সৌদি-ভারত-পাকিস্থানের ত্রিভূজ সম্পর্ক

-

  • মুহাম্মাদ আইয়ূব
  • ০৮ মার্চ ২০১৯, ১২:১১

 

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মাদ বিন সালমানের নয়া দিল্লি সফরের পর সৌদি-ভারত সম্পর্ক আরো জোরদারের ব্যাপারে দিল্লিকে বেশ উল্লাসিত মনে হচ্ছে। আর এই সম্পর্ক উন্নয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিলো ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ২০১৬ সালে সৌদি আরব সফরের সময় হতে। দিল্লির আনন্দিত হবার পেছনে অবশ্য কিছু যৌক্তিক হিসেব-নিকেশও কাজ করেছে। এরমধ্যে রয়েছে ভারতের সাথে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ, বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং এনার্জি সেক্টরে সৌদির সহযোগতিার আগ্রহ। আবুধাবীর ‘ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানী’র সাথে সৌদির ‘আরামকো’ যৌথভাবে মহারাষ্ট্রের রত্নগিরিতে একটি তেল শোধনাগার এবং পেট্রোক্যমিক্যাল কমপ্লেক্স তৈরী করতে চাচ্ছে। প্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পটিতে ভারতের পাবলিক সেক্টরও যৌথভাবে জড়িত থাকবে। ইতিমধ্যেই সৌদি আরব হচ্ছে ভারতের বৃহৎ তিন তেল সরবরাহকারীর একটি।

অবশ্য, দিল্লির এই অতিকল্পনা তৈরী হয়েছে কিছু অভিলাষি চিন্তা এবং রিয়াদের অস্পষ্ট কিছু বিবৃতির উপর ভিত্তি করে। যেমন, রিয়াদ ঘোষনা করেছে ভারত হচ্ছে আটটি দেশের মধ্যে অন্যতম যাদের সাথে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করতে আগ্রহী। মোটের উপর ভারতের আত্ম-বিভ্রান্তি পরিস্কার হয়েছে দিল্লির নীতি নির্ারকদের মধ্যে এই ধারণা থেকে যে কাশ্মীরের ব্যাপারে সৌদির অবস্থান আর পাকিস্থান ঘেঁষা নীতি, দু’টোরই পরিবর্তন হয়েছে।

শেষোক্তটি, অর্থাৎ পাকিস্থান ঘেঁষা নীতির পরিবর্তনের ধারণাটি দিল্লীর দিবা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই না। সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের ইসলামাবাদ সফরের সময় সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিটি এমন ছিলো যে, রিয়াদ কাশ্মীর ইস্যূতে ভারত এবং পাকিস্থানের মধ্যেকার উত্তেজনা প্রশমন করতে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এই বিবৃতিকে কোনভাবেই দিল্লির অবস্থানের স্বীকৃতি হিসেবে ধরে নেওয়া যাবে না। বরং এটি হচ্ছে তাদের দ্বিমুখী প্রকৃতির বদলে সমস্যায় নাক গলানো চেষ্টা।

মূল কারণ

অতএব, দিল্লির এই ব্যাপারে অতি আশাবাদি হওয়া উচিত হবে না যে অথনৈতিক বলয়ে সৌদি-ভারত সম্পর্ক রিয়াদকে ইসলামাদ থেকে দূরে সরাতে সফল করবে। এই উপসংহারে পৌঁছার মতো অনেক কারণ আছে। প্রথমত, নিজেদের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তার স্বার্থেই পাকিস্থান সৌদির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যার কারণে দিল্লিকে খুঁশি করতে গিয়ে তারা ইসলামাবাদের উপর বাজি ধরবে না।

পাকিস্থান সেনাবাহিনী অতীতে একাধিকবাদ সৌদি শাসকদের প্রিটোরিয়ান গার্ড হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও, সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের তার নিজ দেশে নিজের অনিশ্চিত অবস্থানের কারণে নিকট ভবিষ্যতে পাকিস্থানি মার্চেনারিদের সহযোগীতার দরকার হবে।

দ্বিতীয়ত, আফগানিস্থান হচ্ছে সৌদি এবং পাকিস্থান উভয়ের জন্য কৌশলগত মিলনকেন্দ্র। বিশেষ করে ১৯৮০তে যখন সোভিয়েতের বিরুদ্বে লড়াইরত ইসলামিক শক্তি এবং কাবুলে তাদের প্রক্সি সরকারকে সহায়তা করার জন্য সৌদি পাকিস্থানকে তাদের সরবরাহ চ্যানেল হিসেবে ব্যবহার করেছিলো। আফগানিস্থান থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নেওয়া এবং একই সাথে এই অঞ্চলে তালিবানদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারের ফলে তাদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পাকিস্থানের কৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে। সৌদি আফগানিস্থানে ইরানের প্রভাব কমাতে আগ্রহী। আর মার্কিন শক্তি চলে যাবার পরে ইরান তাদের মিত্র তাজিক এবং হাজারাদের মাধ্যমে এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তেহরানের এই প্রভাবকে ঠেকানোর জন্য সৌদির প্রয়োজন পাকিস্থানকে।

ইরানের ভুমিকা 

পশ্চিম এশিয়াতে ইরান সৌদি আরবের মাথা ব্যাথার অন্যতম কারণ। সৌদি-ইরান সমস্যা তাদের অঞ্চল ছাড়িয়ে সিরিয়া থেকে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনীর পক্ষে সৈন্য পাঠাতে নওয়াজ শরীফ সরকার অস্বীকার করা সত্ত্বেও রিয়াদ খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করছে যে ইরানের প্রভাব বৃদ্ধিকে ঠেকাতে পাকিস্থানের সক্রিয় অংশগ্রহন দরকার। দেখা যাচ্ছে যে পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এবং আর্মি প্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজ সৌদি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি বেশ নমনীয়। পাকিস্থান তাদের পক্ষ থেকে বুঝতে পেরেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের চমৎকার সম্পর্কের কারণে ক্রাউন প্রিন্স আমেরিকার সাথে তাদের মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। আফগানিস্থানে মার্কিন সৈন্যদের উপর আক্রমনকারী সন্ত্রসাীদের সমর্থন দেবার কারণে সম্প্রতি আমেরিকা-পাকিস্থান সম্পর্কে বেশ চিড় ধরেছে। যার ফল হচ্ছে মি. ট্রাম্পের কঠোর তিরস্কার এবং পাকিস্থানে মার্কিন সামরিক সহায়তা স্থগিত করা।

উপরন্তু, সিস্তান-বালুচিস্তান প্রদেশে সন্ত্রাসি হামলার প্রেক্ষিতে পাকিস্থান-ইরান সর্ম্পক সম্প্রতি খুবই নাজুক অবস্থায় পৌঁচেছে। এই হামলায় ইরানের ২৭ জন রেভ্যূলুশনারি গার্ডের সৈন্য নিহত হয়। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি এই হামলার জন্যর ‘কিছু আঞ্চলিক এবং বহি: গোয়েন্দা সংস্থা’র দিকে আঙ্গুল তাক করেছেন। নিশ্চিতভাবেই এটি পাকিস্থান এবং আমেরিকাকে নির্দেশ করে। ইরানিয়ান রেভ্যূলুশনারি গার্ডের কমান্ডার বলেছেন, “এই সমস্থ সন্ত্রাসী গ্রুপ গুলোকে আশ্রয় দেবার কারণে পাকিস্থানকে মূল্য দিতে হবে এবং নি:সন্দেহে এই মূল্য হবে অনেক চড়া”।

ইরানের সাথে সম্পর্ক নষ্ট হবার প্রেক্ষিতে স্বাভাবিকভাবেই পাকিস্থান সৌদি বলয়ের দিকে এগোবে। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা সুন্নী মৌলবাদ, ওয়াহিবিজমের পৃষ্ঠপোষকতা পাকিস্থানকে প্রকৃতিগতভাবেই সৌদির আদর্শিক মিত্রে এবং ইরানের আদর্শিক শত্রুতে পরিণত করেছে।

সাহায্য দুয়ার খুলে দেওয়া

পাকিস্থান তার অর্থনৈতিক বেহাল অবস্থার কারণে বাধ্য হয়েছে আইএমএফ থেকে কঠোর শর্তে ঋণ গ্রহন করতে। এই অবস্থায় সৌদির অর্থনৈতিক অনুদান পাকিস্থানের জন্য বিশাল কিছু। সৌদি আরব ইতিমেধ্য ৬ বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্যের ওয়াদা করার পরে ক্রাউন প্রিন্স নতুন করে আরো ২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এই বিনিয়োগের বড় অংশই ব্যায় হবে মাকরান উপকূলের গাওদারে একটি তেল শোধনাগার তৈরীতে। ইতিমধ্যে চীন এটিকে কৌশলগত বন্দর হিসেবে উন্নয়ন করেছে। চায়না-পাকিস্থান অর্থনৈতিক করিডোরের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই মাকরান উপকূল।

সৌদি এবং পাকিস্থানের কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্কের এই প্রেক্ষাপটে নয়া দিল্লির জন্য এটা বিশ্বাস করা চরম বোকামি হবে যে তারা সৌদি আরবকে পাকিস্থান থেকে দূরে সরাতে সমর্থ হবে। সৌদির সাথে যে কোন অর্থনৈতিক সম্পর্কের সুবিধা ভারত কাজে লাগাতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক-কৌশলগত বলয়ে রিয়াদের উপর খুব বেশি আশা পোষন করা তাদের উচিত হবে না।

মুহাম্মাদ আইয়ূব : মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির আন্তজার্তিক সম্পর্কের   প্রফেসর এমিরেটস এবং ওয়াশিংটন ডিসি’র সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসির  নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো । ভাষান্তর আহমেদ ইসমাইল হোসাইন