আরতুগ্রুলে জাগছে মুসলিম আবেগ

এরদোগানের উদ্যোগেই নতুন করে প্রাণ পেয়েছে মুসলমানদের বীরগাঁথা। আর এইসব বীরদের চিত্রায়নে নতুন করে স্বপ্নাতুর হচ্ছে মুসলিমরা - ইন্টারনেট

  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ২০ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৩৮

দিরিলিস আরতুগ্রুল। টেলিভিশনের পর্দায় কেবল একটি চরিত্রের নাম নয়। একদিকে এই চরিত্রর মাধ্যমে পুনরুত্থান হয়েছে তুরস্কের তের শতকের এক কিংবদন্তীর। অন্যদিকে এই কিংবদন্তীতে জেগে উঠেছে মুসলমানদের কল্পনা।

আর এই কল্পনা প্রভাব ফেলছে রাজনীতিতে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন সারা বিশ্বে তুরস্কের প্রভাব বাড়ার পেছনে রয়েছে তুর্কী সোপ অপেরার জনপ্রিয়তা। তুর্কী নির্মাণের পেছনের কারিগর নতুন সুলতান হিসেবে পরিচিত দেশটির প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান।

তার পৃষ্ঠপোষকতা এখন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে মুসলিমদের আবেগ। কেবল মুসলিম নয়, অমুসলিম দেশগুলোতেও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে আরতুগ্রুল। এরা এতোদিন মুসলিমদের ইতিহাস যেভাবে জানতেন, বদলে যাচ্ছে সেই ধারণা।

কিংবদন্তী আরতুগ্রুল আবির্ভূত হয়েছেন নতুন বিশ্বের নায়ক হিসেবে। এই চরিত্রটি পরিণত হয়েছে লড়াকু ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের প্রতীক হিসেবে। আরতুগ্রুলে প্রভাবিত হয়ে পৃথিবীর মুসলিমরা নতুন করে লড়ার স্বপ্ন দেখছেন। ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মির পর্যন্ত তৈরি হয়েছে লড়াইয়ের আদর্শ উদাহরণ।

তুর্কী সিরিজ আরতুগ্রুলে দেখানো হয়েছে ইসলামের উাদারতা। ন্যায্যতা। এমনকি অমুসলিমদের প্রতি ইসলামী বিধিবিধান অনুযায়ী ন্যায় আচরণ।

আরতুগ্রুল শিখিয়েছে কিভাবে লড়াই করতে হয়। কিভাবে বেঁচে থাকতে হয়। আরতুগ্রুলের ‘কায়ি’ গোষ্ঠির কোনো ঘর ছিলো না। নিজেদের কোনো ভূমি ছিলো না। বলতে গেলে ছিলো না কিছুই।

প্রায় শুন্য থেকে উঠে এসে একটি সাম্রাজ্য গড়ে দিয়েছেন তিনি।
বর্তমান তুরস্কের চিত্রও অনেকটা তেমন।

ভেবে দেখুন, কামাল আতাতুর্ক এর গড়ে দেওয়া ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটি কেমন ছিলো। আর এখন এর চিত্র কেমন?

পাল্টে দেওয়ার পেছনে কাজ করেছেন অনেক কারিগর। তবে বর্তমান সময়ে পৃথিবীর কাছে আলোচিত রজব তাইয়েব এরদোগান। তাকে বলা হয় তুরস্কের নতুন সুলতান।

এরদোগানের উদ্যোগেই নতুন করে প্রাণ পেয়েছে মুসলমানদের বীরগাঁথা। আর এইসব বীরদের চিত্রায়নে নতুন করে স্বপ্নাতুর হচ্ছে মুসলিমরা।

ঠিক এমন করে স্বপ্নাতুর ছিলো ‘লায়ন অব ডেজার্ট’ নিয়ে। ওটা ছিলো পরাজয়ের গল্প। তবে সে পরাজয় এসেছে বীরের মতো লড়াই করে। লায়ন অব ডেজার্ট এর লায়ন ছিলেন ওমর মুখতার।

ইতিহাস থেকে নেওয়া এক চরিত্র। সময়টা বিশ শতকের গোড়ার দিকে। লিবিয় সিংহ ওমর মুখতার লড়াই করেছিলেন ইতালিয় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে। লিবিয়ান এই বিপ্লবির জীবন থেকে নেওয়া গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন মোস্তফা আক্কাদ। এতে সরাসরি অর্থায়ন করেছিলেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি।
চলচ্চিত্রটি মানুষের চোখের সামনে আসে ১৯৮১ সালে। বিশ্বজুড়ে বেশ কিছু সিনেমা হলে এর প্রদর্শন হয়। মরুর এই সিংহের সাহস দেখে সাহসি হয়ে উঠে পৃথিবীর নির্যাতিত মুসলমানরা। ফিলিস্তিন থেকে কাশ্মির জেগে উঠে প্রতিরোধ আন্দোলনে।

‘লায়ন অব ডেজার্ট’ সিনেমায় ওমর মুখতারের ভূমিকায় অভিনয় করেন অ্যান্থনি কুইন।

‘লায়ন অব ডেজার্ট’ মুক্তির প্রথম দিকে চলচ্চিত্রটি পরিণত হয়েছিলো লড়াইয়ের আদর্শ হিসেবে।

এর একটি ডায়লগে দেখা যায় ওমর মুখতার ইতালিয়দের বলছেন, ‘আমরা ২০ বছর ধরে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়ছি, কেবল আল্লাহর সাহায্য নিয়ে। আমরা এর শেষ দেখে ছাড়ব।’

এই শেষ দেখে ছাড়ার স্বপ্নে মুখতার ও তার সঙ্গীরা লড়াই করেছেন। কেবল রাইফেল হাতে কয়েকশো অশ্বারোহী বেদুইনকে সঙ্গী করে তিনি লড়েছেন আধুনিক ইতালিয় বাহিনীর সাথে।

বেদুইনদের জন্য লড়াইটা তৈরি করেছিলো অস্থির পরিস্থিতির। ইতালিয় বাহিনী তাদের পরিবারকে বিচ্ছিন করেছিলো। ফসল পুড়িয়ে দিয়েছিলো। আবাদি জমি নস্ট করেছিলো। তাদের ওপর চালিয়েছিলো নৃশংস নির্যাতন। শিবিরে হত্যা করেছিলো কয়েক হাজার লোক।

তবু ওমর মুখতার ধরে রেখেছিলেন ইসলামের আদর্শ। নৃশংস শত্রুর বিরুদ্ধেও তিনি নৃশংসতা করেননি।

বর্তমান পৃথিবীর জন্য তার এই আদর্শ, বড় এক শিক্ষা। এমনটাই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। মুখতার ছিলেন বিজ্ঞ। ছিলেন যোদ্ধা। আবার একজন সুফি সাধক। তিনি লড়াই করেছেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.) এর মতো সাহস নিয়ে।

হজরত আলী (রা.) পরিচিত ছিলেন ‘আসাদুল্লাহ’ হিসেবে। এর অর্থ আল্লাহর সিংহ। আর ওমর মুখতারের পরিচয় ‘মরুর সিংহ’।

সিংহের মতো লড়াই করেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিপরীতে। আর তার এই লড়াই যখন পর্দায় চিত্রায়িত করা হলো। তখন ঢেউ উঠলো বিশে^র মুসলমানদের বুকে।

অনেকে অবশ্য একে আরবদের প্রপাগান্ডা হিসেবে দেখার চেষ্টা করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস-এ এই চলচ্চিত্রটির একটি রিভিউ প্রকাশ হয়। রিভিওটি করেন ড্রিউ মিডলটন। তিনি লিখেন, ‘লিবিয়ায় ইতালিয় ক্যামপেইনের একটি সাম্রাজ্যবাদের উদাহরণ হিসেবে এই চলচ্চিত্রটি রয়ে গেলো। অনেকেই ভাবতে পারেন, এই ছবিটি আরবদের প্রপাগান্ডা কি না। (আক্কাদ) একজন আরব। তাই মুখতার ও তার দলের প্রতি তার ভালোবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক।’

চলচ্চিত্রে দেখানো হয় ইতালিয়দের অনুগত এক লিবিয় চরিত্র। তিনি নিজেদেও লোকের পক্ষে না দাঁড়িয়ে ইতালিয় সরকারকে সহযোগিতা করছেন।

এই চরিত্রটি মুখতারকে ইতালিয়দের আনুগত্য মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি মিনতি করে বলেন, ‘ওর এই দেশের সরকার, মেনে নাও।’

