অর্থনৈতিক মহাপ্রলয় মোকাবেলায় সাচ্চা ব্যাঙ্ক

স্বর্ণকে মুদ্রাস্ফীতি প্রতিরোধের একটি ভালো উপকরণ বলেও গণ্য করা হয় - ইন্টারনেট

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ১৪ আগস্ট ২০২০, ১৭:৫৯

কাগজের টাকা আগুনে পুড়ে যেতে পারে, পোকায় কেটে নষ্ট করে ফেলতে পারে, বহু ব্যবহারে ময়লা-মলিন হয়ে যেতে পারে। কিন্তু স্বর্ণ, সময়ের শত ঝড়-জলেও তা থাকে অমলিন, অবিকৃত। তাই তো যুগ-যুগব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কটকালে বিপন্ন মানুষের 'সেফ হ্যাভেন' বা নিরাপদ আশ্রয়রূপে কাজ করেছে স্বর্ণ, বিশেষ করে চলমান কোভিড-১৯এর মতো বিশ্বব্যাপী কোনো দুর্যোগের সময়।

১৯৭০এর দশকে 'গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড' বা স্বর্ণের পরিমাপে মুদ্রা যাচাই করার প্রথা পরিত্যক্ত হলেও সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো তাদের সক্ষমতা বজায় রাখতে এখনও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ রেখেছে। কেননা, যে-কোনো রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক দুর্যোগে স্বর্ণই সবচাইতে নিরাপদ বলে মনে করা হয় এবং প্রয়োজনে যে-কোনো সময় একে ক্যাশ বা নগদ অর্থে রূপান্তরিত করা যায়।

মনে করুন, করোনা মহামারী শুরুর আগে থেকেই বিশ্ব অর্থনীতিতে অশনি সঙ্কেত শোনা যাচ্ছিল আর তাতেই অনেক দেশ তাদের স্বর্ণের মজুদ বাড়াতে শুরু করে। ২০১৯ সালে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো তাদের মজুদে আরো ৬৫০ টন স্বর্ণ যোগ করে। এর আগের বছর মজুদ বাড়ায় আরো বেশি - ৬৫৬ টন। পূর্ববর্তী ৫০ বছরে এতো বেশি স্বর্ণ মজুদের ঘটনা আর কখনও ঘটেনি। বরং ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার আগের কয়েক দশকব্যাপী বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলোই ছিল স্বর্ণের সবচাইতে বড় বিক্রেতা।

বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো এখন ব্যাপকভাবে চেষ্টা করছে স্টোরেজ থেকে তাদের স্বর্ণ ফিরিয়ে আনতে। তাদের স্বর্ণ এখন মজুদ করা আছে নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ এবং ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডে। এ দু' প্রতিষ্ঠানই বিশ্বের বৃহত্তম স্বর্ণ মজুদাগার।

ভেনেজুয়েলাই প্রথম মজুদ থেকে স্বর্ণ ফিরিয়ে নিতে শুরু করে। ২০১১ সালে তারা নিউ ইয়র্ক থেকে ১৬০ টন স্বর্ণ ফিরিয়ে নেয়। ভেনেজুয়েলার ১০০ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের আরো স্বর্ণ মজুদ আছে লন্ডনের ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডে। কিন্তু ভেনেজুয়েলাকে ওই স্বর্ণ ফেরত দিতে অস্বীকার করে ব্রিটেন। তাদের যুক্তি হলো, ভেনেজুয়েলার মাদুরো সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি ব্রিটিশ সরকার। কাজেই ওই সরকারের হাতে স্বর্ণ ফেরত দেয়া যায় না। এ নিয়ে ব্রিটিশ হাইকোর্টে মামলা করে ভেনেজুয়েলা। জুলাই মাসের গোড়ার দিকে মামলার রায় হয়। রায়ে হেরে যায় ভেনেজুয়েলা।

স্বর্ণকে মুদ্রাস্ফীতি প্রতিরোধের একটি ভালো উপকরণ বলেও গণ্য করা হয়। কেননা, পণ্য ও সেবার ক্রমবর্ধমান দাম তখন ডলারের মূল্য কমিয়ে দিতে থাকে। ওই সময় অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো বেশি করে টাকা ছাপাতে থাকলে মুদ্রাস্ফীতি মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়। এমন ঝুঁকির বিপরীতে স্বর্ণ তখন বিবেচিত হয় একটি নির্ভরযোগ্য আশ্রয়রূপে। কেননা, সত্যিকার অর্থে এই ধাতুটিই পারে দীর্ঘ সময় নিজের মূল্য ধরে রাখতে।

