নায়ক থেকে খল নায়ক জেনারেল পারভেজ মোশাররফের উত্থান - পতন

পারভেজ মোশাররফ - সংগৃহীত

  • হাসান আব্দুল্লাহ
  • ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯, ২৩:০৮


১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তানের সফল পারমানবিক পরীক্ষা আর ১৯৯৯ সালে কারগিল যুদ্ধের কারনে গোটা উপমাহদেশ জুড়ে বিরাজ করে টান টান উত্তেজনা। এরই মধ্যে ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনা প্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। জেনারেল মোশাররফের ক্ষমতা দখলে তখন পাকিস্তানের যেসব সাধারন মানুষ রাস্তায় আনন্দ মিছিল বের করেছিল খুব শীঘ্রই আবার তারাই তার পতনের জন্য রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়। কারন নায়ক থেকে খল নায়কে পরিনত হতে বেশি সময় নেননি জেনারেল মোশাররফ। ক্ষমতাচ্যুতির পর কখনও নির্বাসন আবার কারা জীবনের মধ্যে রাজনীতিতে ঘুড়ে দাড়ানোর চেষ্টা করেছেন মোশাররফ। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের আদালতে তার মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে।


১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর গত ৭২ বছরের প্রায় অর্ধেক সময় পাকিস্তান শাসন করেছেন বেশ কয়েকজন জেনারেল। এমনকি বেসামরিক শাসনামলেও পাকিস্তানের প্রভাবশালী সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বারবার। পাকিস্তানের অনেক সেনা প্রধান অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সরাসরি দেশ শাসন করেছেন যেমনটা করেছেন জেনারেল পারভেজ মোশাররফও। তবে পারভেজ মোশাররফই হলেন প্রথম কোনো সামরিক শাসক যিনি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল আর সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে বিচারের মুখোমুখি হলেন দেশটিতে। সামরিক বাহিনী কর্তৃক ক্ষমতার রাজনীতিতে বরাবরই প্রভাববিস্তারকারী পাকিস্তানের মত দেশে জেনারেল মোশাররফের এ বিচার ও মৃত্যুদন্ড নানা কারনে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।


২০০১ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোশাররফ। বর্তমানে তিনি দুবাই অবস্থান করছেন। ২০১৬ সালে চিকিৎসার জন্য তাকে দেশ ত্যাগের অনুমতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ১৯৪৩ সালে দিল্লিতে জন্ম নেয়া মোশাররফ পাকিস্তান আর্মিতে যোগ দেন ১৯৬১ সালে। ১৯৬৪ সালে কমিশন্ড লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তান সেনা প্রধান নিযুক্ত হন; নওয়াজ শরীফ তখন প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯৯ সালে মোশাররফ ও নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বে পাকিস্তান সফলভাবে পারমানবিক বোমা পরীক্ষা চালান ভারতের প্রতি উত্তরে।


পাকিস্তানের আভ্যন্তরিন রাজনীতিতে এবং রাষ্ট্রপরিচালনায় সেনা হস্তক্ষেপ নতুন কোনো বিষয় নয়। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন জেনারেল মোশরারফ। নওয়াজ শরীফ বেশ কঠিন ভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরে যান নওয়াজ শরীফ।
১৯৯৯ সালের অক্টোবরে কাশ্মীরের কারগিল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে মোশাররফ ও নওয়াজের সম্পর্ক তিক্ত আকার ধারণ করে। শ্রীলঙ্কা সফর শেষে দেশ ফেরার পথে বিমানে বসেই মোশাররফকে বরখাস্তের উদ্যোগ নেন নওয়াজ। কিন্তু পারভেজ মোশাররফের জবাব ছিল নওয়াজের তুলনায় দ্রুত। নওয়াজ শরীফের বিমান পাকিস্তানে অবতরনের আগেই তিনি সামরিক শামনের আদেশ জারি করেন দেশটিতে এবং রক্ষপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। দুই বছর পর নিজেকে দেশটির প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন । ২০০২ সালে বিতর্কিত নির্বাচনে মোশাররফের গড়া দল পিএমএল-কিউ জয়ী হয় এবং এর মাধ্যমে তিনি দেশটির প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হন।


তার শাসনামলে প্রথম কয়েক বছর পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে খানিকটা স্থিতিশীলতা আসে। নওয়াজকে হটিয়ে ক্ষমতা গ্রহনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে সরাসরি মার্কিন হামলার ক্ষেত্রে পরিণত করাসহ নানা কারনে মোশাররফ দ্রুত জনপ্রিয়তা হারান। যে কারগিল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নওয়াজকে হটিয়ে মোশাররফের উত্থান ঘটে পরবর্তীতে দেখা গেছে ভারতের সাথে সেই মোশররফের আবার নতজানু নীতি অবলম্বন করেন। তার আমলে নিহত হন পাকিস্তানের অন্যতম জনপ্রিয় দুইবারের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো।


মার্কিন নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জোরালো সমর্থন দিয়ে জেনারেল মোশাররফ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের অবস্থান পোক্ত করতে পারলেও দেশে তার জনপ্রিয়তা দ্রুত ধ্বস নামে। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচালিত নাইন ইলেভেন সন্ত্রাসী হামলার পর তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সমর্থন দেন নিজ দেশের জনগণের তীব্র বিরোধীতা উপক্ষো করে। পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ড্রোন হামলার অনুমতি দেন । শুধু তাই নয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অন্যান্য নিরাপত্তা সহযোগিতা দেন তিনি। এমনকি লাল মসজিদসহ দেশের ভেতরে বিভিন্ন উপজাতি গোষ্টীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। দেশের ভেতরে তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বাধতে থাকে।


জেনারেল মোশাররফ তার ক্ষমতার মেয়াদ বাড়ানোর জন্য ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর দেশটির সংবিধান স্থগিত করে জরুরি অবস্থা জারি করেন। এর বিরুদ্ধে পাকিস্তানে তীব্র ক্ষোভ বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। জরুরি অবস্থা জারির সাথে সাথে তিনি গ্রেফতার করেন রাজনীতিবিদ, বিচারকসহ অনেককে। পরভেজ মোশাররফের পতন ত্বরান্বিত হয় ২০০৭ সালের মার্চে যখন তিনি প্রধান বিচারপতি ইফতেখার মুহম্মদ চৌধুরীকে অপসারনের উদ্যোগ নেন।


আইনজীবীরা দেশব্যাপী এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন যাতে পরবর্তীতে যোগ দেন রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংগঠন। দেশব্যাপী দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা এ আন্দোলনে অর্থনীতি ও জনজীবনে স্থবিরতা নেমে আসে। পরিস্থিতি এমন আকার ধারণ করে যে, প্রেসিডেন্ট মোশাররফ তার নিজের গঠিত সরকার ভেঙ্গে দিয়ে সরাসরি শাসন জারি করেন আবার। একই সাথে সেনা প্রধান ও প্রেসিডেন্ট পদ দখল নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে প্রথমে তিনি তার অনুগত আশফাক কিয়ানীর হাতে সেনা প্রধানের ভার দিয়ে শুধু প্রেসিডেন্ট পদ দখলে রাখেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনী প্রচারণায় নিহত হন বেনজির ভুট্টো। ২০০৮ সালের ১৮ ফ্রেব্রুয়ারি নির্বাচনে মোশাররফের দলের ভরাডুবি ঘটে নিহত বেনজিরের দলের কাছে। ২০০৮ সালের আগস্টে মোশাররফ বেনজির ভুট্টোর স্বামী আসিফ আলী জারদারির কাছে প্রেসিডেন্ট পদ হস্তান্তর করেন। ক্ষমতা হারিয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে যান মোশাররফ।


নির্বাসনে থাকলেও উচ্চাভিলাষী পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তানের রাজনীতিতে নিজেকে আবার প্রতিষ্টার পরিকল্পনা গ্রহন করেন। ২০১৩ সালে দেশে ফেরেন সাধারন নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য। তবে আদালত তার নির্বাচনে অংশ নেয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এসময় তিনি বেনজির ভুট্টো হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় জড়ান। ২০১৩ সালের নির্বাচনে উত্তান ঘটে মোশাররফের দুশমন নওয়াজ শরীফের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের। ফলে মোশাররফের রাজনীতিতে ফেরা কঠিন হয়ে পড়ে।


নওয়াজ শরীফ এবার আর পারভেজ মোশাররফের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে ভুল করেননি। ক্ষমতায় এসে প্রথমে তিনি মোশাররফকে গৃহবন্দী করেন। এরপর তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা বা দেশদ্রোহিতার অভিযোগে বিচারের উদ্যোগ নেন। সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আহবান জানানো হয় দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তার বিচারের জন্য। এরপর মোশারফের বিচারের জন্য গঠন করা হয় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। ২০১৪ সালে তার বিরুদ্ধে উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযোগ গঠন করা হয়। মোশাররফ এ বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক আখ্যায়িত করলেও আদালত তার যুক্তি আমলে না নিয়ে তাকে অবৈধ ক্ষমতা চর্চার দায়ে অভিযুক্ত করে।


পাকিস্তানের সংবিধান অনুযায়ী কারো বিরুদ্ধে উচ্চ বিশ্বাসঘাতকতা প্রমানিত হলে তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। ২০১৬ সালে দেশ ত্যাগের পর জেনারেল মোশাররফকে অনেক বার আদালতে হাজির হতে আদেশ দেয়া হলেও তিনি দেশে ফেরেননি। দেশদ্রোহী মামলার শুনানীতে তিনি দু’বার আদালতে হাজির হন দেশে অবস্থানকালে। ২০১৬ সালে আবার বিদেশ পাড়ি দেন । চিকিৎসার জন্য বিদেশ যাবার অনুমতি প্রার্থনায় সুপ্রিম কোর্টের কাছে মোশাররফ বলেছিলেন কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাসের মধ্যে তিনি ফিরে আসবেন। কিন্তু আদালতের কয়েক দফা নির্দেশ সত্ত্বেও তিনি আর ফেরেননি। অপর দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে পাকিস্তানের কোনো বন্দী বিনিময় চুক্তিও নেই।
মৃত্যুদন্ডের রায় মাথায় নিয়ে গুরুতর অসুস্থ পারভেজ মোশাররফকে হয়তো বাকি জীবন নির্বাসনে থাকতে হবে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন পাকিস্তানের অনিশ্চিত রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তবে এই রায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য অস্বস্তির কারন। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী বিবৃতি দিয়ে এই রায়ের সমালোচনা করেছে। ফলে আদালতের সাথে নতুন করে বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে সেনাবাহিনী। কারন এই রায় সেনাবাহিনীর অবৈধ ক্ষমতা দখলের জন্য কড়া বার্তা।