কাশ্মীরের নারীরা কেমন আছে

-

  • স্মিতা সিং
  • ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৩৯


‘যখন কাশ্মীর স্বাধীন হবে, আমার কবরে এসে তা জানিয়ে যেয়ো’

১৯৯১ সালের মার্চ মাসে আমার বয়স ছিল ১৩ বছর। ওই মাসে আমি কাশ্মীরে প্রথম যাই। বাবা সেখানে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং সিগন্যাল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। শ্রীনগরের ফাঁকা রাস্তাগুলো ধরে আমাদের গাড়িবহর হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিল। আমি বাইরে তাকিয়ে দেখি এখানে নীরব দেয়াল লিখনের সরব আর্তনাদ, ওখানে ‘ভারতীয় কুত্তারা ভাগ এখান থেকে, আমরা চাই স্বাধীনতা, হিজবুল মুজাহিদীন জিন্দাবাদ’। আরো দেখলাম, কিছু দুর্বোধ্য লেখা উর্দুতে। ক্যান্টনমেন্টে আমরা না ঢোকা পর্যন্ত এসব চোখে পড়ল। সেখানে বাংলো, সুন্দর সুন্দর লন, গাছের সারি বাঁধানো চত্বর আর জলপাই সবুজ রঙের ইউনিফর্ম। এগুলো আরামদায়ক ও পরিচিত।
বছরটি ছিল কানুন পোশপুরা ধর্ষণের ঘটনার। চতুর্থ রাজপুতনা রাইফেলসের সেনাসদস্যদের দ্বারা গ্রামটির মহিলাদের গণধর্ষণের অভিযোগে কাশ্মীর হয়ে উঠেছিল প্রজ্বলিত। গ্রামবাসীরা বলেছিলেন, ’৯১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পুরুষদের পাকড়াও করা হয় জেরা করার জন্য; অপর দিকে সৈন্যরা তাদের ঘরে ঘরে ঢুকে মহিলাদের করেছে ধর্ষণ। এর শিকার হয়েছেন ২৩ থেকে ১০০ জন, যাদের মধ্যে ১৩ বছরের কিশোরী থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধাও আছেন। ধর্ষিতা হয়েছেন বিবাহিতা, অবিবাহিতা, গর্ভবতী। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়া বহুবার অভিযোগ করেছে, ‘এমন একটা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হয়নি। এর সাথে দেখা দিলো ব্যাপক বিক্ষোভ এবং আরো সহিংসতা। এত কিছুর পর প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়াকে সেনাবাহিনী অনুরোধ করে তদন্ত কমিটি গঠনের জন্য। তারা সেখানে তদন্ত করতে গেলেন। কিন্তু প্রেস কাউন্সিল না সরকারি সংস্থা, আর না কোনো তদন্তকারী প্রতিষ্ঠান। পুলিশ কোনো দিন ওই ঘটনার তদন্ত করেনি। কারণ হিসেবে বলা হলো, এএসপি দিলবাগ সিং ছুটিতে গেছেন। এরপর জুলাই মাসের মধ্যে তাকে এই অঞ্চলের বাইরে বদলি করা হলো। অপর দিকে প্রেস কাউন্সিলের কমিটি বলল, সেনাবাহিনীর ইমেজ নষ্ট করার জন্য জঙ্গিদের উসকানিতে এবং বিদেশের হস্তক্ষেপে ভুয়া অভিযোগ তোলা হয়েছে।


