বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক

ভারত- বাংলাদেশ -

  • এম আবদুল হাফিজ
  • ২৩ এপ্রিল ২০১৯, ০০:৩৫


ভূগোল ও ভূরাজনীতি এই সম্পর্ককে বাংলাদেশের অস্তিত্বের সাথে সম্পৃক্ত করে রেখেছে। এ ছাড়াও বাংলাদেশকে পরিবেষ্টিত করে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রীয় অবস্থানে থেকে কন্টিনেন্টাল আয়তনের ভারত নিজকে এ দেশের জন্য একটি ‘ফ্যাক্টর’ হিসেবে গণ্য করতে আমাদের বাধ্য করেছে। যে দিকেই এগোতে চাই বা দৃষ্টি প্রসারিত করি, ভারত-ফ্যাক্টর বাংলাদেশকে ঘিরে থাকে। তাই আমরা চাই বা না চাই, ভারতকে এড়িয়ে বা উপেক্ষা করে আমরা কিছুই করতে পারব না। এই অকাট্য সত্যটি বাংলাদেশের সেই জন্মলগ্নেই প্রতিভাত হয়েছিল, যার ফলে এ ভূখণ্ডের মানুষ যে ভারত থেকে একাধিক ঐতিহাসিক কারণে মাত্র দুই যুগ আগে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল সেই দেশটির সাথেই আষ্টেপৃষ্ঠে ছড়িয়ে গিয়েছিল। যেসব তিক্ততা নিয়ে প্রচুর রক্তপাতের ভেতর দিয়ে আমরা স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলাম, তার অনেকটাই অপূর্ণ রেখে আজ সেই ‘বন্ধু’ ভারত আমাদের জন্য ‘নিয়তি’তে পরিণত হয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ বা বৈদেশিক সম্পর্ক সব কিছুই বিবর্তিত হচ্ছে ‘ভারত তা কিভাবে নেবে’ সেই বিবেচনাকে ঘিরেই। এ এক দুরূহ প্রক্রিয়া।


ভারত অবশ্য বন্ধু হয়েই আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে ১৯৭১ সালে এগিয়ে এসেছিল। প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল, আমাদের স্বাধীনতার স্পৃহাকে সমর্থন দিয়েছিল, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ বিতর্ককে কূটনৈতিকভাবে তুলে ধরেছিল এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে তার সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছিল। কিন্তু এরই মধ্যে একটি প্রচণ্ড অস্বস্তি এ ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যে সক্রিয় ছিল। ক্ষুদ্র হলেও একটি সচেতন ও সতর্ক গোষ্ঠী আতঙ্ক ও উদ্বেগের সাথে ভেবে থাকবে এই বন্ধুত্বের পেছনের মোটিভ সম্বন্ধে। ইতিহাস তো শিক্ষা দেয়, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে কোনো ফ্রি লাঞ্চ (Free Launch) হয় না। তা হলে ভারত কেন...?


এর উত্তর বুঝতে আমাদের খুব দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অল্প দিনেই আমরা দেখলাম কিভাবে এ দেশের বাজার, যা আগে অভ্যন্তরীণ কলোনি হিসেবে পাকিস্তানের একচেটিয়া আধিপত্যে ছিল তা ভারতীয়দের হাতে চলে গেল। বাংলাদেশ পরিণত হলো ভারতীয় নিম্নমানের পণ্যের ফঁসঢ়রহম মৎড়ঁহফ-এ। সীমান্ত বাণিজ্যের নামে প্রবর্তিত হলো রমরমা চোরাচালান ব্যবসা। এ দেশের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ যেটা আগে পাকিস্তানিদের হাতে ছিল, তার হাতবদল হলো মাত্র। ভীতসন্ত্রস্ত হলো এ দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষ, যারা শ্রেফ তাদের প্রভু বদলে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না।