চলতি ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে স্বর্ণের পারফরম্যান্স ছিল দারুণ! এ সময় অন্য সব শ্রেশির সম্পদকে হটিয়ে দিয়ে মার্কিন ডলারের হিসাবে স্বর্ণের দাম বাড়ে ১৬ দশমিক আট শতাংশ। জুন মাসের শেষ দিকে প্রতি আউন্স স্বর্ণ বিক্রি হতে থাকে এক হাজার ৭৭০ মার্কিন ডলারে। ২০১২ সালের পর স্বর্ণমূল্যের এমন উত্থান আর দেখা যায়নি।

চলতি বছরের শুরুতে তুরস্কের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ১৪৮ টন স্বর্ণ কেনে। এখন পর্যন্ত ওই দেশে এটাই সর্ববৃহৎ স্বর্ণ ক্রয়। ন্যাশনাল ব্যাংক অব পোল্যান্ডের গভর্নর অ্যাডাম গøাপিনস্কি বলেন, একটি দেশ কতোটা শক্তিশালী, স্বর্ণের মাপেই তা বোঝা যায়।

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল তালিকা থেকে জানা যায় কোন দেশের ভান্ডারে কী পরিমাণ স্বর্ণ মজুদ আছে। প্রথমেই আসা যাক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথায়। দেশটির স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ আট হাজার ১৩৩ দশমিক পাঁচ টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের ৭৮ দশমিক নয় শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্ণ মজুদের এ পরিমাণ অপর তিনটি দেশের মিলিত মজুদের সমান। ফরেইন রিজার্ভের শতকরা হিসাবেও এ মজুদ বিশ্বে সর্বোচ্চ। এ মজুদের অর্ধেক অর্থাৎ চার হাজার ৫৮৩ টন রাখা আছে ফোর্ট নক্সের ইউএস বুলিয়ন রিজার্ভেটরিতে। শুধু এর মূল্যই ২৩৬ দশমিক চার বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

স্বর্ণ মজুদের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরের স্থানে আছে জার্মানি। তাদের মজুদের পরিমাণ তিন হাজার ৩৬৩ দশমিক ছয় টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের ৭৫ দশমিক দুই শতাংশ। ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে জার্মানি তাদের মজুদের একটা বিপুল অংশ অর্থাৎ ৬৭৪ টন স্বর্ণ প্যারিস ও নিউ ইয়র্ক থেকে দেশের ফ্রাঙ্কফুর্টে সরিয়ে নিয়ে আসে।

স্বর্ণ মজুদে তৃতীয় স্থানের দেশ ইতালির মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৪৫১ দশমিক আট টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের ৭৮ দশমিক নয় শতাংশ। অবিশ্বাস্য শোনালেও সত্য, অন্য-সব দেশের মতো ইতালির মজুদকৃত স্বর্ণের মালিক কিন্তু ইতালি সরকার নয়। এসব স্বর্ণের মালিক বানকা ডি' ইতালিয়া বা ব্যাঙ্ক অব ইতালি।

মজুদ করা স্বর্ণের কিছু অংশ ইতালির রাজধানী রোমে ব্যাঙ্কের নিজস্ব ভল্টে এবং বাকিটা সুইস ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক, নিউ ইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ এবং ব্রিটেনের ব্যাঙ্ক অব ইংল্যান্ডে গচ্ছিত আছে।

ইতালি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তীব্র অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ভুগলেও সরকার পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, বাজেট ঘাটতি সামাল দিতে ব্যাঙ্ক অব ইতালিতে মজুদ রাখা স্বর্ণ বিক্রির কোনো ইচ্ছা সরকারের নেই। কারণ, ওই স্বর্ণের মালিক সরকার নয়।

চতুর্থ স্থানে আছে ফ্রান্স। দেশটির স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ৪৩৬ টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের ৬৫ শতাংশ।

ফ্রান্স এসব স্বর্ণের বেশিরভাগই অর্জন ১৯৫০ থেকে ১৯৬০এর দশকে। এগুলো রক্ষিত আছে প্যারিসের ব্যাংকু দ্য ফ্রান্স বা ফ্রান্সের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। তারা গত ক' বছরে এখান থেকে কিছু স্বর্ণ বিক্রি করে। তবে বিভিন্ন মহল থেকে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

রাশিয়ার স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ দুই হাজার ২৯৯ দশমিক দুই টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের ২২ দশমিক ছয় শতাংশ।
গত সাত বছর ধরে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ কিনেছে রাশিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক। এ সময় তারাই ছিল স্বর্ণের সবচাইতে বড় ক্রেতা। শুধু গত দুই বছরেই ব্যাঙ্কটি ৪০০ টনের বেশি স্বর্ণ কেনে। ২০১৭ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। এ নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার সম্পর্কের ব্যাপক অবনতি হয়। এ সময় ডলার থেকে দূরে সরে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশটি ২২৪ টন স্বর্ণ কেনে।

চীনের স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ এক হাজার ৯৪৮ দশমিক তিন টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের ৭৮ দশমিক নয় শতাংশ। স্বর্ণ মজুদের দিক থেকে দেশটির অবস্থান বিশ্বে ষষ্ঠ হলেও উৎপাদনের দিক থেকে তারাই শীর্ষে।

বিশ্বের মোট আহরিত স্বর্ণের ১২ ভাগই আসে চীনের বিভিন্ন খনি থেকে। তবে ওই দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশের ফলে স্থানীয়ভাবে স্বর্ণের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে।

স্বর্ণ মজুদের দিক থেকে সুইজারল্যান্ডের স্থান বিশ্বে সপ্তম হলেও মাথাপিছু মজুদের হিসাবে এর স্থান বিশ্বে শীর্ষে। দেশটির স্বর্ণ ব্যবসার বেশিরভাগই চলে হংকং ও চীনের সাথে। সুইজারল্যান্ডের স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ এক হাজার ৪০ টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের সাড়ে ছয় শতাংশ।

বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি জাপানের স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ ৭৬৫ দশমিক দুই টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের তিন দশমিক এক শতাংশ।

বিশ্বের যেসব দেশ ব্যাঙ্কের সুদের হার কমানোর ক্ষেত্রে সামনের সারিতে, জাপান তাদের অন্যতম। জাপানের সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক ২০১৬ সালেও সুদের হার শূণ্যের নিচে নিয়ে যায়। তাদের এ পদক্ষেপ স্বর্ণের চাহিদা বৃদ্ধিতে ব্যাপক সহায়তা করে।

মজুদের দিক থেকে সুইজারল্যান্ডের স্থান বিশ্বে সপ্তম হলেও মাথাপিছু মজুদের হিসাবে এর স্থান বিশ্বে শীর্ষে। দেশটির স্বর্ণ ব্যবসার বেশিরভাগই চলে হংকং ও চীনের সাথে । ছবি : ইন্টারনেট
মজুদের দিক থেকে সুইজারল্যান্ডের স্থান বিশ্বে সপ্তম হলেও মাথাপিছু মজুদের হিসাবে এর স্থান বিশ্বে শীর্ষে। দেশটির স্বর্ণ ব্যবসার বেশিরভাগই চলে হংকং ও চীনের সাথে । ছবি : ইন্টারনেট

 

ভারত হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্বর্ণ ব্যবহারকারী দেশ। এই মূল্যবান ধাতুটির একটা বিরাট অংশের আমদানিকারকও তারা। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতে বিয়ের মৌসুম। এ সময় দেশটিতে স্বর্ণের ব্যবসাও জমজমাট হয়ে ওঠে।

ভারতের স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ আট হাজার ৬৫৪ দশমিক নয় টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের সাড়ে সাত শতাংশ।
স্বর্ণ মজুদে বিশ্বের শীর্ষ ১০-এর শেষ স্থানে আছে নেদারল্যান্ডস। তাদের স্বর্ণ মজুদের পরিমাণ ৬১২ দশমিক পাঁচ টন। এটা তাদের ফরেইন রিজার্ভের ৭০ দশমিক নয় শতাংশ।

২০১৪ সালে নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভে মজুদ রাখা স্বর্ণের ২০ ভাগ দেশে ফিরিয়ে আনে নেদারল্যান্ডস। ২০১৯ সালে ডাচ ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক বলে, স্বর্ণ হচ্ছে 'আস্থার নোঙ্গর' এবং যে-কোনো সম্ভাব্য ''অর্থনৈতিক মহাপ্রলয়ের প্রস্তুতির জন্য সাচ্চা ব্যাঙ্ক''।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে