ভারতের সশস্ত্র বাহিনী আধুনিকায়নের চ্যালেঞ্জ 

ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়ন চলছে - সংগৃহীত

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৮ নভেম্বর ২০১৯, ১২:৪৪


গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী নির্মলা সীতারমনের একটি কথায় বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকদের মাঝে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সীতারমন বলেছিলেন, কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে মাত্র ১০ দিন টিকে থাকার মতো অস্ত্রের মজুদ আছে ভারতের। তারপর থেকে বিভিন্ন খবরে আভাস পাওয়া যায়, সীতারমনের লক্ষ্য হচ্ছে অস্ত্রের এমন মজুদ গড়ে তোলা , যাতে সম্ভাব্য যে কোনো যুদ্ধে ভারত যেন ৪০ দিন বা তারও বেশি দিন টিকে থাকতে পারে। 


এ বিষয়ে বর্তমানে প্রচলিত মত হচ্ছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীকে অবশ্যই বহিঃশত্রূর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং সেজন্য তার দরকার আরো উন্নত অস্ত্রব্যবস্থা। কিন্তু সরকারের অস্ত্র সংগ্রহ নীতি ভালো নয় এবং এক্ষেত্রে  দুর্নীতির অভিযোগ (স্মরণ করুন, বোফর্স কেলেঙ্কারি) আছে, আছে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতার অভিযোগও। তারপরও ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখা অর্থাৎ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর দরকার অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জা, যাতে প্রচলিত ও পারমাণবিক যুদ্ধের সক্ষমতা বৃদ্ধি পারে।


অস্ত্র বিষয়ে ভারতের সেনাবাহিনীতে উদ্বেগও কম নেই। তাদের হাতে আছে পুরনো দিনের অ্যাসল্ট রাইফেল, তা দিয়ে পাকিস্তান ও চীনের মতো দেশের মোকাবিলা করার তো কথাই নেই, কিন্তু নানা সময় দেশের ভেতরে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে ছোট-বড় সংঘর্ষ থাকেই। এমন ঘটনায় সেনাবাহিনীর হাতে থাকে প্রধানত সেই পুরনো দিনের অ্যাসল্ট রাইফেল, আর সন্ত্রাসীদের হাতে কালাশনিকভ রাইফেল।


এমন বাস্তবতায় ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের আগস্টে ৭২ হাজার ৪০০টি অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল কেনার জন্য এক হাজার ৭৯৮ কোটি রূপি বরাদ্দ করেছে। ওই সময় পত্রপত্রিকায় বলা হয়, সেনাবাহিনী সেদেশের অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বোর্ডের কাছে ৭.৬২x৫১ মিলিমিটার ক্যালিবার রাইফেল কেনার অনুমতি চেয়েছে। 'শূট অ্যান্ড কিল' ক্ষমতাসম্পন্ন এ ধরনের রাইফেলের রেঞ্জ ৩০০ মিটার। সেনাবাহিনীর আরো দরকার ক্লোজ কোয়ার্টার ব্যাটল কারবাইন ও হাল্কা মেশিনগান। 


এদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর 'মেক ইন্ডিয়া' পলিসি অনুসারে রাশিয়ার লাইসেন্স নিয়ে দেশেই এ কে-১০৩ ৭.৬২x৩৯ মিলিমিটার রাইফেল বানানোর পরিকল্পনা করছে ভারত। এ রাইফেল বর্তমানে প্রচলিত ইনসাস রাইফেলের স্থলাভিষিক্ত হবে আর  পুরনো নাইন এমএম কারবাইনের জায়গা নেবে সিএআর ৮১৬ ক্লোজ কোয়ার্টার কারবাইন।


ভারতের সেনাবাহিনী এখন ব্যবহার করে রাশিয়ান  দ্রাগুনভ রাইফেল। তারা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানিয়েছে এসব রাইফেলের পরিবর্তে ১৭ হাজার লাইট মেশিনগান (এলএমজি) ও ছয় হাজার পাঁচ শত স্নাইপার কেনার অনুমতি দেয়ার। এতে ব্যয় হবে দুই হাজার কোটি রুপি। আশা করা হচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের অনুমতি মিলবে।