বলা হয়, ত্রিশ লাখ বাঙালি স্বাধীনতার জন্য আত্মাহুতি দিয়েছে। কিন্তু দখলদার বাহিনীকে আমরা আত্মসমর্পণ করতে দেখলাম ভারতীয়দের কাছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেরিমনিয়াল সারেন্ডার অনুষ্ঠানে মহাসমারোহে ভারতীয় জেনারেলরা হাজির থাকলেও সেখানে ছিলেন না বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী। অথচ পাকিস্তানি দখলদারদের আত্মসমর্পণ ছিল ‘মিত্র বাহিনীর’ কাছে। কারণ যাই হোক, অপ্রিয় সত্য হলো এই যুদ্ধবন্দী ও সমর্পিত অস্ত্র, গোলাবারুদ সব কিছু নিয়ে গেল ভারতীয়রা। যুদ্ধোত্তর বিশৃঙ্খল প্রশাসনকে বিন্যস্ত করতে যেসব ভারতীয় আমলা ও কর্মচারী এ দেশে এসেছিল, তাদের অনৈতিক আচরণের নমুনা সে সময়কার কিছু প্রকাশনায় বিধৃত হয়ে আছে।


দেখা যাবে, যুদ্ধকালীন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা সম্পর্কে চিড় ধরতে খুব সময় লাগেনি। সবচেয়ে অনাকাক্সিক্ষত যে, আমাদের সম্পর্কের সমীকরণ এরপর খুব দ্রুত বদলাতে থাকে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহ দমনে চট্টগ্রাম হিলট্র্যাক্ট অঞ্চলে বিদ্রোহীদের তথ্য তালাশে এদেশে রয়ে যায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর কিছু লোক অজ্ঞাত চুক্তির দোহাই দিয়ে। অবশ্য পরে পঁচিশ বছর স্থায়ী বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির কথা জানাজানি হয় এবং এর তাৎপর্য নিয়ে বিভিন্ন মহলে সংশয় ও উদ্বেগ জমতে থাকে। কালক্রমে এ দেশের সচেতন জনগণের বুঝতে বাকি থাকে না যে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে এখন ভারতের জন্য তাদের অনুগত একটি ভৌগোলিক সত্তার প্রয়োজন ছিল। যদিও পরে অনুগত তো দূরের কথা, একটি বন্ধু ভাবাপন্ন ভৌগোলিক সত্তার প্রয়োজনও মেটাতে পারেনি এ দেশ, তবে আমাদের স্বাধীন সত্তার ঊষালগ্নে পরিকল্পনা এমনই ছিল।


ইতোমধ্যে মওলানা ভাসানী প্রমুখ কিছু ভিন্নমতাবলম্বীর নেতৃত্বে ভারতবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে। এ সময় উপমহাদেশে কিছু কিছু সুদূরপ্রসারী ঘটনা ভারতের উদ্দেশ্যগুলোকে প্রকট করে তুলতে থাকে। তার মধ্যে ভারতের সিকিম দখল ও ভারতীয় প্রজাতন্ত্রে তার অন্তর্ভুক্তি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রসত্তাগুলোর জন্য অশনি সঙ্কেত সঞ্চার করে। প্রায় একই সময় ভারতের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ (১৯৭৪) দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটির আধিপত্যের লিপ্সাকে আর গোপন রাখেনি। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যে ভারতের উদগ্র ক্ষমতালিপ্সার কাছে কালক্রমে সামন্ত রাষ্ট্রে (Vassal State) পরিণত হতে থাকবে, সে আশঙ্কা দেশের ভেতরে ও বাইরে উচ্চারিত হতে থাকে।


ভারতের একটি বিশ্বশক্তিতে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পুরনো। অবশ্য স্বদেশকে মহিমান্বিত করার বা দেখার আকাক্সক্ষা অন্যায় কিছু নয় বিশেষ করে ভারতের যখন সে যোগ্যতা (Potential) ষোল আনায়ই আছে। কিন্তু কোনো চানক্যনীতির মাধ্যমে তা অর্জন নৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষুদ্রদেশ যেমন নেপাল, ভুটান বা শ্রীলঙ্কায় অসম চুক্তির মাধ্যমে বেকায়দায় ফেলে ভারতের আধিপত্য বলয়ে আনা দেশটির জন্য মঙ্গলজনক হবে না। বাংলাদেশের মতো স্বাধীনচেতা দেশে এর প্রচণ্ড বিরূপ প্রতিক্রিয়া হবে। পাকিস্তান একে তো কোনো ক্ষুদ্র দেশ নয়, তা ছাড়াও দেশটির অন্তত ভারতের সাথে সমর কৌশলগত সমতা (Strategic Parity) আছে।


যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ভারত ফ্যাক্টরকে ঘিরে এ পর্যন্ত অনেক রাজনৈতিক বিবর্তন ঘটেছে। এবং প্রতিটি বিবর্তনের মূলেই দেখা গেছে, জনগণের প্রচণ্ড ভারত-বিদ্বেষ। তা অবশ্য অকারণ নয়। এও এক পরিহাস যে, যখন আমরা অর্থাৎ অধুনা বাংলাদেশ ও ভারত সেকুলার আদর্শের প্রবক্তা ঐতিহাসিক স্মৃতি অন্তত ইংরেজ ঔপনিবেশিক আমলের সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্ব ও বিভক্তি এখনো সক্রিয়। সমগ্র ঔপনিবেশিক আমলে ও দেশ বিভাগের পরেও উপমহাদেশে আট শ’ বছরের মুসলিম শাসন ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িক নিরন্তর হুল ফুটিয়েছে এবং মধ্যযুগীয় ভারতে মুসলিম বিজয়াভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছবার অক্ষমতা অবিভক্ত ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়কে বারবার হতাশায় নিমজ্জিত করেছে।


এই বিপরীতমুখী মনস্তাত্ত্বিক বৈরিতা প্রায়ই সাংঘর্ষিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। উদারপন্থী আলোকিত (Enlightened) এক ব্রাহ্মণ জওহর লাল নেহরু কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মতদ্বৈধতা সত্ত্বেও বহুজাতিক ভারতের অখণ্ডতা বজায় রাখতে সেকুলারিজমের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু আসলে ভারতের নেতৃত্বÑ এমনকি সেকুলারপন্থী কংগ্রেসেরও একটি অংশ এই মতবাদে মনেপ্রাণে বিশ্বাসী নয়। স্মরণ থাকতে পারে যে, বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদীরা বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেললেও সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারে কংগ্রেসদলীয় নরসিমা রাও আসীন ছিলেন, যিনি উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারকে মসজিদ ভাঙা পর্যন্ত বরখাস্ত করেননি। একই ভাবে বাংলাদেশের সেকুলারিজমও সরকার ভেঙে সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় এবং একপ্রকার Expediency-কেই লালন করে।


বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্লেষণে এই বাস্তব ও ঐতিহাসিক সত্যগুলোকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। ফলে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের একটি অপচ্ছায়া আমাদের উপমহাদেশে রয়েছে। আমরা স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে অস্তিত্বে এসেছিলাম সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে এবং তা কোনো অম্লমধুর অভিজ্ঞতা থেকে উৎসারিত হয়নি। অবিভক্ত বাংলায় দেশ বিভাগের প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক যে তিক্ত ছিল, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাঞ্জাব বিভক্তির ফলে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক নৃশংসতার সমকক্ষ না হলেও ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা রায়ট’ এ তিক্ততার স্বাক্ষর বহন করে। আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক কুশীলবরা কোনো না কোনোভাবে এই তিক্ততার উত্তরাধিকারী। তাই আমরাও ভারতের দৃষ্টিতে ভারতের কাছে সেই সাম্প্রদায়িক ছকে পড়ে গেছি।


তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তো বটেই, ভারতও বোঝে, আমাদেরকে ভূরাজনীতির অনুশাসন মানতেই হবে এবং সহাবস্থানে প্রবৃত্ত হতে হবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এই সম্পর্ক বিশ্লেষণের সূত্রপাত এবং এমন সম্পর্কের সম্ভাবনা নিয়ে একটি নির্মোহ আলোচনার অবতারণা।


নিজেদের স্বার্থেই বাংলাদেশ-ভারত সুসম্পর্ক উভয় দেশেরই কাম্য এবং সে ভাবেই এই সম্পর্কের সূচনা। উপমহাদেশে একাত্তরের যুগান্তকারী ঘটনার অব্যবহিত পরে এই পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃশ্যপটের নায়করা সবাই সশরীরে ইতিহাসের মঞ্চে সমুপস্থিত বিশেষ করে বাংলাদেশের শেখ মুজিব ও ভারতের ইন্দিরা গান্ধী যাদের কাক্সিক্ষত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের স্থাপত্যের নির্মাতা। সে সময় ভাবাবেগও ছিল অনুকূল। তা সত্ত্বেও শুরু থেকেই সাধারণ জনগণ পর্যায়ে এই সম্পর্ক খুব একটা মসৃণ পথে এগোয়নি। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালেও বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় নীতিনির্ধারক ও ভারতে আশ্রিত প্রবাসী সরকারের মধ্যে মতান্তর ঘটেছে। তবু এত সহজে আহরিত স্বাধীন বাংলাদেশের ইউফোবিয়ায় সে সব চাপা পড়ে গিয়েছে। কিন্তু সেই চাপা পড়া প্রসঙ্গগুলো দীর্ঘদিন চাপা থাকেনি।


সব সম্পর্ক প্রণয়নে প্রথমত কতগুলো বিঘ অন্তত বাংলাদেশ অনুভব করতে থাকে। স্বভাবতই শুরু থেকে সমগ্র স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ভারত সরকারেরই বিষয় ছিল। বাংলাদেশ সরকারকে বড়জোর জ্ঞাতার্থে অবহিত করা হতো মুক্তিযুদ্ধসহ আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার খুঁটিনাটি। বাংলাদেশের একক কোনো স্বাধীনতা বা ভূমিকাও ছিল না ঘটনা প্রবাহে কোনো প্রভাব ফেলার। এমনই একটি সমীকরণ ভারতীয়দের অনিবার্যভাবে দিয়েছিল এক প্রকার মনোভাব, যার অর্থ দাঁড়ায় Taking the other side for golanted। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রচিত হওয়ার পরও ভারতীয়দের এই মনোভাব চলমান থাকে। আত্মসম্মানসম্পন্ন কোনো জাতির প্রতিনিধি কর্মকর্তারা এই মনোভাব মেনে নিতে পারেন না।


এ ছাড়াও উভয় দেশ ও তাদের সরকারের মধ্যে একটি আস্থাহীনতা বিরাজ করতে থাকে, যার ফলে এখনো আমাদের সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ইস্যুগুলো বা সেগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারেন না। এক প্রকারের সন্দেহপ্রবণতা দুই দেশের মধ্যে এখনো সক্রিয় বলে মনে হয়। স্বাধীনতার পর উভয় দেশের বিভিন্ন সরকারের সময় জনতার সংযোগ, আলোচনা ও পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু কোনো ইস্যুর নিষ্পত্তির লক্ষ্যে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই তা ঝুলে গেছে। যতই ইস্যুগুলো পুরনো হয়ে যাচ্ছে ও অতিক্রান্ত সময়ের মরচে পড়ে যাচ্ছে, সেগুলোতে তাদের নিষ্পত্তিও হয়ে পড়ছে আরো অনেক কঠিন। গঙ্গার পানি বণ্টন সেই বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে আলোচিত হয়ে আসছে। বিস্ময়কর হলেও এই সমস্যা এখনো আগের মতোই জীবন্ত ও চলমান।
যেকোনো পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বিতর্কের অন্ত নেই, কিন্তু এই চার দশকে অর্জন অতি সামান্য। তবে তাতে বাগাড়ম্বরের কোনো ঘাটতি দেখা যায়নি। যেকোনো দ্বিপক্ষীয় সংযোগ, সফর, প্রটোকল বা চুক্তিকে ঐতিহাসিকতার প্রলেপ দেয়া হয়েছে কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সেগুলো অমীমাংসিতই রয়ে গেছে। কোনো অগ্রগতি নেই বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর বিষয়ে। নেপাল বা ভুটানের সাথে বাংলাদেশের স্থল ট্রানজিটের বিষয়টি আজও হিমাগারে। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয় ভারতের এড়িয়ে যাওয়ার কবলে। যৌথ নদী কমিশন নিষ্ক্রিয়। অনেক তাগাদায় কখনো তা সক্রিয় করা গেলেও গঠনমূলক আলোচনার পরিবর্তে তা কুতর্কেই পর্যবসিত হয়েছে। সীমান্ত পরিস্থিতি ভালো নয়। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের হঠকারী তৎপরতায় সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশী বসবাসকারীদের জীবন দুর্বিষহ। অথচ ভারতীয় মাদক পাচারে কোনো ঘাটতি নেই।


একই ভাবে আছে সমুদ্রসীমা চিহ্নিতকরণের বিষয়টি। প্রাপ্ত তথ্য ও সংবাদমাধ্যমে যা বোঝা যায়, তাতে ভারত ও মিয়ানমার এবার যৌথভাবে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ প্রস্তাবিত সালিসির রায় বাংলাদেশের প্রতিকূলে নিয়ে যেতে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে এ মুহূর্তে পুনর্গঠিত বিডিআর সম্পূর্ণ মোতায়েন না থাকায় বাংলাদেশের স্বার্থসংরক্ষিত হওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।


এমনই এক পরিপ্রেক্ষিতের বিপরীতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯ ডিসেম্বর ভারত সরকারের আমন্ত্রণে একটি মাইলফলক সফরে দিল্লি যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। তার এই সফরকালে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে বিদ্যমান সমস্যা নিয়ে আলোচনা এবং কয়েকটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হবে। আলোচনার বিষয়বস্তু ও ক্ষেত্র প্রস্তুতের লক্ষ্যে ইতঃপূর্বে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারত সফর করেছেন। আলোচনার এজেন্ডায় প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি চূড়ান্ত করতে সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব নিরুপমা রাও ঢাকায় এসেছিলেন। ইতোমধ্যেই শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনার বিষয়বস্তুগুলো নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য এসেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ ভারত বাংলাদেশের কাছে সেই পাকিস্তান আমল থেকেই নৌ ও এয়ার ট্রানজিট সুবিধা পেয়ে আসছিল। তবে তাদের যে স্থল ট্রানজিট পাওয়ার একটি সুপ্ত অভিলাষ ছিল, স্বাধীনতা-উত্তর নানা ব্যাখ্যা প্রবণতা ও কার্যক্রম থেকে তা পরিষ্কার হয়ে উঠছিল। কোনো কোনো মহল এমনও বলেছিল, সেটাই ছিল বাংলাদেশ সঙ্কটে ভারতীয় বিনিয়োগের মুখ্য উদ্দেশ্য। তা না হলে ভারতের জন্য তাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে ধরে রাখা ব্যয় ও কষ্টসাধ্য। তাই নানা পদ্ধতিতে ভারতের জন্য স্থল ট্রানজিটের ব্যবস্থা। তবে কিছু দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী জানা গিয়েছিল, আশুগঞ্জ বন্দর ব্যবহার করে আখাউড়া হয়ে ভারতের বিদ্যুৎ উৎপাদনসংক্রান্ত কিছু ভারী মালামাল ও যন্ত্রপাতি বহনের জন্য নীতিগতভাবে বাংলাদেশ সম্মত হয়েছে। কিন্তু তিনি এও বলেছিলেন, ভারত আলোচ্য স্থল ট্রানজিটের সুবিধা একবারই পাবে। এখন দেখার বিষয়, বাংলাদেশের এই সম্মতি একবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না।


