প্রবাসী শ্রমিকরা কেমন আছে

ছবি - সংগৃহীত

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০৬ এপ্রিল ২০২০, ১৯:০৩

করোনা ভাইরাস আজ সারা বিশ্বে প্রাণসংহারী রূপ নিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশও এ মূর্তিমান আতঙ্কের বাইরে নয়। বাংলাদেশে এ প্রাণঘাতী রোগ কিভাবে ঢুকতে পারলো তা নিয়ে নানা মুণির নানা মতের একটি হলো, ইতালি প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে করোনা দেশে ঢুকেছে। কেউ বা আবার বলেন ভিন্ন কথা। এ নিয়ে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন এমনকি খোদ পররাষ্ট্র মন্ত্রীও। মোটের ওপর করোনাকে কেন্দ্র করে আমরা সবাই যে যার মতো করে প্রবাসীদের ওপর একচোট নিলাম। বলা হলো, ওদের ওই সময় দেশে ঢুকতে না দিলেই হতো! প্রশ্ন হলো, এমন দুর্যোগেও যারা দেশ বাড়ি স্বজন সব ছেড়ে বিদেশের মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন, তারা কেমন আছেন?

করোনা পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যখন লকডাউন হয়েছে। মালিকরা বন্ধ করে দিয়েছে বেতন দেয়া। করোনা ভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় বিদেশি শ্রমিকদের জোর করে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে অথবা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আইসোলেশনে । এমন পরিস্থিতিতে লাখ লাখ প্রবাসী শ্রমিক কী করে ভালো থাকেন? আসুন দেখা যাক, উপসাগরীয় এলাকার প্রবাসীরা কেমন আছেন।
উপসাগরীয় দেশ কাতারের রাজধানী দোহা-র অভিজাত এলাকায় বেশ কিছু লোকের শরীরে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ার পর হাজার হাজার প্রবাসী কর্মীকে দোহা শিল্প এলাকায় কঠোর কোয়ারেন্টিনে নেয়া হয়। তাদেরই একজন হলেন ২৭ বছর বয়সী এক পাকিস্তানি ইঞ্জিনিয়ার। বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরুতে তিনি একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থাকে বলেন, গত আট-দশ দিন ধরে কোয়ারেন্টিনে আছি। জানি না, কবে এটা শেষ হবে। সরকার আমাদের শুধু খাদ্য দিচ্ছে, আর কিছুই না। কিন্তু দৈনন্দিন জীবনে তো টুকটাক আরো অনেক কিছুর দরকার পড়ে। সেসবের কিছুই আমরা পাচ্ছি না।

প্রবাসী কর্মীদের এমন অবস্থা দেখেই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ বলছে, পুরো উপসাগরীয় এলাকায় কমর্রত প্রবাসী শ্রমিকদের জীবন ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, তাদের আবাসনব্যবস্থা ভাঙাচোরা, স্যানিটেশনব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয় আর চিকিৎসাসুবিধা তো বলতে গেলে নেইই।

এসব কর্মীর বেশিরভাগেরই বেতন বকেয়া পড়ে গেছে। কারো চাকরি চলে গেছে। কাউকে আবার জোর করে দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থা এসব কর্মীর পরিবারে বিপর্যয় ডেকে আনবে। কারণ, তাদের আয়েই তো তাদের পরিবার চলে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর উপসাগরীয় এলাকা বিষয়ক গবেষক হিবা জায়াদিন এ প্রসঙ্গে বলেন, বিদেশি কর্মীরা এমনিতেই অসুবিধায় আছেন। কারণ, তাদের এমন একটি শ্রম আইনের অধীনে কাজ করতে হয়, যাতে বিদেশি কর্মীদের ওপর নিয়োগকর্তাদের অতিরিক্ত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নিয়োগকর্তারা এ সুযোগের অপব্যবহার করে কর্মীদের শোষণ করেন।

হিবা জায়াদিন বলেন, প্রবাসী কর্মীদের বাসস্থান ও ডিটেনশন সেন্টারগুলোতে করোনা ভাইরাস ঠেকাতে উপসাগরীয় দেশগুলো যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তা বদলানো উচিত। ওই অঞ্চলে এ পর্যন্ত ৩২শ' জন করোনায় আক্রান্ত বলে ধরা পড়েছে। আর তাতেই প্রবাসী কর্মীদের বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। এসব ক্যাম্প করোনা বিস্তারের জন্য আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা ওখানে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা একেবারেই অসম্ভব!
তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় এলাকায় এসব শ্রমিক এসেছে প্রধানত বাংলাদেশ, নেপাল, ভারত ও পাকিস্তান থেকে। এরা বিশ্বের মোট অভিবাসী কর্মীর ১০ শতাংশ। একটি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা তাদের খোঁজ নিতে গেলে তাদের অধিকাংশই বলেন যে তারা তাদের জীবন ও চাকরির নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তয় আছেন।

