বুদ্ধিমান অস্ত্র বানানোর  চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতা

যুদ্ধাস্ত্রে সংযোজন করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা - সংগৃহীত

  •  হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ০২ ডিসেম্বর ২০১৯, ১২:৪৫

 

সারা পৃথিবীতে কোটি মানুষ যখন অনাহারী-অর্ধাহারী, তখনও বড়-বড় দেশগুলোর উন্মত্ত অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি। বন্ধ হবে কী, উল্টো আরো বেড়েছে। অথচ এক সময় মনে করা হতো, এক মেরুভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থা কায়েম হলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা আর থাকবে না। কিন্তু ভাবনাটি সত্য হয়নি। দুই সুপার পাওয়ার বা পরাশক্তির একটি - সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটেছে, রয়ে গেছে অপরটি ; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র প্রতিযোগিতা কি থেমেছে? এ প্রশ্ন করাই আজ অর্থহীন। কেননা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ হয়নি, বরং আরো বেড়েছে, এবং তাতে যোগ হয়েছে ও হচ্ছে নতুন মাত্রা। আজ আমরা তা নিয়েই কথা বলবো।


এতদিন অস্ত্রের পেছনে, তা যত দূরেই হোক, এক বা একাধিক মানুষ থাকা লাগতো। এখন অস্ত্রবাজ 'মানুষেরা' সেই মেহনতটিও বুঝি আর করতে চাইছে না। তারা এবার যুদ্ধাস্ত্রে সংযোজন করছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এ কাজে এগিয়ে আছে কমিউনিস্ট চীন। আর চীনের অগ্রগতি দেখে মাথা গরম হয়ে গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। তারাও সবরকম যুদ্ধসরঞ্জামে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজনে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে।


পেন্টাগন জানাচ্ছে, তারা যুদ্ধযান মেরামত থেকে শুরু করে সাইবার অস্ত্র ও ড্রোনের মতো জঙ্গি সরঞ্জামেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজনে কাজ করে যাচ্ছে। কারণ, যে দেশই প্রথম এ কাজটি পুরোপুরি সম্পন্ন করতে পারবে, আগামী বহু বছর কেউ আর তাদের যুদ্ধে হারাতে পারবে না। আর ঠিক এ কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ কাজে 'প্রথম' হতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। তারা খোলাখুলিই বলছে, হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চলে এসেছে স্থলে ও জলে, গত শতাব্দীতে তা ছড়িয়ে পড়ে আকাশেও। এখন যুদ্ধ আর সেভাবে হবে না, হবে মহাকাশে ও সাইবারস্পেসে। এমন যুদ্ধ আগে কেউ কখনো দেখেনি।


এমন এক অভূতপূর্ব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকা চীনের ইচ্ছা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজনের ক্ষেত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে 'বিশ্বের সেরা' হওয়া। দেশটির এই অভিলাষ ফুটে উঠেছে তাদের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর কথায়। তিনি বলেন, 'চীনকে অবশ্যই জটিল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির চূড়ায় উঠতে হবে'। তিনি আরো বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাব্যবস্থা ও অস্ত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ছাড়িয়ে যেতে হবে।


একটি ক্ষেত্রে চীন নিশ্চিতভাবেই এগিয়ে গেছে  বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। সেটি হলো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অত্যাধুনিক অটোনমাস ভেহিক্যাল নির্মাণ। বিষয়টি জেনে স্বভাবতই উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র। তারা নিজেদের উদ্বেগ গোপন না-করেই বলছে, যুদ্ধের আশঙ্কা আছে এমন অনেক স্থানেই চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি এ অস্ত্রটি মোতায়েনের লক্ষ্যে বেপরোয়াভাবে এগিয়ে চলেছে।


এছাড়া  প্রচলিত নানা অস্ত্র নির্মাণও বন্ধ করেনি চীন। মার্কিন নৌ-বাহিনীকে ঠেকাতে কম খরচে তারা বানাচ্ছে মানুষবিহীন দূরপাল্লার সাবমেরিন। শুধু তা-ই নয়, চীন এখন মধ্যপ্রাচ্যে রফতানি করছে প্রাগ্রসর সামরিক ড্রোন, যাতে আছে রেডার ফাঁকি দিতে সক্ষম স্টিলথ ড্রোনও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এই ভেবে মাথার চুল ছিঁড়ছে যে, চীনা অস্ত্রনির্মাতারা এমন ড্রোনও রফতানি করছে, যা নিজেই প্রাণঘাতী হামলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। খুলে বলি, এসব ড্রোন নিজেই ভাবতে ও স্থির করতে পারে যে, হামলা চালাতে মানুষের সাহায্য তার প্রয়োজন আছে কি না।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, দেশবাসীর ওপর কমিউনিস্ট পার্টির কর্তৃত্ববাদী শাসনের নাগপাশ আরো কঠিন করার মতলবেও চীনা শাসকরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।  দেশটির সিনচিয়াং প্রদেশের প্রায় ১০ লাখ উইঘুর মুসলিমকে কারারুদ্ধ করে রাখার প্রতি ইঙ্গিত করে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিমত, সব রকম লক্ষণ  বলে দিচ্ছে যে নজিরবিহীন মাত্রায় মানুষের বক্তব্য সেন্সর করা এবং মৌলিক মানবাধিকার হরণ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে চীনা শাসকরা। তারা একুশ শতকে একটি ''নজরদারি রাষ্ট্র' প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতে, বিদেশী সংস্থা ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলো অনিচ্ছা অথবা অসতর্কতাবশত চীনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসূচিতে প্রযুক্তি ও গবেষণা সহায়তা দিচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলছে যে তাদের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসূচি চীনের মতো হবে না, বরং হবে উল্টো। মার্কিন কর্মসূচিতে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আমেরিকান মূল্যবোধ সমুন্নত রাখা হবে এবং সংরক্ষণ করা হবে মৌলিক মানবাধিকার।  তাদের কথা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসূচি সারা বিশ্বের সামরিক বাহিনীগুলো ব্যবহার করবে কী না, এটা প্রশ্ন নয়। করবেই। প্রশ্ন হলো, কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকে তাদের অপশাসন টিকিয়ে রাখার কাজে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে আমরা দেবো কি না।

 

এদিকে জয়েন্ট আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সেন্টার নামে একটি স্পেশ্যাল অফিস খুলেছে পেন্টাগন। এ অফিস বেশ কিছু প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে। এর একটি হলো সাইবার প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত অস্ত্র ও সরঞ্জামের আয়ু বাড়িয়ে দেয়া।  এর আরেকটি প্রজেক্ট হলো জয়েন্ট ওয়ারফাইটিংয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে যুক্ত করা। এ নিয়ে গবেষণা এখনও চলছে। অতি জটিল এ প্রক্রিয়াটিতে সেন্সর অ্যান্ড কম্যান্ড সিস্টেমগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে একীভূত করার কাজ চলছে। এর ফলে এমন সুচারু রূপ ও গতিতে সামরিক অভিযান চালানো যাবে, যেমনটা অতীতে কখনো দেখা যায়নি।


এ-ই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কর্মসূচি নিয়ে চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতা। একে তুলনা করা হচ্ছে ১৯৬০এর দশকে মহাকাশ কর্মসূচি নিয়ে মার্কিন-সোভিয়েত প্রতিযোগিতার সাথে। এ প্রতিযোগিতার ফলেই ১৯৬৯ সালে মার্কিন নভোখেয়াযান চাঁদে অবতরন করে এবং নভোচারীদের নিয়ে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরেও আসে। মার্কিন কর্মকর্তাদের কথা, এটাও মহাকাশ প্রতিযোগিতাই। যে প্রথম হবে সে-ই কর্তৃত্ব করবে।


চীনের লক্ষ্যও ঠিক তা-ই। সামরিক ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজনে দেশটি যে কর্মসূচি নিয়েছে তারা তার নাম দিয়েছে 'ইনটেলিজেন্ট অপারেশন্স'। গত বছর, ২০১৮ সালে, চীনের সেনাবাহিনীর একটি পত্রিকায় এ কর্মসূচির রূপরেখা প্রকাশ করা হয়।  তারা একে বলছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযোজনে শ্রেষ্ঠত্ব বা ইন্টেলিজেন্স সুপ্রিমেসি অর্জনের লক্ষ্য। গতি ও গুণগত মানের ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনই এর অর্থ, বলছে চীন।


চীনের 'ইনটেলিজেন্ট অপারেশন্স' কর্মসূচিতে যেসব মিলিটারি অ্যাপ্লিকেশন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেগুলো হলো স্টিলথ ক্যামোফ্ল্যাজ, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সাইলেন্স, ইলেক্ট্রনিক কাউন্টারমেজার্স, সাইবার টেকওভার এবং কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন।


এ ব্যবস্থার ফলে শত্রূ রণাঙ্গনের আসল তথ্য পাবে না, যা পাবে তা-ও ভুল তথ্য। পক্ষান্তরে চীনের বাহিনী পাবে প্রতিপক্ষের নির্ভুল তথ্য। এর ফলে জলে-স্থলে-আকাশে যে প্রচলিত যে যুদ্ধ, তার সীমানা ছাড়িয়ে চীনের আধিপত্য ছড়িয়ে পড়বে শত্রূর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া তথা পুরো সমাজে এবং সাইবার স্পেসে। কাজটি সম্পাদনের জন্য চীনের সেনাবাহিনীর আরেকটি ক্ষেত্র হলো ব্রেন মেশিন ফিউশন। এটি করতে পারলে সামরিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগানো যাবে। এর থাকবে মানুষের মতোই চিন্তা করার ক্ষমতা।


চীনা সামরিক বাহিনীর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত অস্ত্র ও হামলার ধরন তিন রকম। প্রথম দু'টির একটি হলো সম্পূর্ণ মানুষ-নিয়ন্ত্রিত। দ্বিতীয়টি স্বচালিত, তবে মানুষ চাইলে এতে হস্তক্ষেপ করতে পারবে। তৃতীয়টিতে মানুষের কোনো ভূমিকাই নেই। সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামই  মানুষের কোনো রকম সাহায্য ছাড়াই অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারবে। চীনের সেনাবাহিনীর পত্রিকায় সেদেশের একজন লেখক গত বছর লিখেছেন, আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে। প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘণ্টাকে কাজে লাগাতে হবে।


সব দেখেশুনে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, 'আমরা আছি প্রতিযোগিতার মধ্যে। চীন করার আগেই আমাদের কাজ শেষ করতে হবে। রাশিয়ার হাতেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম আছে। তাদেরও পেছনে ফেলতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সমর-আয়োজনই আমাদের এক নাম্বার লক্ষ্য।'