এও জানা যায়, বিতর্কিত টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি বিধায় অনুমান করা যায় যে, এ সম্পর্কে কোনো চুক্তিও হবে না। এই বাঁধ নির্মাণ প্রতিরোধ না করতে পারলে নাকি বাংলাদেশের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ অঞ্চলে পরিবেশ বিপর্যয় হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্কবাণী উচ্চারণ করছেন। অনেকের মতে, উজানে বরাক নদীর প্রবাহ বন্ধ হলে তা ফারাক্কার চেয়েও কঠিন অবস্থার সৃষ্টি করবে।


দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানে আমাদের খুব একটা প্রস্তুতি নেই। তাই দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা সব সময়ই থাকি রক্ষণভাগে (Defensive)। অথচ আলোচনা থেকে প্রাপ্তির জন্য যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের প্রয়োজন হয়। সেই বঙ্গবন্ধুর সময় থেকেই যখন ফারাক্কা সমস্যার সূচনা হয়, বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক, প্রভাব এবং ব্যক্তিগত সম্মোহন (Charisma) ক্ষমতার ওপর অধিক নির্ভর করতে চাইতেন। কূটনীতি বা কৌশল নির্ণয় বা প্রয়োগে তার খুব একটা উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু বাস্তবে কূটনীতির অল্পই বিকল্প আছে। বহু আলোচিত ত্রিশ বছরের পানি চুক্তি আমাদের কিছুই দেয়নি বা দেবে না, যতক্ষণ আমরা প্রাপ্ত পানি প্রবাহের যথাযথ মনিটরিং করতে পারব। চুক্তি হওয়াতেই আমরা আহ্লাদে আটখানা। জানা যায়, এ পর্যন্ত কোনো বছরেই ভারত প্রতিশ্রুত পরিমাণ পানি আমাদেরকে দেয়নি, ভরা মৌসুমেও পদ্মার ধু-ধু বুক তা প্রমাণ করে।


পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সবচেয়ে জটিল ইস্যু হলো সমুদ্রসীমা নির্ধারণ, যা শুধু সঠিকভাবে মীমাংসা করতে পারলেই বাংলাদেশের গ্যাসসহ সমুদ্রসম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এখানে অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে বাংলাদেশকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। প্রয়োজনে সমস্যার সব ডাইমেনশন এক্সপার্টদের দিয়ে খতিয়ে দেখতে হবে। দেশে বাইরেও আমাদের অনেক শুভাকাক্সক্ষী ও এ বিষয়ে পারদর্শী ব্যক্তি আছেন। তাদের যৌথ অভিজ্ঞতার আলোকে কৌশল নির্ণয় করতে হবে।


আন্তর্জাতিক সম্পর্কে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি বলে কিছু নেই। একই সমস্যার পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে। তাই চূড়ান্ত ছাড়ও কোনো অবস্থাতেই বাঞ্ছনীয় নয়। দর কষাকষির হাতিয়ার (Leverage অর্থে) একবারেই নিঃশেষিত হতে দেয়া সঠিক নয়। ভবিষ্যতেও নিষ্পত্তি বা একটি নিষ্পত্তির উৎকর্ষের জন্য হাতের পাঁচ মজুদ রাখতেই হয়। স্থল ট্রানজিটের বিষয়টি এজন্যই খুব স্পর্শকাতর। ভারত এটি পেতে মরিয়া হয়ে আছে ও বিনিময়ে হয়তো লোভনীয় কিছু দিতেও প্রস্তুত আছে। তা সত্ত্বেও এটিও আমাদের দর কষাকষিতে একমাত্র ও সর্বোত্তম মুলো।


আমাদের প্রধানমন্ত্রী অবশ্য এ সময় যথেষ্ট সচেতন। এর রাজনৈতিক মূল্য সম্বন্ধেও তিনি অনবহিত নন। যা হলে তিনি তার গত মেয়াদেই এটি দিতে পারতেন। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো, এর নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টতা। আমজনতাও যদি নিরাপত্তার বিষয়টি অনুধাবন করে ট্রানজিটের বিরুদ্ধে একাট্টা হতে পারে, অনেক যোগ্য এবং মেধার অধিকারী সরকারও তা বুঝবে বলে আমরা আশাবাদ পোষণ করি।