বলিউডের ভণ্ড তারকারা

তথাকথিত রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের রমরমা বাণিজ্যের পেছনে সিনেমা জগতের ভূমিকাকেও দায়ী করতে ছাড়েন না সমালোচকরা - আনাদুলো

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৪ জুন ২০২০, ১৯:১৫

সিনেমা বা টিভির পর্দায় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কতোরকম চরিত্রেই না অভিনয় করতে হয়! চোর, ডাকাত, সাধু, শ্রমিক, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, গরীব শ্রমজীবী এককথায় সমাজে যত রকম মানুষ আছে, পর্দায় তাদের সে-রকম মানুষই সাজতে হয়। এ জন্য কেউ কখনও তাদের নিন্দা করে না, তাদের বলে না হিপোক্রিট বা কপটাচারী। বরং চরিত্রটি যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারলে বিপুল প্রশংসাই করে।

কিন্তু বাস্তব জীবনেও যদি তারা ও-রকম দ্বিমুখী আচরণ করেন, তাহলেই কথা ওঠে, ওঠে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড়। যেরকম ঝড় উঠেছে এখন ভারতে। দেশটির কতিপয় চিত্রতারকাকে বলা হচ্ছে হিপোক্রেট বা ভণ্ড। কারণ, তারা একদিকে হালে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভকে সমর্থন দিচ্ছেন, অন্যদিকে 'রঙ ফর্সাকারী' ক্রিমের মতো পণ্যের বিজ্ঞাপনেও চুটিয়ে অংশ নিচ্ছেন।

বলা হচ্ছে, এসব তারকা হচ্ছে আদতে কাপুরুষ। কেননা, নিজ দেশের সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর চলা খুন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করতে এরা ভয়ে কাঁপে, অথচ সুদূর আমেরিকায় এক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে হয় মুখর।

উল্লেখ্য, পুলিস কাস্টডিতে এক শ্বেতাঙ্গ অফিসার নিষ্ঠুরভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়ডকে হত্যার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভে উত্তাল হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি নিন্দায় মুখর হয় সারা বিশ্ব। এর সাথে তাল মেলাতেই বুঝি বা, ভারতের মুম্বাই চলচ্চিত্রপাড়ার প্রথম সারির বেশ-কিছু তারকাও এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট শেয়ার করেন।

এদের একজন হচ্ছেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। সাবেক এই 'মিস ওয়ার্ল্ড'-এর বয়স এখন ৩৭ বছর। শুধু মুম্বাই নয়, হলিউডের সিনেমায়ও অভিনয় করে সাড়া ফেলেছেন তিনি। এমন একজন তারকা অভিনেত্রী হয়ে তিনি কি বিশ্বজুড়ে আলোচিত এ ঘটনায় চুপচাপ বসে থাকরে পারেন? তাই তিনি ইনস্টাগ্রামে লিখলেন, 'যুক্তরাষ্ট্র ও সারা বিশ্বে বর্ণবাদের অবসান হোক। যে যেখানে যে অবস্থায়ই থাকুক, কারও মৃত্যু কাম্য নয়। বিশেষ করে শুধু গায়ের রঙের কারণে অন্যজনের হত্যার শিকার হওয়া।'

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার এ পোস্টে যেন মৌচাকে ঢিল পড়লো। সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকজন ঝাঁপিয়ে পড়লো তার ওপর - গায়ের রঙের কারণে অন্যজনের হত্যার শিকার হওয়া কাম্য নয় বলছেন? তা ম্যাম, আপনিই তো একসময় গায়ের রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন করেছিলেন! ২০০৮ সালে আপনার অভিনীত হিন্দি ফিল্ম 'ফ্যাশন'-এর কথা মনে আছে? ওখানে আপনি এমন এক নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, যে নারী এক কালো মানুষের সঙ্গে সেক্স করে বেজায় লজ্জিত হয়েছিল। তার ভাবখানা ছিল এমন, সেক্স করা যায়, তবে কোনো কালো মানুষের সঙ্গে নয়। মনে পড়ে?

প্রিয়াঙ্কার ইনস্টাগ্রাম পোস্টের জবাবে একজন লিখলেন, 'কালো মানুষদের পক্ষে কথা বলায় আপনাকে ধন্যবাদ। তবে এবার আপনার উচিত হবে গায়ের কালো রঙকে ফর্সা বানানোর ক্রিমের বিজ্ঞাপনে অংশ নেয়া বন্ধ করা।'

সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব মন্তব্যের জবাবে তার বক্তব্য জানতে সাংবাদিকরা খোঁজ করেছিলেন প্রিয়াঙ্কার। কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে বিভিন্ন সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন যে একজন তরুণী অভিনেত্রী হিসেবে এ ধরনের বিজ্ঞাপনের নেতিবাচক দিকটা তিনি সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। এ জন্য তিনি দুঃখিত এবং নিজের গাঢ় গায়ের রঙ নিয়ে তিনি গর্বিত।

একই ধরনের বিজ্ঞাপনে অংশ নিয়ে আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় বর্ণবাদবিরোধী পোস্ট দিয়ে নিন্দামন্দ কুড়ানোর তালিকায় প্রিয়াঙ্কা একা নন, আরও আছেন সোনম কাপুর, দীপিকা পাড়ুকোন ও দিশা পাটানি।

গায়ের রঙ উজ্জ্বলকারী পণ্যের ব্যবসাটি ভারতে ফুলে-ফেঁপে উঠতে-উঠতে এখন মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর তীব্র সমালোচনার মুখে কিছু কম্পানি অবশ্য আজকাল ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। এ ধরনের ক্রিমের কড়া সমালোচক, অভিনেতা অভয় দেওল বলেন, তারা এখন 'রঙ ফর্সাকারী ক্রিম' না-বলে বলছে ত্বক উজ্জ্বলকারী কিংবা ফেস ওয়াশ। আসলে কিন্তু ওই একই - নতুন বোতলে পুরনো মদ।

তথাকথিত রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের রমরমা বাণিজ্যের পেছনে সিনেমা জগতের ভূমিকাকেও দায়ী করতে ছাড়েন না সমালোচকরা। তারা রাখঢাক না-রেখেই বলেন, ফিল্মী দুনিয়ায় ফর্সা রঙের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং গাঢ় রঙের প্রতি অনীহা আছে। উদাহরণ হিসেবে তারা বলেন, এ কারণেই দক্ষিণী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মূলধারার বলিউড ফিল্মে বলতে গেলে দেখাই যায় না। এর ফলে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ভারতের বহুজাতিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে মুম্বাইয়ের ফিল্মী দুনিয়া।

গাঢ় গাত্রবর্ণের দক্ষিণী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ব্যাপারে বলিউডের অনীহা কতটা ব্যাপক, তা স্পষ্ট হয় গত বছরের একটি ঘটনায়। সে-সময় গায়ের রঙের কারণে বৈষম্যের শিকার এক নারীর জীবনকথা নিয়ে নির্মিত হয় 'বালা' নামের একটি ছবি। স্বভাবতই এ চরিত্রে গাঢ় গাত্রবর্ণের একজন দক্ষিণী অভিনেত্রীর অভিনয়ের সুযোগ পাওয়ার কথা। কিন্তু তা হলো না, সুযোগ পেলেন মুম্বাইয়েরই এক অভিনেত্রী ভূমি পাটনেকার। ছবিতে অভিনয়ের জন্য গায়ের রঙ কালো করিয়েছিলেন অর্থাৎ কালো রঙের মেকআপ নিয়েছিলেন তিনি।

এমন প্রেক্ষাপটে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন, ফর্সা রঙকেই সৌন্দর্যের প্রতীকরূপে তুলে ধরে বলিউডের ছবিতে এখনও কেন গান ও সংলাপ লেখা হচ্ছে।

বলিউডের একশ্রেণির তারকার এ ভণ্ডামির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন ওই জগতেরই অনেকে। বিশিষ্ট অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত তাদেরই একজন। সম্প্রতি বিবিসি-র সাথে এক সাক্ষাতকারে তিনি এদের তুলাধুনা করে বলেন, ''এসব লোক, বিশেষ করে ইন্ডিয়ান সেলেব্রীটিজ, সফল মানুষের দল সব ধরনের রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের পক্ষ নিয়েছে। আর এখন ওরাই বেহায়ার মতো বলছে, 'কালোদেরও বাঁচার অধিকার আছে'। হাউ ডেয়ার দে? কী দুঃসাহস তাদের?

শুধু অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউত নন, বিভিন্ন সময় পুলিসী নির্যাতন এবং অন্যান্য সহিংসতার বিরুদ্ধে মুখ না-খোলার অভিযোগে বহু ভারতীয়ই এখন বলিউড তারকাদের সমালোচনায় মুখর হয়েছেন। জম্মু-কাশ্মীরের সাবেক মূখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ টুইট করেছেন, যেসব সেলেব্রিটি আমেরিকার কালোদের পক্ষে নেমেছেন, তাদের শ্রদ্ধা জানাই। আপনারা ভারতীয়দের জীবননাশ নিয়ে কিছু বলতে ভয় পেলেও আমেরিকানদের ব্যাপারে তো সাহস দেখিয়েছেন!
অন্যরা প্রশ্ন করেছেন, গত বছর ভারতে যখন মুসলিমবিরোধী সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন পাস হলো, তখন বলিউড তারকারা এর প্রতিবাদ করলেন না কেন? পরে এর বিরুদ্ধে যখন ভারতজুড়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঝড় উঠলো, সরকার এতে গুলি চালিয়ে অনেককে হত্যা করলো, পিটিয়ে জখম করলো, গ্রেফতার করলো, তখনই বা তারা চুপ করে ছিলেন কেন?

তারা বললেন, বলিউড তারকাদের বেশিরভাগই আসলে ভণ্ড। এরা কেরালায় একটা গর্ভবতী হাতির মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিবাদে ফেটে পড়ে আর সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ থেকে গর্ভবতী নারী সফুরা জারগারকে গ্রেফতার করা হলে থাকে একেবারে চুপচাপ। সফুরাকে গ্রেফতার করা হয়েছে গত এপ্রিলে। তিনি এখনও কারাগারেই আছেন।

কেরালায় গর্ভবতী হাতিটির মৃত্যু ঘটে বিস্ফোরকভর্তি একটি ফল খেয়ে। একে কেন্দ্র করে ভারতের ডানপন্থী দলগুলো দ্রূত তৎপর হয়ে হয়ে ওঠে এবং ঘটনাটিতে সাম্প্রদায়িক রঙ চড়িয়ে দেয়। তারা তারস্বরে বলতে থাকে, কোনো মুসলিমই এ কাজ করেছে। এক পর্যায়ে কেরালার মূখ্যমন্ত্রী মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা অভিযান শুরু করেন।

পক্ষান্তরে সফুরার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে যে সহিংসতা হয়, তার প্রধান 'ষড়যন্ত্রী' ছিলেন ২৭ বছর বয়সী এই নারী। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করা হয় এবং তার স্বাস্থ্যের অবনতি সত্ত্বেও এবং বর্তমান করোনা মহামারীর মধ্যেও তাকে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়।

এমন পরিস্থিতিতে চলচ্চিত্র পরিচালক বেদব্রত পাইন এক কলামে প্রশ্ন তুলেছেন, কেরালায় একটি গর্ভবতী হাতির মৃত্যু নিয়ে আমরা যে যথার্থ সহানুভূতি ও বিক্ষোভ দেখিয়েছিলাম, জামিয়ার ছাত্রী সফুরা যখন আজ করোনা মহামারীর দিনে জনাকীর্ণ কারাগারে আটকে আছে, তখন আমাদের সেই সহানুভূতি ও ক্ষোভ কোথায় পালালো?

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে