ডলারের দিন কি ফুরিয়ে আসছে?

রাশিয়া আর চীন ডলারকে এড়িয়ে ব্যবসা করার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে - ছবি : সংগ্রহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ২২ মার্চ ২০২২, ২৩:১১

বর্তমান বিশ্বে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে আধিপত্য রয়েছে মার্কিন ডলার আর ইউরোর; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্ররা রাশিয়ার ৩০০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আটকে দেয়ার পর ডলারের এই আধিপত্য নিয়ে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই এখন বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে নিরাপদ বিকল্পের খোঁজ করছেন। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, ডলারের বিকল্প তৈরি করাটা খুব একটা সহজ হবে না। বিকল্প হিসেবে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের কিছু সম্ভাবনা রয়েছে। ডলারের বিকল্প মুদ্রা কী সম্ভব হবে? 

 

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পদ আটকে দেয়ার পর বিদেশী ব্যাংকের রিজার্ভে ডলার ও ইউরোর আধিপত্য নিয়ে নতুন বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৮ সালের শেষের দিকে যখন সারা বিশ্বে আর্থিক বিপর্যয় চলছিল, তখন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে।

পুঁজিবাজারগুলোতে তখন অস্থিরতা চলছে। অনেক মানুষের ব্যাবসায় বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যাংক লেহম্যান ব্রাদার্স দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করে। মানুষের জমানো পেনশান নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, আর মানুষ বেহিসেবী চাকরি হারায় - এই ছিল তখনকার অবস্থা। এই সমস্যার কেন্দ্রে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন বাজার।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, লোভী ব্যাঙ্কার ও বেপরোয়া ঋণদাতাদের নিয়ন্ত্রণে আমেরিকান রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণেই স্মরণকালের ভয়াবহতম ওই আর্থিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছিল। জিম রজার্সের মতো বিনিয়োগকারীরা এই সঙ্কটকে ডলারের পতনের প্রথম ধাপ হিসেবে উল্লে করেছিলেন।

চলতি হিসাবের ঘাটতি মেটানোর জন্য ওয়াশিংটন সে সময় বিদেশ থেকে বিপুল অঙ্কের অর্থ ঋণ নিয়েছিল। তখন মনে হয়েছিল, মার্কিন ডলার বিক্রি করে অন্য কোন নিরাপদ বিকল্প খুঁজে নেয়ার সময় এসেছে; কিন্তু ঘটেছিল তার উল্টোটা। যুক্তরাষ্ট্রে তখন অর্থের পাহাড় জমতে শুরু করে এবং সরকারী বন্ডগুলো দেদারসে বিক্রি হয়।

ইউরোপ ও এশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তখন মার্কিন ট্রেজারি বন্ড কিনে ডলারের রিজার্ভ গড়ে তুলছিল। যে দেশটা আর্থিক অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী, সেই দেশেই আন্তর্জাতিক তারল্য গিয়ে জমা হচ্ছিল।

মার্কিন ডলারের শক্তি আসলে এখানেই। আর্থিক সঙ্কটের সময় বিনিয়োগকারীরা সেভিংস বাঁচানোর জন্য ডলারের উপর নির্ভর করে। বিশ্বে যে ৯৫০ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ ডলারের ব্যাংকনোট রয়েছে। এর মোটামুটি অর্ধেকটাই যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে অন্যান্য দেশে ঘুরছে। মূল্যস্ফীতির হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন জায়গায় মানুষ ডলার কিনছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্র দেশগুলো গত মাসে রাশিয়ার উপর যে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের ডলার নির্ভরতার বিষয়টি পুনর্মূল্যায়ন করতে পারে। ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ আটকে দেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আউসমেন মানডেং বলেছেন, স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে ডলারের বিকল্প অনুসন্ধানের এ ধরণের প্রচেষ্টা অনেক বেড়ে যাবে। উদীয়মান বাজারগুলোর জিডিপি কম-বেশি বিশ্বের পুরো জিডিপির অর্ধেক; কিন্তু আন্তর্জাতিক লেনদেনের ক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব মুদ্রা কোন কাজে লাগে না। এই দেশগুলো নিঃসন্দেহে আগামী বছরগুলোতে এই বৈষম্য দূর করার জন্য সব ধরণের চেষ্টা করবে।

অন্যদিকে, বিশ্ব অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান হলো ২০ শতাংশ; কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো দুর্দিনের জন্য যে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ জমিয়ে রাখে, তার ৬০ শতাংশই হলো মার্কিন ডলার।

যে কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার দেশের স্থানীয় বিদেশী মুদ্রার বাজারে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে রিজার্ভ গড়ে তোলে। যেমন, চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মার্কিন ডলার কেনে, যাতে ইউয়ানের মান পড়ে না যায়। চীনের রফতানি বাজার যাতে প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে পারে।

মানডেং মনে করেন, কোন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি বিদেশী মুদ্রার বাজারে বড় অঙ্কের লেনদেন করতে চায়, তাহলে সেখানে মার্কিন ডলারই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে কাজ দেয়। এটা করতে হলে, আপনার এমন একটা মুদ্রা লাগবে, যেটার তারল্য অনেক বেশি। আর ডলার ঠিক সেই কাজটাই করছে।

মার্কিন ট্রেজারি বন্ড কেনার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং প্রাইভেট বিনিয়োগকারীরা সাত ট্রিলিয়ন ডলার রিজার্ভ জমিয়েছে। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা এখন তাদের মুদ্রা জমানোর মধ্যে বৈচিত্র আনছে। ২০১৫ সালে মার্কিন ট্রেজারি বন্ডের ৫০ শতাংশই ছিল বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে। ২০২১ সালে এই বন্ডের পরিমাণ কমে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। অর্থাৎ, বিনিয়োগকারীরা তাদের রিজার্ভে অন্যান্য মুদ্রার পরিমাণ বাড়াচ্ছে।