জবাবে মুখতার বললেন, ‘ওরা দিনে এই ভূমি নিয়ে নিয়েছে। আল্লাহর কসম আমরা রাতে তা ফিরিয়ে আনবো।’

ইতালিয় অনুগত লোকটা বললেন, ‘এই যুদ্ধ আপনি জিততে পারবেন না, ওদের রক্তের বিরুদ্ধে আপনার রক্ত।’

‘লায়ন অব দি ডেজার্ট’ তথাকথিত পশ্চিমা আধুনিকতার চিত্র তুলে ধরেছিলো। এতে বিংশ শতাব্দীর ওপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের চিত্রায়ন হয়েছিলো।

এই ছবির কারণে ওমর মুখতার ছড়িয়ে যান লিবিয়ার বাইরে। সারা বিশ্বের মুসলিমদের নায়ক হয়ে উঠেন তিনি। তিনি হয়ে উঠেন ‘প্যান-আরব’ আদর্শের প্রতীক। একজন মুসলিম বীর। এই বীর সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন বিশ বছর।

চলচ্চিত্রটি প্রকাশ হওয়ার পর কেটে যায় আরো বেশ কিছু বছর। এর পর আসে ২০১৪ সাল। ওই বছরের ১০ ডিসেম্বর তুরস্কের টিআরটিতে প্রচার হয় ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’। এর মাধ্যমে পুনরুত্থান হয় কিংবদন্তীর।
মেহমেত বোজদা নির্মিত এই চলচ্চিত্রে নায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন এঞ্জিন অ্যালটান দুজায়তান।

এতে দেখানো হয় ১৩ শতকের আনাতোলিয়ার এক যুবক যোদ্ধার গল্প। যিনি লড়াই করেছেন তুর্কি উপজাতিদের স্থায়ী আবাস গড়তে। তার গোত্রর নাম ছিলো ‘কাই’। স্থায়ী কোনো বসতি ছিলো না। তবে মধ্য এশিয়ার উপত্যকায় ছিলো এদের বিচরণ। ছিলো যাযাবর জীবন। পশু পালন আর পশু থেকেই খাবার জোগাড় করে বেঁচে থাকতে হতো।

যখন জাঁকিয়ে শীত নামতো, দেখা দিতো খাবারের ঘাটতি। খেয়ে-পড়ে বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে হতো। আর ছিলো শত্রুর সাথে লড়াই। তখন খৃস্টান ক্রসেডার ও মঙ্গোলদের উৎপাত ছিলো আনাতোলিয়ায়।

সেইসময় ইসলামি সমাজের অবস্থা ছিলো অনেকটা এখনকার মতো। ছিলো চরম বিশৃঙ্খলা। অনৈক্য। মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে মুসলিম শাসনের লড়াই। আইয়ুবি ও সেলজুকদের শাসনের ভীত ভেঙে পড়েছে।

ঠিক সেই সময় নতুন করে জেগে উঠেন যাযাবর ‘কাই’ গোত্রপতি সোলেমান শাহ এর পুত্র আরতুগ্রুল। তার প্রথমদিকের লড়াইটা ছিলো নিরাপদ বসতি তৈরি করা। এর পর গোত্রগুলোকে একত্রিত করা। আরো পর একটি স্থায়ী বসতির স্বপ্ন।
বসতির স্বপ্নে তিনি চলে যান পশ্চিমে আনাতোলিয়ার দিকে। বর্তমানে এই এলাকাজুড়ে আধুনিক তুরস্ক। ১০৩৭ এবং ১১৯৪ সালে ছিলো বাইজেন্টাইন এবং হানাদার মোঙ্গলদের আধিপত্য।

আরতুগ্রুল একাধারে ক্রুসেডার ও বাইজেন্টাইনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। খুব কম সময়ের মধ্যেই প্রধান সেনাপতি হিসেবে আবির্ভূত হয়েন। রুমের সালতানাতের সূর্য অস্ত যাওয়ার সাথে সাথে তুর্কি উপজাতিদের এক করতে শুরু করেন। তার লড়াই, বিজয় এবং অনুপ্রেরণামূলক নেতৃত্ব নতুন সাম্রাজ্যের পথ খুলে দেয়। আর সেই খোলা পথ ধরে ওসমানীয় সা¤্রাজ্য গঠন করেন তার পুত্র ওসমান।

দিরিলিস আরতুগ্রুল পাঁচটি সিজন দেখানোর পর ২০১৯ সালে শেষ হয়। প্রতিটি সিজনে ৩০ টি এপিসোড আছে। প্রতিটি এপিসোড দুই ঘণ্টা করে। সব মিলিয়ে এটি ১৫০টি চলচ্চিত্র। যখন নেটফ্লিক্সে এটি বিশ্বের দর্শকদের জন্য ছাড়া হয়, তখন এর প্রতিটি সিজনকে ৪০ মিনিট করে ৮০টি এপিসোডে ভাগ করা হয়।

দিরিলিস আরতুগ্রুল দেখা মানে একটি ম্যারাথন দৌড়ের মতো। প্রতি দুই ঘণ্টার কিস্তিতি থাকে নানামুখী চাপ। ষড়যন্ত্র, নৈতিক দ্বিধা, রক্তাক্ত লড়াই। এবং একটি আকর্ষণীয় সমাপ্তি।

টানটান উত্তেজনা আর আদর্শের কারণে সিরিজটির খ্যাতি বাড়তে থাকে।
‘লায়ন অব দি ডেজার্ট’ এর মতো এই অনুষ্ঠানটিও স্থান করে নেয় মুসলমানদের হৃদয়ে। তবে ওমর মুখতারের সমাপ্তিটা ছিলো পরাজয়ের মধ্য দিয়ে। আর আরতুগ্রুলের সমাপ্তি বিজয় দিয়ে।

দুটোই মুসলিম ইতিহাস, ইসলামী আদর্শ ধারণ এবং নির্যাতন প্রতিহত করার প্রতীক। ‘লায়ন অব দি ডেজার্ট’ এবং ‘দিরিলিস আরতুগ্রুল’-এ কেবল সমাজ ও সংস্কৃতি উঠে আসেনি। এসেছে একটি আদর্শ। এসেছে চিন্তা। একটি বাস্তব স্বয়ংসম্পূর্ণ বিশ্ব। যেখানে মুসলমানদেরকে নায়ক, খলনায়ক, এবং শত্রুদের সহযোগী হিসেবে দেখানো হয়েছে।

ওমর মুখতার চরিত্রের পর্দায় চিত্রায়ন যতটা ছড়িয়েছে, এই সময়ে তৈরি করা আরতুগ্রুল ছড়িয়েছে তার চাইতে বেশি। এর পেছনের কৃতিত্ব এরদোগান। তিনি একদিকে গৌরব রচনা করছেন। অন্যদিকে অতীত গৌরব ছড়িয়ে দিচ্ছেন।
এইসব গৌরব থেকে আশায় বুক বাঁধছে অনেকেই। নির্যাতনের বিপরীতে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন জেগে উঠছে।

সাম্প্রতিক কাশ্মিরের ঘটনার কথাই ধরা যাক। যখন এই উপত্যকাটিকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন নিয়ে যাওয়া হলো। তখন গর্জে উঠেছেন স্থানীয়রা। অথচ তখন এরা ছিলেন বিচ্ছিন্ন। একজনের কাছে অন্যজনের সংবাদ যেতো না। সড়কে হাঁটা-চলাও ছিলো কঠিন। নতুন করে লড়াইয়ে নামার প্রতিজ্ঞাও নিয়েছিলেন অনেকে।

তাদের তখন অবলম্বন ছিলো আরতুগ্রুলের মতো লড়াকুদের গল্প। আরতুগ্রুলকে একই চোখে দেখছে ফিলিস্তিনীরাও।

কাশ্মিরে বলিউড এর প্রভাব একচেটিয়া। এর বিপরীতে এসে ইতোমধ্যে অবস্থান নিয়ে নিয়েছে আরতুগ্রুল এর মতো সিরিজগুলো। ওখানকার মুসলিমদের কাছে আরতুগ্রুলের স্থান সম্মানের আসনে। এই বীরের আদর্শে রয়েছে তাদের আস্থা।
দিল্লির এক রাজনৈতি কর্মী নাবিয়া খান। তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আরতুগ্রুল একটি বিশ্বাস। শৃঙ্খলা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতিশ্রুতি।’
তিনি বলেন, ‘আরতুগ্রুল যথেষ্ট বিনোদনও দেয়।’

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে