করোনাভাইরাসের পেছনে কী ?

করোনাভাইরাস - সংগৃহীত

  • আসিফ মাহমুদ
  • ৩০ জানুয়ারি ২০২০, ১১:১৯


একটি অজনা ভাইরাস নিয়ে এখন দুনিয়া জুড়ে আতংক চলছে। চীনে অনেক মানুষের ফুসফুসের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করেছে এই ভাইরাস। অন্যান্য দেশেও এটি ধরা পড়েছে। করোনাভাইরাস এমন একটি সংক্রামক ভাইরাস - যা এর আগে কখনো মানুষের মধ্যে ছড়ায়নি। ভাইরাসটির আরেক নাম ২০১৯-এনসিওভি। এটি এক ধরণের করোনাভাইরাস। করোনাভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ছয়টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। তবে নতুন ধরণের ভাইরাসের কারণে সেই সংখ্যা এখন থেকে হবে সাতটি।


২০০২ সাল থেকে চীনে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স নামে যে ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছিলো সেটিও ছিল এক ধরণের করোনাভাইরাস। এই ভাইরাসে পৃথিবীতে ৭৭৪জনের মৃত্যু হয়েছিল। সার্সের মতো এই ভাইরাসেও বহু মানুষের প্রানহানির আশংকা করছেন বিশেষজ্ঞরা।  জ্বর দিয়ে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, এরপরে শুকনো কাশি দেখা দিতে পারে। প্রায় এক সপ্তাহ পরে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে যায়। অনেক রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হয়। প্রতি চারজনের মধ্যে অন্তত একজনের অবস্থা মারাত্মক পর্যায়ে যায় বলে মনে করা হয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে হালকা ঠান্ডা লাগা থেকে শুরু করে মৃত্যুর সব উপসর্গ দেখা দিতে পারে।


বিশ্বে বিভিন্ন সময় নতুন নতুন ভাইরাস সনাক্ত করা হয়েছে। সাধারন ভাবে এটি কোন একটি প্রানী থেকে এসে এসব ভাইরাস মানব শরীরে বাসা বাধতে শুরু করে। এর আগে সার্স ভাইরাস প্রথমে বাদুরের শরীর থেকে খট্টাশের শরীরে, এরপরে সেটা মানব শরীরে চলে আসে। ভাইরাসের উৎস প্রানীটি সনাক্ত করা সম্ভব হয়, তাহলে রোগটি মোকাবেলা করা অনেক সহজ হয়।


করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্ক আছে চীনের উহানের দক্ষিণ সমুদ্রের খাবারের পাইকারি বাজারের সঙ্গে। এখানে সামুদ্রিক প্রানীসহ জীবন্ত প্রানীও বিক্রি হয়ে থাকে, যেমন মুরগি, বাদুর, খরগোশ, সাপ- এসব প্রানী করোনাভাইরাসের উৎস হতে পারে। গবেষকরা বলছেন, চীনের হর্সশু নামের এক প্রকার বাদুরের সঙ্গে এই ভাইরাসের ঘনিষ্ঠ মিল রয়েছে।


বিশেষজ্ঞরা বলছেন চীনের বিশাল আকৃতি এবং জনসংখ্যার ঘনত্বের কারনে এই ভাইরাসটি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রথমদিকে চীনের কর্তৃপক্ষ বলেছিল যে, ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে ছড়াচ্ছে না। কিন্তু বর্তমানে এ ধরণের ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচেছ। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চীনা নাগরিকরা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন।


বিজ্ঞানীরা বলছেন, একেকজন সংক্রমিত ব্যক্তির মাধ্যমে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি রোগে আক্রান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ ছাড়া ব্যক্তিরাও ভাইরাসটি ছড়িয়ে দিতে পারেন। রোগটির প্রার্দুভাব উহানে হলেও থাইল্যান্ড, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ভিয়েতনাম, ফ্রান্স, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, নেপাল এবং যুক্তরাষ্ট্রে রোগী পাওয়া গেছে। ভাইরাসটি নিজে থেকে ধ্বংস হবে না। শুধুমাত্র চীনের কর্তৃপক্ষে নেয়া পদক্ষেপই এই মহামারীর অবসান ঘটাতে পারে। এই ভাইরাস প্রতিরোধ করতে কোন ভ্যাকসিন বা টিকা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। এই রোগ থেকে রক্ষার একমাত্র উপায় হলো অন্যদের মধ্যে ভাইরাসের সংক্রমণ হতে না দেয়। এজন্য বিশেষজ্ঞার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন যেমন আক্রান্ত এলাকায় মানুষজনের চলাচল সীমিত করে দেয়া। হাত ধুতে সবাইকে সবাইকে উৎসাহিত করা। রোগীদের আলাদা আলাদা করে চিকিৎসা সেবা দেয়া।


ভাইরাসটির যাতে বিস্তার না ঘটেন সেজন্য চীন সরকার উহান অঞ্চলটিকে একেবারে আলাদা করে ফেলেছে। আরো প্রায় একডজন শহরের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে পড়েছে প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ। অনেক এলাকায় বড় জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং অনেক পর্যটন এলাকা, যার মধ্যে চীনের গ্রেট ওয়াল রয়েছে, বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রাদুর্ভাবের মূল কেন্দ্রস্থল- উহানে নতুন একটি হাসপাতাল তৈরি করা হচ্ছে। মাত্র ১০দিনে যেখানে ১০০০ শয্যার হাসপাতাল তৈরির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ে এই হাসপাতাল নির্মান করা হচ্ছে।