১৮ বছর পর আরেক গ্রীষ্মে কাশ্মীরে ফিরলাম আবারো বিক্ষোভের মধ্যে। ২০০৯ সালের ৩০ মে নিলুফার (২২) এবং তার ননদ আসিয়ার (১৭) লাশ আপেলের শহর শোপিয়ানের একটি ঝর্ণায় পাওয়া যায়। পোস্টমর্টেমে ধর্ষণ ও খুনের আলামত মিলেছিল। তাদের পরিবার ও স্থানীয় লোকজন সন্দেহ করলেন, এ ঘটনা নিয়ে কারচুপি করা হচ্ছে। ছয় মাসের মতো সময় লেগে যায় তিনবার পোস্টমর্টেম, একবার কবর থেকে লাশ উত্তোলন, চার পুলিশ কর্মকর্তা বরখাস্ত, ছয়জন ডাক্তার, পাঁচজন আইনজীবী এবং দুই সাক্ষীর বিরুদ্ধে চার্জশিট ইত্যাদি সারতে। ইতোমধ্যে বিক্ষোভ-প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে শত শত মানুষ হলো আহত। সিবিআই উপসংহার টেনে দিলো, ‘না, ধর্ষণ কিংবা খুনের কোনো ঘটনাই ঘটেনি’। তদুপরি সিবিআই নিরাপত্তা বাহিনীকে হেয় করার জন্য মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ার অভিযোগ এনেছিল ১৩ জনের নামে। বলা হলো, ‘রামবি আরা নালা নামের ঝর্ণাটিতে ডুবেই ভাবি-ননদ প্রাণ হারিয়েছে। যদি তা সত্য হয়, এটা হবে স্মরণকালের মধ্যে সেখানে ডুবে মরার সর্বপ্রথম ঘটনা। ওই ঝর্ণায় ডুবে কেউ কোনো দিন প্রাণ হারায়নি।


জুন ২০০৯ : ‘বন্ধ’ পালনের আহ্বান ছিল সুস্পষ্ট। কেবল বিব্রত ও উত্তেজিত, বাদামি ও সবুজ পোশাক পরা লোকরা জড়ো হলো দলে দলে। তারা মানুষজনকে থামিয়ে তল্লাশি করল; আর বাঙ্কারের মধ্যে বালুর বস্তা ও বুলেটপ্রুফ কাঁচের আড়াল থেকে নজর রাখছিল। জীবনে এই পয়লাবার গাড়ি করে সেনা চেকপয়েন্ট পার হলাম, যখন ওরা কোনো স্যালুট দেয়নি। আমি ছিলাম বেসামরিক যানে। আমাদের বলা হলো গাড়ি থেকে নামতে। একজন সশস্ত্র সৈন্য জানাল, গাড়ির সব চাকা খুলে নিয়ে ভালোভাবে তল্লাশি করে দেখা হবে। তখন উপলব্ধি করলাম, আমার বিয়ে হয়েছে একজন কাশ্মীরি মুসলিমের সাথে। টের পেলাম, ক্যান্টনমেন্টের এ পাশে বেসামরিক পরিচয়ে আসার ধকলটা কী।


বন্ধ, কারফিউ এবং বিক্ষোভের মধ্যে জীবন কাটানো অন্য রকম অভিজ্ঞতা বৈকি। কেননা, এ অবস্থায় মন ছাড়া আর সব কিছু স্থবির হয়ে পড়ে। তখন কিছুই করার উপায় থাকে না; যাওয়া যায় না কোথাও। কী আর করা; পরিজন ও বন্ধুবান্ধব মিলে চা খেতে খেতে জমায় আড্ডা।
একজন কলেজছাত্র বলছিল অমরনাথ তীর্থের ভূমিবিরোধ নিয়ে যে উত্তেজনা ঘটেছিল, সে কথা। টানা এক মাস ধরে বনধ চলেছিল পুরোপুরি। না টিভি অনুষ্ঠান, না খবর, আর না স্কুল-কলেজ। রেশনের সাপ্লাই পর্যন্ত বন্ধ। এর সাথে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ। ....মনে হচ্ছিল একটু সরব না হলে আমরা পাগল হয়ে যাবো। নিরাপত্তা বাহিনীকে উপেক্ষা করে বিক্ষোভকারীরা সাহসের সাথে নেমে এসেছিল রাস্তায়। কেবল তখন আমরা অনুভব করলাম, না, বেঁচে আছি। আমরা তাদের জন্য খাবার বানিয়ে জানালা দিয়ে এবং ব্যালকনি থেকে প্যাকেটে করে জোগান দিতাম।’


এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা লোকসান দেয়; ছাত্রছাত্রী ডিগ্রি নিতে পারে না; বৃদ্ধ ও অসুস্থরা পারেন না নিতে চিকিৎসা। তবুও বনধের ডাকে সাড়া দিয়ে নৈতিক ও বস্তুগত সাহায্য-সমর্থনের জোয়ার আসে চার দিক থেকে। ছোট্ট শহর শোপিয়ানে দু’টি মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। তাই এই বন্ধ।


কলেজছাত্রটি বলেছে, ‘ওই দু’জনের মধ্যে ছিল আসিয়া জান। অঙ্কে ছিল খুব পাকা। পত্রিকায় এ খবর পড়েছি। আপনি কি তা জানেন?’ মাথা নাড়ি। বাঙ্গালোরে যে পত্রিকা পড়েছি, এতে যে ওদের নাম নেই।


পড়শিদের একজন ভারতবিরোধী স্লোগানের ভিডিও ক্লিপ এনেছেন সবাই মজা করার জন্য। সেলফোনে এসব দেখা যায়। পুরুষরা উত্তেজিত কণ্ঠে চিৎকার দিলো, ‘রাগদো রাগদো, ইন্ডিয়া রাগদো।’ শুনে মেয়েরা হাসিতে ভেঙে পড়ছিল।


১৯৯০-এর দশক : শফিক (৩৩) তার তারুণ্যের দিনগুলো মনে করছে। ঘেরাও আর তল্লাশির সেসব দিন। ‘আমার বয়স ১৪, তখন এক চাচাতো ভাই ও আমাকে ধরে স্কুলমাঠে নিয়ে গেল। পুরো পথ পিঠে রাইফেলের গুঁতা খেয়েছি। সে মাঠে শনাক্তকরণ প্যারেড হচ্ছিল। আপনাকে এই পথে মিলিটারিদের গাড়িগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে আসতে হয়েছে। এই গাড়িতে সৈন্যদের জনৈক চর বসা ছিল। লাউড স্পিকারে চড়া সুরে হিন্দি সিনেমার গান বাজলেও চিৎকার শুনতে পাবেন। এতে বুঝতে পারবেন, জেরা চলছে। কাউকে শনাক্ত করা হয়েছে। মনে পড়ে, একবার বাবা আমাকে চড় মেরেছিলেন লাল জামা পরায়। কারণ, রঙ বিপদ ডেকে আনে। রঙের দরুন আপনি আরো বেশি নজরে পড়ে যাবেন।... আপনাকে নিয়ে গিয়ে প্যারেড করানোর পর বসে দেখবেন, চাচা-মামা, ভাই, বন্ধুরা একই কাজ করছেন। ধনী-গরিব, বুড়ো কী জওয়ান, শত শত মানুষ বৃষ্টি, বরফ বা কড়া রোদের মধ্যে ঘণ্টাকে ঘণ্টা এখানে পড়ে থাকতে হয়।


রমজান মাসে মসজিদ থেকে ইফতারির আহ্বান ভেসে আসত। তখনো আমরা গরু-ছাগলের মতো ঠাসাঠাসি, গাদাগাদি করে বসে আছি। বুড়োদের কেউ কেউ রোজা ভাঙার জন্য হাতের তালুর ঘাম জিহ্বা দিয়ে লেহন করতেন। আমরা জানতাম, আমাদের কয়েকজন আর কোনো দিন পরিবার-পরিজনকে দেখতে পাবে না।... দেখবে না কোনো কড়া রঙ, শুনবে না চড়া সুর।’


পরের বছরগুলোতে হাজার হাজার কাশ্মীরি চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। আর অনেককে পাওয়া গেছে অচিহ্নিত কবরে।
যা হোক, পরদিন শ্রীনগরে যথারীতি জীবনযাত্রা শুরু হলো। আমরা অনুভব করলাম, রুটিনমাফিক ডাল হ্রদ আর উদ্যানে বেড়াতে বাধ্য হচ্ছি। প্রতিটি ছবির পেছনে বাঙ্কার। প্রত্যেক উদ্যান ভারতীয় ট্যুরিস্টে টইটম্বুর। তাদের কয়েকজন সৈন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে খুশিতে ছবি তুলছিল। আমরা সৈন্যদের চোখে চোখ রেখে সাবধানে তাদের এড়িয়ে গেলাম। এক চাচাতো ভাই টিপ্পনি কেটে বলল, ‘এ যে ফিলিস্তিনে বনভোজনের মতো।’ গেট পেরিয়ে ঢুকলাম ক্যান্টনমেন্টে। বহু দিনের পরিচিত, আরামদায়ক এলাকাটি আজ বৈরী, নাগালের বাইরে।


ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ি। লালবাত্তির স্টাফ কারগুলো এর কারণ। মনে হলো, কোনো মন্ত্রীর তাড়া আছে। কাশ্মীরিদের রসবোধ সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ পায় নির্বাচন ও সরকারের কথা উঠলে। এখানে একটা জোক বেশ জনপ্রিয়। স্কুটারে যাচ্ছিল বাপ আর ছেলে। ফারুক আবদুল্লাহর লালবাত্তি গাড়ির পাশে ট্রাফিকের সিগন্যালে স্কুটার থামাতে হলো। ছেলের প্রশ্নের জবাবে বাবা বললেন, ‘সামনে ওই যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বসে আছেন।’ আর পেছনে বসা বালক ওমরকে (আবদুল্লাহ) দেখিয়ে বললেন, ‘ওই যে তোমাদের মুখ্যমন্ত্রী’। এক কাশ্মীরি চাচা চুটকিটা শুনিয়েছেন।


বাড়ি ফিরলাম, যখন টিভির নিউজের সময় হয়ে গেছে। কাশ্মীরের যুবকরা ভারতীয় মিডিয়ার নাম দিয়েছে ইখওঘউওঅ মেডিক্যাল শিক্ষার্থী শীবা বলল, ‘তাদের প্যানেল আলোচনা ও টক শো করার জন্য কাশ্মীরে আসা উচিত। আমাদের পত্রিকাগুলোর টুঁটি চেপে রাখা হয়েছে। রিপোর্টাররা অবশ্য ছোটাছুটি করার স্বাধীনতা পায়। আমাদের এখানে ধর্ষণ ও হত্যা ঘটলেও তারা রিপোর্ট করেন না। কেন শোপিয়ানের ঘটনার তদন্ত হলো না? মনে হয়, পাথর ছোড়া কিংবা নিহত হওয়ার আগে আমাদের অস্তিত্ব থাকে না।’


এই আর্তচিৎকার, সোচ্চার ক্ষোভ, অনস্তিত্বের যাতনায় কুঁকড়ে যাওয়া এসব তো কাশ্মীরে নতুন নয়। ভারতের দারিদ্র্যের মতো কাশ্মীরের ভূপ্রকৃতিকেও শত শত বছর ধরে নানাভাবে তুলে ধরা হয়েছে। কাশ্মীরিদের চিত্রিত করা হয়েছে ষড়যন্ত্রী, বিশ্বাসঘাতক থেকে শুরু করে অসহায় শিকার ও দাবার ঘুঁটি হিসেবে। বলা হয়েছে, তারা বীরোচিত ভূমিকা রাখতে জানে না; কারো নেই উদ্যম। এই আয়না তাদের জন্য অবমাননাকর।


আমার স্বামী জানালেন একজন প্রপিতামহের মৃত্যুশয্যার কামনা। তিনি বলেছিলেন আপনজনকে ‘যখন কাশ্মীর স্বাধীন হবে, আমার কবরে এসে তা জানিয়ে যেয়ো।’ তিনি মহারাজা হরি সিংয়ের আমলে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। হয়তো অনেক দূরের স্বপ্নের মতো বর্তমান প্রজন্মের কাছ থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে স্বাধীনতা। তবে তাদের জরুরি দাবি, তাদের অস্তিত্বের এবং আমাদের (ভারতের) দায়দায়িত্বের স্বীকৃতি দেয়া। জনপ্রিয় মিডিয়া, সরকারি প্রচারণা এবং জাতীয়তাবাদের বাগাড়ম্বর নির্দেশিত কাঠামোর বাইরে গিয়ে কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা করতে আমরা অপারগ। এ কারণেই কাশ্মীর ভূখণ্ড ও কাশ্মীরি জনগণ, উভয়ের ক্ষেত্রে আমরা আজ ব্যর্থ।


লেখিকা : বিবিসি ওয়ার্ল্ড, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এবং ভারতের জাতীয় নেটওয়ার্কগুলোর সাথে সম্পৃক্ত ফ্রিল্যান্স টিভি সাংবাদিক। (হার্ড নিউজ-এর সৌজন্যে)