ভারতের আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের তাগিদটি প্রথম ব্যাপকভাবে অনুভূত হয় কারগিল যুদ্ধের পর। ১৯৯৯ সালের গ্রীষ্মে এ যুদ্ধ হয়। ওই যুদ্ধে আর্টিলারির সাহস সেনাবাহিনীর চোখ খুলে দেয় এবং তারা আর্টিলারি বাহিনীর আধুনিকায়নের প্রয়োজন তীব্রভাবে অনুভব করতে থাকে। ১৯৮০র দশকের শেষের দিকে ১৫৫এমএম হাউটজার কেনা নিয়ে সংঘটিত বোফর্স কেলেঙ্কারির পর ভারতীয় সেনাবাহিনী আর এ ধরনের অস্ত্র সংগ্রহ করেনি। অবশ্য ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) ইতিমধ্যে তাদের নিজস্ব অ্যাডভান্সড টাওয়েড আর্টিলারি গান সিস্টেম ১৫৫এমএমx৪৫এমএম ক্যালিবার ধানুশ আর্টিলারি উদ্ভাবন করে ফেলেছে। এমনকি এর পরীক্ষাও সম্পন্ন করেছে। অস্ত্রটি এখন ভারতের সেনাবাহিনীতে চালুর অপেক্ষায় আছে। 


এদিকে বিভিন্ন পরিবেশে হাউতজারের পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। পাহাড়ের কনকনে ঠাণ্ডায় যেমন, মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশেও তেমনি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে অস্ত্রটি কোথায় কেমন কাজ করে। এ অস্ত্রটির রেঞ্জ ৩১ কিলোমিটার। ২০১৮ সালের নভেম্বরে ভারতের সেনাবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে  এম৭৭৭ আলট্রালাইট হাউতজারের প্রথম চালানটি গ্রহণ করে। একই সময় তারা দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকেও কে-৯ বজ্র-টি ১৫৫ এমএম/৫২ এমএম ক্যালিবার ট্র্যাকড সেলফ-প্রোপেলড হাউতজারের একটি চালনও গ্রহণ করে।


এর আগে, ২০১৮ সালের মে মাসে, পিয়াংকা মাল্টিব্যারেল রকেট লঞ্চারের (এমবিআরএল) গাইডেড ভার্সনের সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করে। রকেট লঞ্চারের এই ভার্সনটি উদ্ভাবন করেছে ভারতের প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও)। এর রেঞ্জ ৪০ কিলোমিটার, তবে তা ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ানো যায়। 

ভারতীয় সেনাবাহিনী তার আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সংস্কারও প্রয়োজন বলে মনে করছে। এর জন্যে তারা আশা করছে, রাশিয়া তাদেরকে অতি স্বল্প পাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেম ইগলা-এস সরবরাহ করবে। সেগুলো বর্তমানের ইগলা-এম সিস্টেমের স্থলাভিষিক্ত হবে।


আমেরিকা-রাশিয়ার পাশাপাশি ইসরাইলের সাথেও ভারতের অস্ত্রবাণিজ্য কম নয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আশা করছে, ২০২০ সালের মধ্যেই ইসরাইলের কাছ থেকে ভূমি হতে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য এমআর-এসএএম ক্ষেপণাস্ত্র পাবে এবং ভারত-ইসরাইল যৌথভাবে এর উৎপাদন শুরু করবে।


ভারতের সাঁজোয়া বাহিনীর মানোন্নয়ন এবং তাদেরকে রাত্রিকালীন হামলায় সক্ষম করে গড়ে তোলার প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে দুই হাজার ৪০০ কোটি রুপি বরাদ্দ করে। সেনাবাহিনী এখন আড়াই হাজার সাঁজোয়া যানের প্রয়োজন অনুভব করছে আর  তাদের  অস্ত্র কারখানাগুলো ওই চাহিদা মেটানোর চেষ্টায় কাজ করে চলেছে।


সেনাবাহিনী তাদের টি-৯০ ট্যাঙ্কের মানোন্নয়নের কথাও ভাবছে। ভাবছে তেখন তাদের হাতে থাকা লেসার গাইডেড 'ইনভার' মিসাইলের পরিবর্তে থার্ড জেনারেশন মিসাইল নির্মাণের কথাও। টি-৯০র মান উন্নয়নকালে এতে একটি নতুন মড্যুলার ইঞ্জিনও সংযোজন করা হবে। ফিউচার রেডি কমব্যাট ভেহিক্যাল (এফআরসিভি) উদ্ভবন কর্মসূচি চালুর আকাঙ্ক্ষাও সেনাবাহিনীর রয়েছে, কিন্তু ভেতরের কারো কারো ভিন্নমতের কারণে সেটা অনিশ্চয়তায় আটকে গেছে।


ভারতের অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইলও বদলানো প্রয়োজন বলে মনে করছে দেশটি। ইতিমধ্যে যদিও নতু্ন 'ফায়ার অ্যান্ড ফরগেট' নাগ মিসাইল হাতে এসে যাওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে সেনাবাহিনী, তারপরও তারা অপেক্ষায় আছে ইসরাইলের কাছ থেকে স্পাইক অ্যান্টি-ট্যাঙ্ক মিসাইল পাওয়ার। 


অধুনালুপ্ত সোভিয়েত আমলের বিএমপি-২ ইনফ্যান্ট্রি কমব্যাট ভেহিক্যালও বদলানোর চিন্তা করছে ভারত। কারণ, 'মেকানাইজড ফোর্স' হিসেবে পরিচিত ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে এসব আদ্যিকালের সরঞ্জাম আর মানায় না।


ভারতীয় বিমান বাহিনীও আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া থেকে পিছিয়ে নেই। ২০১৮ সালেই তারা ১০ বছর মেয়াদী একটি আধুনিকায়ন পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে। এ পরিকল্পনার অধীনে তারা প্রচলিত ও পারমাণবিক অস্ত্রের মান উন্নয়নের প্রযুক্তি ও সার্ভিস খুঁজে বের করবে। শুধু মূল অস্ত্রব্যবস্থা নয়, উপব্যবস্থাগুলোও এ পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এতে মেইনটিন্যান্স, রিপেয়ার ও ওভারহৌলের (এমআরও) ব্যবস্থাও রয়েছে। এর ফলে এতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হবে।


পরিকল্পনা অনুসারে মিরেজ-২০০০ এবং মিগ-২৯ আধুনিকায়নের কাজ চলছে। হেলিকপ্টার বহরে কপ্টারের সংখ্যা বাড়ানোর কাজও এগিয়ে চলছে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর শিগগিরই ব্রাহ্ম ক্রূজ মিসাইলও পাওয়ার কথা। দেশটি এর একটি সুপারসনিক ভার্সন তৈরিরও কাজ করছে। আকাশ প্রতিরক্ষা ক্ষমতা বাড়াতে  রাশিয়ার কাছ থেকে বিশ্বের সর্বাধুনিক এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম কেনার পরিকল্পনা করছে তারা। আরো ভাবছে ফ্রান্স থেকে জঙ্গি বিমান কেনার কথাও।


আধুনিকায়নের দৌড়ে সমান তালে এগিয়ে চলেছে ভারতীয় নৌবাহিনীও। সমুদ্রে নিজেদের সক্ষমতা বজায় রাখতে কাজ করছে তারা। যেহেতু চীন তার নৌবাহিনীকে আধুনিকায়ন করছে, অতএব ভারত আর চুপচাপ বসে থাকতে পারে না। ২০১৮ সালের জুলাই মাসে এক খবরে জানা যায়, ভারত পরমাণু শক্তিসমৃদ্ধ ছয়টি সাবমেরিন বানাচ্ছে। এ ছাড়া হাতে থাকা সব সাবমেরিন আধুনিকায়নের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। 

 

ভারতীয় নৌবাহিনী উদ্ধারকারী সাবমেরিন উন্নয়নেও কাজ করছে। পানির তলায় অচল হয়ে যাওয়া যে কোনো সাবমেরিনের ভেতর থেকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ১৪ জন নাবিককে উদ্ধার করে আনতে পারবে এটি। এরকম অসংখ্য আধুনিকায়ন কাজ চলছে ভারতীয় নৌবাহিনীর ভেতর, যার বিবরণ দেয়া স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। ভারত রেডার উন্নয়নেও কাজ করছে। এ কাজে সশস্ত্র বাহিনীর সংস্থাসমূহের পাশাপাশি বেসরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও জড়িত রয়েছে।


আলোচনার শেষ পর্যায়ে এসে গেছি আমরা। বলা হচ্ছে, গুরুতর বিলম্বিত প্রক্রিয়া ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা সত্ত্বেও ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীসমূহের আধুনিকায়নকাজ এগিয়ে চলেছে। ভারতীয় বিশ্লেষকদের মতে, এর খুবই প্রয়োজন রয়েছে। কেননা, ভারত শুধু বিদেশি রাষ্ট্রের হুমকিতে নয়, দেশি-বিদেশি নানা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলোর হুমকিতেও রয়েছে।