উহান থেকে আসা ভ্রমণকারীদের পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যবস্থা করেছেন দক্ষিণ এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ। রোগটির প্রাদুর্ভাবের ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুতি নিতে বলেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে এগুলো কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে কারন রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে যদি পাঁচদিন লাগে, তাহলে কেউ একজন সহজেই অর্ধেক পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে ফেলতে পারবে এবং অসুস্থ বোধ করার আগেই এসব পরীক্ষানিরীক্ষা পার হয়ে যাবে। মানব শরীরের প্রথমবারের মতো ছড়িয়ে পড়ছে, এমন যেকোনো ভাইরাস নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারন রয়েছে। কারণ মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতার বাধা অতিক্রম করেই ছড়িয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশে করনোভাইরাসে আক্রান্ত চীনা নাগরিক পাওয়া গেছে। মালয়েশিয়া, ভারত ও কানাডাতেও এমন রোগির সন্ধান পাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এমন পরিস্থিতিকে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হিসাবে দেখা হচ্ছে।


এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিস্কার হয়নি। তবে রোগটির প্রতিষেধক আবিষ্কারের কাজ চলছে। আশা করা হচ্ছে মার্স ভাইরাসের প্রতিষেধক আবিষ্কারে যে গবেষণাটি চলছিল, সেটির কারণে এই কাজ অনেক এগিয়ে যাবে। কিন্তু এই ভাইরাস নিয়ে বিস্ময়কর এক মন্তব্য করেছেন একজন ইসরাইলি গোয়েন্দ গবেষক। আসুন জেনে নেই তিনি কী বলছেন।


চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর থেকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন ইসরায়েলের সাবেক সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তা ও জীবাণু অস্ত্র বিশারদ ড্যানি শোহাম। তিনি দ্য ওয়াশিংটন টাইমসকে জানিয়েছেন, উহানে চীনের গোপন জীবাণু অস্ত্র গবেষণা কার্যক্রমের ল্যাবরেটরি থেকে করোনাভাইরাস প্রথম ছড়িয়ে থাকতে পারে। এর আগে, রেডিও ফ্রি এশিয়া ২০১৫ সালের উহান টেলিভিশনের একটি প্রতিবেদন পুনঃসম্প্রচার করে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিতে রয়েছে চীনের সবচেয়ে উন্নত ভাইরাস গবেষণাগার। এখানেই একমাত্র ঘোষণা দিয়ে ভয়ঙ্কর প্রানঘাতি সব ভাইরাস নিয়ে গবেষণা চলছে।
ড্যানি শোহাম মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টর ডিগ্রিধারী।

১৯৭০ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ সারাবিশ্বে জীবাণু ও রাসায়নিক অস্ত্র এবং সমরনীতি নিয়ে কাজ করেছেন। তিনি ওয়াশিংটন টাইমসকে জানিয়েছেন, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির আড়ালেই জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে বেইজিং। তিনি জানিয়েছেন, ওই ইনস্টিটিউটের কয়েকটি গবেষণাগারে জীবাণু অস্ত্র নিয়ে গবেষণা চলে, যদিও জীবাণু অস্ত্র নিয়ে চীনের নীতিতে কোথাও এই গবেষণার কথা উল্লেখ করা নেই। এক ই-মেইল বার্তায় ওয়াশিংটন টাইমসকে ড্যানি শোহাম বলেন, সামরিক-বেসামরিক গবেষণার অংশ হিসাবে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে জীবাণু অস্ত্রের ওপর সেখানে কাজ পরিচালিত হয়। মেডিক্যাল মাইক্রোবায়োলজিতে ডক্টরেট করেছেন ইসরায়েলি সাবেক এই সামরিক কর্মকর্তা।কোনও ধরনের গোপন জীবাণু অস্ত্র গবেষণাগার থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিন ধরে প্রত্যাখ্যান করে আসছে চীন। কিন্তু গত বছর মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের চীনের গোপন জীবাণু যুদ্ধাস্ত্র গবেষণাগারে গবেষণা চলছে বলে জানায়।


ইসরাইলের এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার সাথে এখন পর্যন্ত কোনো বিশেষজ্ঞ একমত হননি। তার এই বক্তব্য ষড়যন্ত্র তত্ব হিসাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন বন্যপ্রানী থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে। চীনারা ইদুর, বাদুড়, সাপের মতো বন্যপ্রানী খেয়ে থাকে। ইতোমধ্যে চীনের কৃষি মন্ত্রণালয়সহ তিনটি মন্ত্রনালয় থেকে সব প্রজাতির বন্য প্রানীর উৎপাদন, পরিবহন ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করছেন করনো ভাইরাসের অনেক তথ্য গোপন করছে চীন। যা প্রকাশ করা হয়েছে তার চেয়ে বাস্তব পরিস্থিতি আরো খারাপ।