সৌদি-কাতার সমঝোতার পেছনের ভূ-রাজনীতি

-

  • মোতালেব জামালী
  • ০৭ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:০৯

দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর পর ৫ জানুয়ারি কাতারের ওপর আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহার করেছে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় দেশগুলো। এর মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশ দুটির সম্পর্ক আবারো স্বাভাবিক হলো।

কুয়েতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আহমদ নাসের আল সাবাহ এক বিবৃতিতে সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের কথা জানান। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে চলমান উত্তেজনার অবসান ঘটবে বলে আশা করা হয়।

উপসাগরীয় আরব দেশগুলোর মধ্যে পারস্পারিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৮১ সলে গঠন করা হয় গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি)। বর্তমানে এটির নাম রাখা হয়েছে কো-অপারেশন কাউন্সিল ফর দ্য আরব ষ্টেটস অব দ্য গালফ। সৌদি আরব, কাতার, ওমান, বাহরাইন, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কুয়েত এই ৬টি দেশ হচ্ছে সংগঠনটির সদস্য। মূলত এটি একটি বাণিজ্য ব্লক।

পারস্য উপসাগরের পশ্চিম প্রান্তে ছোট দেশ কাতারের আয়তন ৪ হাজার ৪শ ৮৯ বর্গমাইল। ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেনের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। কাতারকে স্বীকৃতি প্রদানকারি দেশগুলোর মধ্যে আরব দেশগুলো সামনের সারিতে ছিল। একই বছরে কাতার জাতিসংঘ ও আরব লীগের সদস্যপদ লাভ করে। ১৯৮৮ সালে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিষ্ট চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। বর্তমানে দেশটির জনসংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। কেবলমাত্র সৌদি আরবের সাথেই কাতারের স্থল সীমান্ত রয়েছে।

ইয়েমেনে সরকার ও হুথি বিদ্রোহীদের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছে তাতে কাতারের যোগ দেয়াকে কেন্দ্র করেই মূলত: কাতারের সাথে সৌদি আরবের বিরোধ তুঙ্গে উঠে। ইয়েমেনের সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব এবং সশস্ত্র হুথি বিদ্রোহিদের সমর্থন দিচ্ছে ইরান। ইয়েমেন যুদ্ধ সৌদি-আমিরাতি পক্ষ নিতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয় ইরানের সাথে ভারসাম্যমুলক সর্ম্পক রক্ষা করে চলে। এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে দেশটির উপর অবরোধ আরোপ ও সব সম্পর্ক ছিন্ন করে সৌদি আরব ও তার মিত্ররা। এতে বেকায়দায় পড়ে কাতার।

২০১৭ সালের ৫ জুন কাতার ও সৌদি আরব জিসিসিভূক্ত দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি হয়। সৌদি আরব ও তার নেতৃত্বাধীন জোটের সদস্য বাহরাইন, মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত কাতারের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেয়ার অভিযোগ আনে এবং দেশটির উপর অবরোধ আরোপ করে। এসব দেশ কাতারের সাথে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তাদের অভিযোগ ছিলো- ২০১৪ সালে জিসিসিভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল কাতার তা লংঘন করেছে। কাতারের উপর অবরোধ আরোপের এই উদ্যোগে যোগ দেয় মালদ্বীপ, মৌতিানিয়া, জিবুতি, ইয়েমেন, সেনেগাল, কমোরোস ও লিবিয়ার তবরুক ভিত্তিক সরকার।

সৌদি-কাতার বিরোধ অবসানে মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে কুয়েত। কুয়েতকে সমর্থন দিয়েছে জিসিসি’র আরেক দেশ ওমান। দু’টি দেশই চলমান বিরোধে কোন পক্ষকে সমর্থন না করে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করেছে। তাদের যৌথ চেষ্টায়ই উপসাগরীয় অঞ্চলে জিইয়ে থাকা এই বিরোধ অবশেষে মিটে গেল। তারাই দু’পক্ষকে আলোচনার টেবিলে এনেছে। বিশেষ করে কুয়েতী কর্মকর্তাদের জন্য এটি একটি বড় সাফল্য।

যদিও যুক্তরাষ্ট্র এই চুক্তির বিরুদ্ধে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের বেশকিছু ডেমোক্রেট দলীয় সদস্য সৌদি যুবরাজ সালমানের বেশকিছু কর্মকান্ডকে ভালোভাবে নেয়নি। যুবরাজ সালমানের কর্মকান্ড সৌদি আরবের ইমেজকেও অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহনের পর সৌদি আরবের বা জিসিসিভূক্ত দেশগুলোর ব্যাপারে কি নীতি গ্রহন করেন তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে সৌদিসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে।

স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী আসন্ন জিসিসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য সৌদি আরব কাতারের জন্য তার স্থল, নৌ ও আকাশ সীমান্ত খুলে দেয়। বিনিময়ে কাতার তার উপর অবরোধ আরোপকারি দেশগুলোর বিরুদ্ধে গৃহীত আইনী পদক্ষেপ প্রত্যাহার করতে রাজি হয়।

তবে সৌদি-কাতার সমঝোতার ফলে জিসিসিভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে সব বিরোধের অবসান ঘটবে তা এখনও বলা যাবে না। এমনকি সৌদি-কাতার বিরোধের মূল কারণও দূর হবে না। তবে এটা আঞ্চলিক স্থিতীশীলতা সৃষ্টির পথকে যে অনেকটাই সুগম করবে তা নি:সন্দেহে বলা যায়।

সৌদি-কাতার সমঝোতা সম্পর্কে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আটলান্টা কাউন্সিলের কর্মকর্তা বারবারা স্লেভিন মনে করেন, এই সমঝোতার ফলে জিসিসিভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা আকস্মিক বেড়ে যাবে- এমনটা আমি মনে করি না। কারণ তারা তারা গত ৪০ বছরে তাদের সামরিক বাহিনীগুলোর মধ্যেই তো আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। আর বাইরের শক্তিগুলোর সাথে এসব দেশের নানা ধরণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে।

সৌদি নেতৃত্বাধীন দেশগুলো অবরোধ আরোপের পর সেসব দেশের পক্ষ থেকে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার শর্ত হিসেবে কাতারকে ১৩ দফা দাবি দেয়া হয়েছিল মেনে নেয়ার জন্য। কিন্তু কাতার তাদের সেসব দাবি বা শর্ত গত সাড়ে তিন বছরেও মেনে নেয়নি। স্বাক্ষরিত চুক্তিতে কাতারকে ভবিষ্যতে এসব শর্ত মেনে নিতে হবে এমন কথাও বলা হয়নি। তার পরও সৌদি আরব সমঝোতা করেছে যেটা কাতারের জন্য একটি বড় সাফল্য। সৌদি-কাতার সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ফলে এই অঞ্চলের অন্য শক্তিধর দেশগুলোর কি লাভ-লোকসান হলো তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।

মধ্যপ্রাচ্যর অন্যতম প্রভাবশালী দেশ তুরস্কের জন্য এ খবরটি ইতিবাচকই বলা যায়। ২০১৭ সালের মাঝামাঝি যখন এই সংকট শুরু হয় এবং কাতারের উপর অবরোধ আরোপ করা হয় তখন তখন তুরস্কই প্রথম কাতারের উপর অবরোধ আরোপের বিরুদ্ধে জোরালো ভাষায় কথা বলেছিল। প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোগান এই অররোধকে ‘অনৈসলামিক’ আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি কাতারকে সার্বিক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে অবরোধের মোকাবেলায় নিজেদের অবস্থানে অটল থাকতে বলেছিলেন।

তুরস্ক সব সময়ই সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু উপসাগরীয় সংকট তুরস্কের এই চেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এখন যেহেতু সৌদি-কাতার সম্পর্ক আবার জোড়া লেগেছে, সে কারণে রিয়াদের সাথে আঙ্কারার সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। নতুন বছরে তুরস্কের সাথেও রিয়াদের সম্পর্ক আরো গভীর হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আঙ্কারা এখন কাতারের সাথে তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ঠিক রেখেই রিয়াদের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটাতে পারবে। তুরস্কের সহায়তায় কাতার অবরোধ আরোপকারী দেশগুলাকে অগ্রাহ্য নিজের অবস্থানে অটল থাকয় তুরস্ক এই অঞ্চলে একটি প্রভাবশালী দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কাতারের উপর অবরোধ আরোপের কারণে দেশটির সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তুরস্ক দেশটিতে সামরিক বাহিনী পাঠিয়েছে। এছাড়া উভয় দেশ যৌথভাবে সামরিক ঘাটিও স্থাপন করেছে।

অন্যদিকে-সৌদি-কাতার সম্পর্ক পুন:স্থাপনের ঘটনায় কিছুটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইরান। ৪০ বছর আগে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ গঠিত হবার পর থেকেই দেশটি এই আঞ্চলিক সংস্থায় ভাঙ্গন ধরানোর চেষ্টা করে আসছে। একথা সবাই স্বীকার করবে যে সাড়ে তিন বছর আগে সৌদি-কাতার বিরোধ সৃষ্টির পর এ ঘটনায় ইরানই সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে এবং কাতারের সাথে সম্পর্ক নতুন উচচতায় নিয়ে গেছে। ইরানের বিভিন্ন অবকাঠামো ব্যবহার করা ছাড়া কোন কাতারের সামনেও কোন উপায় ছিল না। সৌদি আরবের সাথে বিরোধ সৃষ্টির পর থেকে ইরানের স্থলবন্দর এবং আকাশ পথ ব্যবহার করেছিলো কাতার। চাপ অগ্রাহ্য করে নিজের অবস্থানে অটল থাকতে হলে গ্যাস সমৃদ্ধ কাতারের তুরস্ক ও ইরানের সাথে যাওয়া ছাড়া আরা কোন উপায় ছিল না।

সৌদি আরবের সাথে চুক্তি করা সত্বেও ইরান বিরোধী আরব দেশগুলোর কোন জোটে কাতার যাবে না। আগামী দিনগুলোতেও দোহা কখনোই রিয়াদকে পরিপূর্ণভাবে বিশ্বাস করবে না। আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতির বর্তমান অবস্থান ও আগামী দিনের কথা মাথায় রেখে দোহা কখনোই তেহরানের সাথে সম্পর্ক শীতল করতে চাইবে না। তেহরানকে কোনঠাসা করতে যুক্তরাষ্ট কিংবা সৌদি আরবের কোন দাবি কাতার সহজে মেনে নেবে না।

আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেই ইরানের সহযোগিতা কাতারের প্রয়োজন হতে পারে।

সৌদি আরব কাতারের উপর আরোপিত অবরোধ প্রত্যাহার বা শিথিল করায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত রিয়াদের উপর বেশি ক্ষুব্ধ। কাতারের সাথে ইউএই’র বিরোধের মূল জায়গাটা হচ্ছে রাজনৈতিক ইসলাম। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে নতুন শক্তির ভরকেন্দ্র কোনটা হবে তা উপসাগরীয় দেশগুলোর সমর্থন করা বা না করার প্রশ্ন নিয়ে বিরোধ আছে।

এ বিষয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক স্যামুয়েল রামানী তার টুইটে বলেছেন, জিসিসি সম্মেলনের পর কাতারের ব্যাপারে ইউএই’র কট্টর অবস্থানের কোন পরিবর্তন হবে- এমনটা বিশ্বাস করা খুবই কঠিন। আদর্শিক বিরোধের বাইরেও এ দুটি দেশের মধ্যে উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা ও উত্তর আফ্রিকায় বিভিন্ন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় ও কাতার-তুরস্ক সম্পর্ক নিয়ে তীব্র বিরোধ রয়েছে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে তুরস্ক অপারেশন পিস স্প্রিং শুরু করার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত তুরস্কের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠনের চেষ্টা শুরু করে। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরব আমিরাতের এই উদ্যোগে কতটা সফল হবে তা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। কারণ সৌদি আরব যদি আরব আমিরাতের তুরস্ক বিরোধী জোট থেকে দূরে থাকে তাহলে এ অঞ্চলের পরিস্থিতি অনেকখানি বদলে যাবে। সৌদি আরবের সাথে কাতার ও তুরস্কের সাথে সম্পর্কের উন্নতি হলে লিবিয়া থেকে শুরু করে করে পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল এবং আফ্রিকা পর্যন্ত এর একটি বড় প্রভাব পড়তে পারে।