দেখা যাক সউদি আরবের অবস্থা। এ দেশটিতে এক কোটি বিদেশি শ্রমিক কাজ করে। এসব শ্রমিকের কেউ কেউ অভিযোগ করেন, করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় সউদি কর্মীদের যখন সবেতন কোয়ারেন্টিন ছুটি দেয়া হয়েছে, বিদেশি কর্মীদের তখন কাজ করতে বলা হচ্ছে। এক বিদেশি শ্রমিক বলেন, আমাকে বলা হয়েছে, শরীর ভাল না লাগলে তুমি ছুটি নিতে পারো, তবে বেতন পাবে না।
রিয়াদে একজন আরব কূটনীতিক সাংবাদিকদের বলেন, প্রাইভেট সেক্টরের বহু বিদেশি কর্মী তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়েছেন। কারণ, এসব মালিকের অনেকেই তাদের বিদেশি কর্মীদের বিনা বতনে ঘরে বসে থাকতে বাধ্য করছেন। অথচ এ দেশে সরকার বেসরকারি খাতকে ক্ষতিপূরণ দিচ্ছে। ওই টাকা তারা শ্রমিক কল্যাণে ব্যবহার না-করে নিজেদের পকেটে পুরছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় সর্বাধিক অভিবাসী কর্মী রয়েছে কুয়েতে ; ২৮ লাখ। এরমধ্যে অনেকে রয়েছেন মিশরীয়। কয়েকজন মিশরীয় ভাবছেন এভাবে ব্যবসায় প্রতিষ্টান বন্ধ করায় মালিকের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ভাবছেন। অবশ্য সবাই এতটা সাহসী নাও হতে পারেন। মালিকের ভয়ে অনেকে মুখ খুলতেই নারাজ। আবার অনেকে ভাবছেন, দেশে গিয়েই বা কী হবে! দেশের পরিস্থিতি তো আরো খারাপ।

সবাই জানেন, আগামী ২০২২ সালে বিশ্বকাপ ফুটবল অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে কাতারে। এ উপলক্ষে সাতটি নতুন স্টেডিয়ামই বানাচ্ছে দেশটি। আরো নানা নির্মাণযজ্ঞ তো আছেই। এ কাজে বিপুলসংখ্যক বিদেশি কর্মী নিয়োগ দিয়েছে দেশটি। বিদেশি কর্মীরা এখন ওই দেশের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কাতারেও করোনা ঠেকাতে সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলেও বিশ্বকাপ ফুটবল প্রস্তুতির কাজ থেমে নেই। স্টেডিয়াম ও অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ চলছে ধুমসে।

গ্যাসসমৃদ্ধ কাতারের শ্রমিক অধিকার নিয়ে মানবাধিকার গ্রূপগুলোর সমালোচনার মুখে শ্রমিক কল্যাণে বেশ কিছু ব্যবস্থা নেয় কাতার। কিন্তু ঘনবসতিপূর্ণ শিল্প এলাকা লকডাউন করে তারা আবার সমালোচনার মুখে পড়েছে। একজন পশ্চিমা নারী কূটনীতিক বলেন, কাতার সরকার একটি জায়গা খুঁজে বের করেছে, যা সহজে লকডাউন করা সম্ভব। প্রশ্ন হলো, ধনাঢ্য অভিবাসীতে ভরা কৃত্রিম দ্বীপগুলোর কোথাও কি তারা এ কাজ করতো? জানি না, করতো কি না।

কাতারের লকডাউন করা ওই এলাকাটি এখন পুলিস ঘিরে রেখেছে। কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের জীবন বাঁচাতে এর প্রয়োজন ছিল। লকডাউন করা এলাকায় বিপুল পরিমাণ চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে। যারা বেতন পাননি তাদের বেতনও দেয়া হবে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার দোহা অফিস জানিয়েছে, খারাপ পরিবেশে করোনা ভাইরাস জোরদার হতে পারে - এমন আশঙ্কায় অনেক নিয়োগকর্তাই তাদের কর্মীদের অপেক্ষাকৃত খোলামেলা জায়গায় সরিয়ে নিয়েছে। কেউ কেউ আবার স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নতি করেছে। শ্রীলঙ্কার এক কর্মী জানান, করোনা পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়ার পর তাদের বাসস্থান পরিচ্ছন্ন ও স্যানিটাইজড করা হয়েছে।
কিন্তু তবু প্রবাসীদের মন ভালো নেই। ওই শ্রীলঙ্কান কর্মী বলেন, আমার শুধু বাড়ির কথা মনে পড়ছে। আমার মা বারবার বলছেন দেশে ফিরে যেতে। ৪৯ বছর বয়সী এক তুর্কি সেলসম্যান করোনার ভয়ে সেলফ আইসোলেশনে চলে গেছেন। অন্য অনেক প্রবাসীর মতো তিনিও বেতন পাবেন না।

এদিকে করোনা বিষয়ক সরকারি নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার দায়ে ২০ জনের মতো নেপালী শ্রমিককে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে কাতার। নিজ দেশ প্রথমে তাদের ঢুকতে দিতে না চাইলেও পরে গ্রহণ করে।
এমন হ য ব র ল অবস্থায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও প্রশ্ন তুলেছে, তেলের দাম কমতে থাকায় উপসাগরীয় এলাকার অর্থনীতি যখন ক্রমেই নিম্নমুখী, কেউ জানে না করোনাসঙ্কট কবে কাটবে - এমন অবস্থায় কম্পানিগুলো কত দিন তাদের কর্মীদের বেতন দিয়ে যেতে পারবে? আর যেসব দেশ এ অঞ্চলের দেশগুলোতে শ্রমিক রফতানি করে তাদের অর্থনীতির ওপর এর যে প্রভাব পড়বে, তা এককথায় বিপর্যয় ডেকে আনবে। এ বিপর্যয় কিভাবে ঠেকানো যাবে, কেউ তা বলতে পারে না। এমনকি বিপর্যয়ের ভবিষ্যদ্বাণী করছে যে আইএলও, তারাও না।