের ফ্যান-সংখ্যা যথাক্রমে চার কোটি, তিন কোটি ৮০ লাখ ও আড়াই কোটি।

অনুভব সিনহা বলেন, তিন খান কী বললেন তাতে পরিস্থিতির যে ইতরবিশেষ হবে, তা নয়। আমি শুধু তাদের মুখ খুলতে বলছি। মুখ খোলা মানে আমাদের পক্ষে বলবেন, তাও বলছি না। ঠিক আছে, আমাদের বিপক্ষেই বলুন! 

কৌতুহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো, ভারতজুড়ে বিক্ষোভ হলেও চলচ্চিত্র নগরী মুম্বাইয়ে এর আঁচ লেগেছে সামান্যই। শুধু তিন খানই নন, মুম্বাই চলচ্চিত্রজগতের খুব কম মানুষই এ ইস্যুতে মুখ খুলেছেন, প্রতিবাদবিক্ষোভেও দেখা গেছে এ জগতের অল্প ক'জনকেই। অথচ বিস্ময়কর হলেও সত্য, যে মুম্বাইয়ের সিনেমা ভারতের শত কোটি মানুষকে বিনোদন দিয়ে থাকে, তা অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন মুসলিম অভিনেতা, পরিচালক ও কলাকুশলীরা।

বলিউডের নীরবতায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অভিনেত্রী কঙ্গনা রনৌত। কোনো রাখঢাক না-রেখেই তীব্র ঝাঁঝালো ভাষায় তিনি বলেছেন, সারা দেশ যখন প্রতিবাদে-বিক্ষোভে উত্তাল, তখন মুম্বাই চিত্রজগতের পুরুষরা ঘরে ঢুকে বসে আছে। ওরা সব কাপুরুষ!

তারপরও মুসলিমবিরোধী বৈষম্যমূলক এ আইনের প্রতিবাদে সোচ্চার নয় মুম্বাই চলচ্চিত্রজগত। এ ''না-হওয়া''র শেকড় বহু গভীরে প্রোথিত। অথচ যে মুম্বাইকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্রনগরী হলিউডের সাথে তুলনা করে ''বলিউড'' বলা হয়, সেই হলিউডের তারকারা প্রায়ই নানা রাজনৈতিক ইস্যুতে সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। কিন্তু তাদের কোনো অসুবিধা হয় না। আমেরিকায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সমালোচনাকারীকে শায়েস্তা করায় প্রশাসনকে ব্যবহার করতে পারেন না প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ভারতে সে ভয়টি পুরো মাত্রায় রয়েছে। ভারতে অনেক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মোদির পাশে দেখা যায় একঝাঁক চিত্রতারকাকে। এর প্রতিদান হিসেবে তারাও এমনকিছু ছবি বানিয়ে দেন, যা সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে কাজে  লাগে। এ বছরই এ রকম তিনটি ছবি নির্মিত হয়েছে, যেগুলোতে শীর্ষ অভিনেতাদের দেখা গেছে প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায়। এর একটি বায়োপিক। নাম - পিএম নরেন্দ্র মোদি।

এভাবে ভারতের চলচ্চিত্রজগতের অনেকেই সরকারতোষণ করে থাকে। যেমন, গত সপ্তাহেই অভিনেত্রী সায়নী গুপ্ত একটি পুরনো সেলফি রি-টুইট করেছেন, যাতে প্রধানমন্ত্রী মোদির পাশে ক'জনের সাথে তাকেও দেখা যাচ্ছে।

গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ভারতের নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। নির্বাচনের ঠিক আগে দেশটির প্রধান টিভি চ্যানেলগুলো প্রধানমন্ত্রী মোদির সাক্ষাৎকার প্রচার করে। এর একটি সাক্ষাৎকার নেন বলিউড সুপারস্টার অক্ষয় কুমার। শুরুতেই তিনি সাফ জানিয়ে দেন যে প্রধানমন্ত্রীকে তিনি কোনো রাজনৈতিক প্রশ্ন করবেন না। অথচ ওটি ভারতের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনগুলোর একটি। দেশ তখন গুরুতর অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত, সমাজে অস্থিরতা ক্রমেই বাড়ছে, এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে ''রাজনৈতিক প্রশ্ন'' না-করার মানে কী? মানে হলো, তিনি তেমন প্রশ্নই করবেন যেরকম প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রী মোদি শুনতে চান।

এ অভিনেতা এর আগেও বিজেপি-র কট্টর নীতির পক্ষে ''দেশপ্রেমমূলক'' ছবি বানিয়েছে, যাতে মুসলিমদেরকে হেয় করা হয়েছে। এই ''দেশপ্রেমিক'' অভিনেতাই কয়েক বছর আগে কানাডীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ভারতের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন। আর এমন একজনকে সাক্ষাৎকার দিতে বিব্রত হননি প্রধানমন্ত্রী মোদি। এর কারণ হলো অক্ষয়ের সেই ছবি। নির্বাচনের কয়েক মাস আগে ছবিটি মুক্তি পায়। ছবির নাম 'কেশরী''। এর অর্থ অলো, জাফরান। জাফরান রঙটি ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের সাথে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। ছবিতে অক্ষয়কে দেখা যায় হাবিলদার ইশার সিং-এর ভূমিকায়। এই হাবিলদার ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনীর শিখ রেজিমেন্টের একজন কম্যান্ডার। ১৮৯৭ সালের সারাগারহি যুদ্ধের পটভূমিকায় নির্মিত ছবিটিতে নায়ককে দেখা যায় আফগানিস্তানের পশতুন উপজাতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। ছবিতে শিখ সেনাদের সাহসী ও দেশপ্রেমিক এবং পশতুন মুসলিমদের ধর্মোন্মাদ জিহাদী হিসেবে দেখানো হয়েছে।  

অবশ্য শুধু অক্ষয় কুমার একাই যে মোদি ও বিজেপি-র কট্টর সমর্থক, তা নয়। গত পাঁচ বছরে ইন্ডিয়ান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির বহু বড় বড় চাঁইকে ক্ষমতাসীন দলের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করতে দেখা গেছে। আর যারা এর বিপরীত স্রোতে চলার সাহস দেখিয়েছে, তাদের প্রকাশ্যেই হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে। আর এ রকম ঘটনায় তারা চলচ্চিত্রজগতের নামমাত্র সমর্থনও পাননি।

২০১৯ সালের মধ্য জানুয়ারিতে মুক্তি পাওয়া ''উরি : দ্য সারজিক্যাল স্ট্রাইক'' নামের একটি ব্যবসাসফল ছবির কথাই ধরা যাক। ২০১৬ সালে পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে যে ''সার্জিক্যাল'' হামলা চালিয়েছিল ভারত, তার ওপর ভিত্তি করে ছবিটি বানানো  হয়েছে। এতে মোদিকে দেখানো হয়েছে একজন দেশপ্রেমিক লৌহমানব হিসেবে, যে কিনা দুশমনের বিরুদ্ধে কঠিন প্রতিশোধ গ্রহণ করে। ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। ছবি চলাকালে সিনেমা হলের ভেতর দর্শকদের ''ভারত মাতা কী জয়'' স্লোগানে ফেটে পড়তে দেখা যায়। বক্স অফিস থেকে ছবিটির আয় হয় ২৪০ কোটি রুপী।

শুধু ''উরি''ই নয়, বিজেপি-র কট্টরপন্থী ''আদর্শ'' তুলে ধরে এবং বিরোধীদের হেয় করে আরো বেশ ক'টি ছবি সম্প্রতি বানানো হয়েছে মুম্বাইয়ে। যেমন, দ্য তাসখন্দ ফাইল এবং দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার। জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে আগে এগুলো মুক্তি পায়।  দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার ছবিতে কংগ্রেসকে দেখানো হয়েছে একটি দুর্বল ও ছিন্নভিন্ন দল হিসেবে, যে দল ঠিকভাবে দেশ চালাতে অক্ষম।

শুধু ছবি বানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বলিউড। গত নির্বাচনের মসতিনেক আগে বিজেপি একটি ফটোগ্রাফ প্রকাশ করে। এতে দেখা যায় বলিউডের একদল তারকা প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছেন। 

তাকেও ছাড়িয়ে অনেকে বিজেপি-র নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। এরকম একজন হলেন অনুপম খের।  দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার ছবির প্রধান ভূমিকায় অভিনয়কারী এ অভিনেতা বিজেপি-র এমপি কিরন খেরকে বিয়ে করেন এবং চন্ডিগড়ে বিজেপি-র নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন।

আরেক সুপারস্টার সানি দেউল গত এপ্রিলে বিজেপি-তে যোগ দেন এবং পাঞ্জাব রাজ্যের নির্বাচনে অংশ নেন। তিনিও বিজেপি-র রাজনৈতিক এজেন্ডার পক্ষে একটি ছবি বানান, যাতে দেখানো হয়েছে, জিহাদীরা সাধারণ মুসলিমের বেশে সারা দেশে ঘুরছে আর প্রাণঘাতী বোমা হামলার পরিকল্পনা করছে।

এরকম অবস্থায় বলিউডের যারা বিজেপি-র ''আদর্শ''কে গ্রহণ করেনি তারা নিরুপায় হয়ে চুপচাপই থাকছে। না-থেকে উপায়ই বা কী? বলিউডের প্রখ্যাত অভিনেত নাসির উদ্দীন শাহ একবার বলেছিলেন, দেশে অর্থাৎ ভারতে ঘৃণার সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ছে। একথা বলার পরই ভারতজুড়ে তার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে। সেদিন তার পক্ষে তার সহকর্মীরা কেউ এগিয়ে আসেনি। একইভাবে দেশে অসহিষ্ণুতার নিন্দা করে বিপাকে পড়েছিলেন সুপারস্টার শাহরুখ খান ও আমীর খান। বিজেপি তাদের বলেছিল ''দেশদ্রোহী''। সেদিনও তাদের পক্ষে তাদের সহকর্মীরা কেউ এগিয়ে আসেনি।

মজার ব্যাপার হলো, ভারতের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি অতীতেও সবসময় ক্ষমতাসীনদের সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করেই চলেছে। সুপারস্টার অমিতাভ বচ্চন ছিলেন আরেক সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধির বন্ধু। কংগ্রেস দলের টিকেটে এমপি-ও হয়েছিলেন অমিতাভ। মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সেই অমিতাভকেই দেখা গেল মোদির ''গুজরাটের কসাই'' ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন করার কাজে সহায়তা করছেন।

তারকাদের ছবি, কথা ও কাজ তরুণসমাজকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বিজেপি ও তার ধর্মান্ধ নীতিকে সমর্থন দিয়ে বলিউড এখন হেট পলিটিক্সকে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করতে এবং হিন্দুত্ববাদকে এগিয়ে যেতে সহায়তা করছে। কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না, এখন যেটুকু স্বাধীনতা তারা ভোগ করছে, এর মধ্য দিয়ে সেটাও হারাতে চলেছে। শুধু তা-ই নয়, ধ্বংসাত্মক আদর্শকে সমর্থনের মাধ্যমে যে চাটুকারিতা ও কাপুরুষতা তারা প্রদর্শন করলো, ইতিহাসে তা তাদেরকে অনেক নিচে নামিয়ে আনবে।