রাশিয়া বেশ অনেক বছর ধরেই তাদের ডলার নির্ভরতা কমিয়ে আনছে। ২০১৪ সালে ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত করার পর মস্কোর উপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তখন তাদের এই প্রচেষ্টা আরও জোরদার হয়। রাশিয়ার এখন যে ৩০০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ আটকে দেয়া হয়েছে, এর অধিকাংশই রয়েছে ইউরো এবং অন্যান্য বিদেশী মুদ্রায়।

রিজার্ভ ব্যবহার করতে না পারায় রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাৎক্ষণিক। রাশিয়ার মুদ্রা রুবলের দর পড়ে গেছে। মুদ্রাকে বাঁচিয়ে রাখতে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার ৯ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২০ শতাংশ করেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আর তাদের মিত্রদের দিক থেকে সম্মিলিতভাবে এ ধরণের বাধা আসতে পারে, সেটা রাশিয়ার ভাবনায় ছিল না।

রাশিয়ার সাতটি ব্যাংককে সুইফট থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। এই সিস্টেমের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো পারস্পরিক লেনদেন করে থাকে। টয়োটা থেকে নিয়ে অ্যাপল, ম্যাকডোনাল্ডের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো রাশিয়াতে তাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে। রাশিয়ার অর্থনীতির উপর এই সব পদক্ষেপের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

এই প্রতিবেদনের ভিডিও দেখুন

প্রশ্ন হলো রিজার্ভের ক্ষেত্রে ডলারের বদলে অন্য মুদ্রার ব্যবহার কি সম্ভব? পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সেলিম রাজা মনে করেন, এই কাজ ততটা সহজ হবে না। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ডলারের যে আধিপত্য রয়েছে, সেটা সহজে চলে যাবে না। বিকল্প হিসেবে চীন তাদের নিজস্ব মুদ্রা ইউয়ান ব্যবহারের চেষ্টা করছে। আরেকটি বিকল্প হলো স্পেশাল ড্রয়িং রাইটস বা এসডিআর। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ এক ঝুড়ি মুদ্রা বোঝাতে এই এসডিআর ইউনিট ব্যবহার করে থাকে।

প্রশ্ন হলো কেউ কি নতুন রিজার্ভ মুদ্রা সৃষ্টি করতে পারে? উত্তর হলো হ্যাঁ, এটা করা সম্ভব; কিন্তু এর কার্যকারিতার জন্য সুনির্দিষ্ট বাণিজ্য ব্লক থাকতে হবে।

রাশিয়া আর চীন ডলারকে এড়িয়ে ব্যবসা করার জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কতগুলো পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহার করা। এছাড়া পারস্পরিক মুদ্রা বিনিময়েও তারা সম্মত হয়েছে। সুইফটের বিকল্প হিসেবে রাশিয়া যে সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অব ফিনান্সিয়াল মেসেজেস বা এসপিএফএস গড়ে তুলেছে। তার সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য বিদেশী ব্যাংকগুলোকে তারা আমন্ত্রণও জানিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেখিয়ে দিয়েছে, কিভাবে একটি বাণিজ্য ব্লক মার্কিন ডলারের জায়গায় বাজারের শেয়ার দখল করতে পারে। এই মুহূর্তে বৈশ্বিক বিদেশী মুদ্রার যে রিজার্ভ তার ২০ শতাংশই হচ্ছে ইউরোতে। রাশিয়া চীনের কাছে যা রফতানি করে, তার অধিকাংশের মূল্য নেয় ইউরোতে; কিন্তু রাশিয়ার কাছে চীন যে সব রফতানি করে, সেগুলোর বেশির ভাগের মূল্য দিতে হয় ডলারে।

বাস্তবতা হলো, ওয়াশিংটনের সাথে কোন দেশের সমস্যা হলে তাদের জন্য ইউরোও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে ইউরোপীয় ইউনিয়নও তাদের উপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে। রাশিয়া এখন কঠিন বিপদে পড়ে বিষয়টা উপলব্ধি করছে।

ডলারের অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একটা মুদ্রা হতে পারে ইউয়ান। চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় রফতানিকারক দেশ। ঋণ ও অন্যান্য সুবিধার মাধ্যমে বেইজিং এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভালোই প্রভাব বিস্তার করেছে; কিন্তু চীন বেশ কঠোরভাবে তাদের অর্থব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। তাদের মুদ্রার নাগাল পাওয়াটা সহজ নয়। তাছাড়া চীনের আইনি ব্যবস্থা ও আদালতের ব্যপারে বিনিয়োগকারীদের অতটা আস্থা নেই।

বৈশ্বিক লেনদেনের মাত্র ৩ দশমিক ২ শতাংশের ক্ষেত্রে এখন ইউয়ান ব্যবহৃত হচ্ছে। মার্কিন ডলার আর ইউরো ব্যবহার হচ্ছে যথাক্রমে ৪০ শতাংশ আর ৩৬ শতাংশ। সেলিম রাজা মনে করেন, চীন ইউয়ানকে দেশের বাইরে ছড়াতে দেয়নি। কোন দেশের একটা ব্যাংকে ঢুকে চাইলেই আপনি ইউয়ান একাউন্ট খুলতে পারবেন না। ডলারের কিন্তু এই সুবিধাটা আছে।