সৌদি টিভিতে ইহুদিদের জয়গান

ইসরাইলি কামারের লোহা পেটানোর পিঁড়ির ওপর আল আকসার চাবি নিয়ে বসে আছে এক ফিলিস্তিনী। আর তার মাথার ওপর তাক করা আছে সৌদির ‘উম হারুন’ নামের হাতুড়ি - ২৪৬ ম্যাগাজিন ডটকম

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩১ মে ২০২০, ১৭:২১

ইহুদদিদের জয়গান এবং ইহুদদিবাদী ইসরাইলের সঙ্গে সর্ম্পক স্বাভাবিক করাকে উৎসাহিত করে পবিত্র রমজান মাসে দুটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার হয়েছে সৌদি সরকার পরিচালিত একটি চ্যানেলে। এতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা বলছেন, দখলদার ইসরাইলের পক্ষে এ ধরনের প্রচারণা কল্কপ্পনাতীত ব্যাপার। তারা বলছেন, ইসরাইল একটি শত্র“ রাষ্ট্র এবং এটি আরব জাহানের জন্য সবসময়ই হুমকি হয়ে থাকবে।

দুবাইভিত্তিক মিডল ইস্ট ব্রডকাস্টিং সেন্টার এমবিসি চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছেছ উম হারুন ও মাখরাজ সেভেন বা এক্সিট সেভেন নামের অনুষ্ঠান দুটি। এতে ইহুদি চরিত্রে অভিনয় করেছেন আরব মুসলিমরা। নিউইয়র্ক টাইমস ও আলজাজিরার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ সর্ম্পকে আজ আমরা জানাবো

মাটির প্রাচীর ঘেরা পারস্য উপসাগরের একটি গ্রামে এক খ্রিস্টান নারী তার মুসলিম বণিক প্রেমিকের জন্য চোখের জল ফেলছেন। ওই বণিক আরেক নারীকে বিয়ে করতে বাধ্য হন। সেই নারী আবার প্রেমে পড়েছিলেন আরেক মুসলিমের। কিন্তু তাকে বিয়ে করতে পারেননি। কারণ তার প্রেমিক স্থানীয় এক ইহুদি যাজকের মেয়ের প্রেমে মাতোয়ারা।

এরকম আন্ত:ধর্মীয় ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনীর একটি ব্যয়বহুল টেলিভিশন সিরিজ আরব জাহানে তীব্র বিতর্কের সৃষ্টি করেছে। বিতর্কের কারণ ইহুদি সম্প্রদায়ের সঙ্গে আরবদের ঐতিহাসিক সর্ম্পক এবং আরবের কিছু নেতার ইসরাইলের প্রতি ইতিবাচক মনোভাবের প্রকাশ। সমালোচকরা বলছেন, ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক তৈরির পথ সুগম করতে আরবদের মনোভাব পরিবর্তনের এটা একটা নিলর্জ্জ প্রচেষ্টা। আরবের অনেকে এটাকে বলছেন সর্ম্পক স্বাভাবিকীকরণ।

উনিশ’ চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকের পটভ‚মিতে নির্মিত নাটক দুটি প্রচারের পক্ষের লোকেরা বলছেন, এতে এ অঞ্চলের বিস্মৃত অতীত তুলে ধরা হয়েছে। পারস্য অঞ্চলে ইহুদিরা তো ছিলেনই। তারা একে দেখছেন বিভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসীদের মধ্যে সহাবস্থানের অতি প্রয়োজনীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে।

তবে অনেকেই এ যুক্তি মানতে পারছেন না। ফিলিস্তিনের বিখ্যাত সাংবাদিক আবদেল বারি আতওয়ান লিখেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে মক্কা ও মদীনার মসজিদ বন্ধ থাকায় এবারের রমজান মাসটি ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। তবে আরও একটি বিষয় দীর্ঘদিন মনে রাখা হবে। সেটি হচ্ছে এ মাসেই ইসরাইলের সঙ্গে সর্ম্পক স্বাভাবিক করার সবচেয়ে বড় প্রচারণা চালানো হচ্ছে। সৌদি গণমাধ্যমে এটা চালাচ্ছে সৌদি সরকার।

উম হারুন অনুষ্ঠান
উম হারুন অনুষ্ঠান

 

সন্দেহ করা হচ্ছে, উম হারুন বা অ্যারনের মা নাকটটি তৈরি করা হয়েছে ইহুদি ও ইসরাইল রাষ্ট্র সর্ম্পকে আরব জনগণের মনোভাব পরিবর্তনের জন্য। আরবের সবচেয়ে বড় টিভি চ্যানেল এমবিসিতে এটি প্রচারিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতে। একই চ্যানেলে ইসরাইলের প্রতি আরব দৃষ্টিভংগিকে ব্যঙ করে আরেকটি কমেডি প্রোগ্রাম চলছে। এতে আরবদের মধ্যে এই মনোভাব তৈরি হয়েছে যে দুটি অনুষ্ঠানেরই উদ্দেশ্য বিনোদনের আড়ালে প্রপাগান্ডা চালানো। ইফতারের পরে এই চ্যানেলের দর্শক যখন সর্বাধিক থাকে তখনই প্রচার করা হয় অনুষ্ঠান দুটি। এগুলো চলবে পুরো রমজান মাস জুড়ে।

এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সরকারের নির্দেশে ইহুদিদের ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা অস্বীকার করেছে এমবিসি চ্যানেল কর্তৃপক্ষ। তবে এমন এক সময় এসব ঘটছে যখন উপসাগরীয় দেশের সরকারগুলো ইসরাইলের সঙ্গে উষষ্ণ সর্ম্পকের দিকে ঝুঁকছে।

ঐতিহাসিকভাবে ইসরাইলের প্রতি বৈরিতা ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভ‚তি মধ্যপ্রাচ্যের আরবদের ঐক্যবদ্ধ রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যুদ্ধ , বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা ও অর্থনৈতিক সংকটে আরবের সরকারগুলো অভ্যন্তরীণ ইস্যুগুলোর দিকে বেশি মনযোগ দিচ্ছে। এতে তাদের অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে ছিটকে পড়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। অন্যদিকে আরব নেতারা মনে করছেন ইসরাইল তাদের চিরস্থায়ী শত্র“ নয়। বরং ইরান ও মুসলিম ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে তাদের সাম্ভাব্য মিত্র এই ইহুদি রাষ্ট্রটি।

সৌদি যুবরাজ ও কার্যত দেশটির শাসক মোহাম্মদ বিন সালমান বলেছেন, ইসরাইলের সঙ্গে তার দেশের বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ রয়েছে। সৌদি যুবরাজ বলেছেন, ইসরাইল একটি আকর্ষণীয় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি কেন্দ্র। তাই তাদের সঙ্গে সর্ম্পক গড়লে উভয়েরই লাভ হবে। তিনি রীতি ভেঙে এও বলেছেন যে ইসরাইলিদের নিজেদের ভূমির অধিকার রয়েছে। যদিও আর্ন্তজাতিক আইনে ইসরাইল একটি অবৈধ রাষ্ট্র।

মাখরাজ সেভেন
মাখরাজ সেভেন

 

আরব শাসকরা এতোদিন ইসরাইল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। এর আগে সৌদি শাসকরাও ফিলিস্তিনি ইস্যুতে সরব ছিলেন। জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদে নামাজে ইসরাইলিদের বাধা প্রদানেরও নিন্দা করতেন তারা। তবে সৌদি যুবরাজ বলেছেন, ইসরাইল একটি বড় অর্থনীতি এবং বিকাশমান অর্থনীতি। তাদের সঙ্গে সর্ম্পক গড়লে উপসাগরীয় দেশগুলো লাভবান হবে। তিনি বলেছেন, ইহুদিদের সঙ্গে সৌদির কোনো বিরোধ নেই।

সৌদি আরব গোপনে ইসরাইলের সঙ্গে সর্ম্পক রাখছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ইসরাইলের একটি প্রতিনিধি দল আগামী বছর সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্ব বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ করবে। অথচ আমিরাত বা সৌদি আরব কোনো দেশের সাথে ইসরাইলের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সর্ম্পক নেই।

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইন্সটিটিউটের উপসাগরীয় বিষয়ক গবেষক মাইকেল স্টিফেন্স বলেন, এমবিসি চ্যানেলের এসব অনুষ্ঠান ইহুদিদের প্রতি মনোভাব পরিবর্তন ও ইসরাইলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টার অংশ বলে মনে হচ্ছে। সরকারি অনুমোদন ছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলোর কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত চ্যানেলে এ ধরনের অনুষ্ঠান হতেই পারে না। এতে শীর্ষ কর্তৃপক্ষের পরামর্শ ও অনুমোদন রয়েছে।

মাখরাজ সেভেন বা একরিট সেভেন নামের কমেডি শো নামটি সৌদিতে নোংরা শব্ধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর মানে অনাকাংখিত কথোপকথন। এতে সৌদি সমাজে ইহুদিদের প্রতি মনোভাবকে বিদ্রুপ করা হচ্ছে।

যেমন একটি পর্বে দেখা যায়, একটি ছেলে একজন ইসরাইলি শিশুর সঙ্গে ভিডিও গেমস খেলছে। এত ক্ষিপ্ত হয়ে ছেলেটির বাবা বলেন, শত্রুর সঙ্গে বন্ধুত্ব? আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, একজন আত্মীয় বলছেন, ছেলেটি গোয়েন্দা জালে পড়েছে। অন্য দৃশ্যে বলা হয়, সৌদি আরব থেকে বছরের পর বছর সমর্থন পেলেও ফিলিস্তিনিরা অকৃতজ্ঞ।

এসব দৃশ্য ফিলিস্তিনিদের ক্ষুব্ধ করেছে। পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি লেখক ও সাংবাদিক জিয়াদ খাদ্দাশ বলেন, আমি আশা করিনি যে কোনো আরববাসী ইসরাইলের সঙ্গে সর্ম্পক স্বাভাবিক করার পক্ষে এতো খোলাখুলিভাবে এবং স্বাছন্দ্যে কথা বলার সাহস দেখাতে পারে। এটা ভয়াবহ, লজ্জাজনক ও অদ্ভুত ব্যাপার।

উম হারুনে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন একজন ইহুদি নার্স। এর ঘটনাপ্রবাহ ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়কে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। নাটকের সব অভিনেতাই আরব নাগরিক। এতে দেখানো হয়েছে পাশাপাশি ব্যবসা করছেন মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি সম্প্রদায়। তারা একে অন্যের বাড়িতে যান। একে অন্যের বিয়ে এবং মৃত্যুর পর শেষ অনুষ্টানে যোগ দেন।

কার্টুনটি প্রকাশ করা হয়েছে ২৪৬ ম্যাগ ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটে। এর ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘গতকাল আরবরা ইহুদিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইতো। আজ তারা ইহুদিবান্ধব শিল্প প্রচার করছে।’
কার্টুনটি প্রকাশ করা হয়েছে ২৪৬ ম্যাগ ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইটে। এর ক্যাপশনে লেখা হয়, ‘গতকাল আরবরা ইহুদিদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে চাইতো। আজ তারা ইহুদিবান্ধব শিল্প প্রচার করছে।’

 

একটি দৃশ্যে দেখা যায়, একজন মুসলিম বিয়ে করার পর তার ইহুদি বন্ধু তাকে হিব্রু ভাষায় মাজেল টভ বা অভিনন্দন জানাচ্ছেন। আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, একদল মুসলিম, খ্রিস্টান ও ইহুদি নারী একত্রে ইহুদিদের সাব্বাত শুরু উপলক্ষে রান্না করছেন।

কখনও কখনও ধর্মীয় উত্তেজনা বাড়ার দৃশ্যও দেখানো হয়েছে। যেমন একজন ইহুদির চায়ের কাপ থেকে পান করতে অস্বীকৃতি জানান একজন মুসলিম। পুরো ঘটনাপ্রবাহ আবর্তিত হয়েছে গত সাত দশকের প্রেক্ষাপটে। এ সময়টাতে ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধেও জড়িয়েছে আরবরা।

আরব দেশগুলোর মধ্যে ইসরাইলের সঙ্গে ক‚টনৈতিক সর্ম্পক রয়েছে শুধু জর্ডান ও মিশরের। সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও বাহরাইন দীর্ঘদিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে সরব থাকলেও এখন তাদের বড় শত্রু ইরান। তারা ইসরাইলকে দেখছেন মিত্র হিসেবে।

সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র আল শারক আল আওসাতে এক নিবন্ধে হোসেন সবকসি নামের একজন এই নাটকের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেছেন, নাটকে আরব জাহানে ইহুদিদের উপস্থিতির ইতিহাস তুলে ধরে সাহসের পরিচয় দেওয়া হয়েছে।

নাটকের নির্মাতা ও পরিবেশকরা দাবি করেছেন, সমসাময়িক আরব রাজনীতির সঙ্গে এর কোনো সর্ম্পক নেই। এমবিসি চ্যানেলের দাবি, এটা দেখানোর উদ্দেশ্য, সহিষ্ঞুতা, সংযম, মুক্ত সমাজ ও সহাবস্থানের বার্তা দেওয়া।
নাটকটির সহ-রচয়িতা বাইরাইনি নাগরিক আলি শামস বলেছেন, গত শতকের মাঝামাঝি বাইরাইনে কর্মরত উম জান নামের একজন ইহুদি নার্সের কাহিনী এতে তুলে ধরা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য লোকদের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করা।

তবে ফিলিস্তিনিরা এসব যুক্তি নাকচ করে দিয়েছেন। গাজা শাসনকারী হামাসের মুখপাত্র হাজেম কাসেম বলেন, টিভি নাটকে জনগণের বিশ্বাসের প্রতিফলন থাকা উচিত। কিন্তু এবার আরবের কিছু নাটকে তা দেখা যাচ্ছে না। তারা দখলদারদের সঙ্গে সহাবস্থানের অদ্ভুত ধারণা প্রচার করছে। এমনকি ফিলিস্তিনি ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। তিনি বলেন, ইসরাইল আরব জাতির প্রথম শত্রু এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে।

প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে