কাতারে নেমেছে পর্যটকদের ঢল

- সংগৃহীত

  • ফারজানা তানিয়া
  • ২৯ অক্টোবর ২০২৩, ১৪:৫৭

২০২২ বিশ্বকাপ কাতারের মতো ছোট্ট একটি দেশের আয়োজনগত সামর্থ্যরে বহিঃপ্রকাশই শুধু ঘটায়নি, সঙ্গে তাদের পর্যটন সম্ভাবনার বিশাল দুয়ারও খুলে দিয়েছে। সময়টাতে দর্শকরা যে শুধু মাঠে ফুটবল দেখেছেন তা নয়, সঙ্গে কাতারের আকর্ষণীয় স্থানগুলোর সৌন্দর্যও উপভোগ করেছেন। এর মাধ্যমে আরব সংস্কৃতির সৌন্দর্য ও উদারতা নিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে নতুন এক বার্তা পৌঁছে দিতে পেরেছে কাতার।

কাতার সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটন-শিল্পে অবিশ্বাস্য অগ্রগতি করেছে। বিশ^কাপের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশীদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনরুদ্ধারকে এই শিল্পে দারুণভাবে কাজে লাগিয়েছেন তারা। দেশটিতে পর্যটনের নতুন নতুন ক্ষেত্রের আধুনিকায়ন হচ্ছে; সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের উৎসবেরও আয়োজন হচ্ছে। সবমিলিয়ে কাতার এখন নিজেকে বৈশি^ক পর্যটনের অন্যতম সেরা আসনে বসাতে পেরেছে।

দেশটির পর্যটনের উন্নতিকে বলা হচ্ছে নাটকীয়। তেলসমৃদ্ধ দেশটির এই শিল্প যে এভাবে বিকশিত হবে, কিছুদিন আগেও তা ধারণার বাইরে ছিল।

এর আগে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসিভুক্ত দেশগুলো থেকে এত বেশি সংখ্যক পর্যটক কাতারে কখনও আসেননি। এখন বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, সৌদি আরব কিংবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রচুর নাগরিক বেড়াতে আসছেন ছোট্ট দেশটিতে। শুধু যে নাগরিকরা আসছেন তা নয়, জিসিসি-র দেশগুলোতে কর্মরত শ্রমিকরাও সময়-সুযোগ পেলে কাতার ঘুরে যাচ্ছেন।

আরব আমিরাতের দুবাই কিংবা বাহরাইনের রাজধানী মানামার ঐতিহ্যবাহী পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে ঘিরে অথবা সৌদি আরবের ক্রীড়া ও বিনোদন উৎসব ‘রিয়াদ সিজন’-এ যে-সংখ্যক পর্যটকের ভিড় হয়, এখন তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পর্যটকদের আতিথেয়তা দিচ্ছে দোহা।

কাতারে এখন যে-সংখ্যক পর্যটকের ভিড়, তাতে কর্তৃপক্ষের ধারণা, ২০২৩ সালে দেশটিতে বিদেশিদের আগমন ২০২২ সালের চেয়ে ৩৪৭ শতাংশ বাড়বে।

কাতার এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়নও পর্যটক বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। ২০১৭ সালে, সন্ত্রাসবাদকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলে বাহরাইন, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। ২০২১ সালে সেই অচলাবস্থার অবসান ঘটে। কূটনৈতিক টানাপড়েনের বছরগুলোতেও তারা অবকাঠামো উন্নয়নে ঈর্ষণীয় সাফল্য দেখিয়েছে। এরপর সৌদি, বাহরাইন, আরব আমিরাত তো বটেই, সঙ্গে মিসর, জর্দানসহ অন্য দেশগুলোর সম্পর্কও বাড়ে কাতারের।

দোহার উত্তরে ‘লুসাইল উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ড’-এর মতো বিভিন্ন নতুন উদ্যোগ পর্যটকদের জাদুর পরশ দিচ্ছে। লুসাইল সিটি কমপ্লেক্সে তারা খরচ করেছে ৪৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি। আরও বেশ কয়েকটি বিস্ময়কর প্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে আছে দোহার উপকণ্ঠে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের মশেইরেব প্রকল্প। এই রিটেইল, কালচারাল ও বিজনেস কমপ্লেক্সে আউটডোর এয়ার কন্ডিশনার এবং ওয়াকওয়ের মতো হৃদয়গ্রাহী বিভিন্ন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পর্যটন মাথায় রেখে মওসুম-ভিত্তিক বিভিন্ন উৎসবেরও আয়োজন হচ্ছে দেশটিতে।

অন্য যেসব দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের কাতারে টেনে নিচ্ছে, এর মধ্যে রয়েছে ইসলামী শিল্প জাদুঘর। এই জাদুঘর জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত হয় ২০০৮ সালে। দোহায় অবস্থিত ভবনটিকে দূর থেকে একটির উপরে আরেকটি করে রাখা বাক্সের স্তুপের মতো দেখায়। এর ক্রিম রঙের চুনাপাথরের বাহ্যিক অংশটি ইউরোপীয় স্থাপত্যের আমেজ দেয়। পরিচ্ছন্ন জ্যামিতিক প্রান্তগুলো জানান দেয় এর মজবুত কাঠামোর কথা। সূর্যের আলোতে প্রান্তগুলো ঝলমল করতে থাকে। ভবনের উপরে চোখের মতো স্লিটটি বানানো হয়েছে ১৩ শতকের ওজুর ফোয়ারা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। যাদুঘরের কাছাকাছি হওয়ার জন্য লেকের ওপর দিয়ে একটি সেতু অতিক্রম করতে হয়। বাইরের অবকাঠামোটি যতটাই সরল, এর অভ্যন্তর ভাগটি ঠিক ততটাই জটিল। এই বৈপরীত্য প্রতিটি দর্শনার্থীকে হতবাক করে দেয়।

পর্যটনের আরেক আকর্ষণ সামরিক দুর্গ আল কুত। দোহার এই ঐতিহাসিক দুর্গটি নির্মিত হয়েছে ১৯২৭ সালে, যাকে বলা যায় ভয়ঙ্কর সুন্দর। কয়েক যুগ ধরেই দুর্গটি জাদুঘর হিসেবে পর্যটকদের বিস্ময়ের খোরাক যোগাচ্ছে। এখনে রয়েছে পুরনো কাঠের সাজসজ্জা, প্রাচীন মাছ ধরার উপকরণ, তৈলচিত্র এবং পুরনো ফটোগ্রাফ। কাতারের ইতিহাস ও এর বাসিন্দাদের জীবনধারা বোঝার জন্য এই দুর্গে একদিনের আতিথ্য গ্রহণ করা যথেষ্ট।

খোর আল আদাইদ-এর আকর্ষণ বলে শেষ করার মতো নয়। কাতারের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চারদিকে দ্বীপঘেরা এই জলাধার ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ১২ কিলোমিটার চওড়া। জলাশয়টি ১০ কিলোমিটার চ্যানেলের মধ্য দিয়ে যুক্ত হয়েছে পারস্য উপসাগরের সঙ্গে। খোর আল আদাইদ কচ্ছপ, গাজেল, অরিক্স, ডলফিন এবং বিপন্ন ডুগংসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল। পর্যটকদের জন্য এখানে স্যান্ড স্কিইং, কোয়াড বাইকিং এবং উটের পিঠে চড়ার ব্যবস্থা আছে।

তাছাড়া, দোহার সামাজিক কেন্দ্র হিসাবে বিখ্যাত সৌক ওয়াকিফ। ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি এখানে কেনাকাটা করা, সুস্বাদু খাবার খাওয়া ও আকর্ষণীয় স্থানীয় ক্যাফেগুলোতে অলস সময় পার করার সুযোগ আছে। এখানকার স্থাপত্য ও সূচিকর্ম, মশলা, সুগন্ধি, বাহারি ফল এবং আগারউড দিয়ে তৈরি চমৎকার ধূপ ওউদ দেখার জন্য জড়ো হন ভ্রমণপিপাসুরা।

সৌক ওয়াকিফের ঠিক পাশে অবস্থিত ফ্যালকন সৌক কেবল বাজপাখি সংশ্লিষ্ট যাবতীয় সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো। এর বহিরঙ্গনে বাজপাখিদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়টি দেখা যায়। প্রশিক্ষিত হওয়ায় এই পাখিগুলোর একেকটির দাম একেকটি বিলাসবহুল গাড়ির চেয়েও বেশি। বাজপাখি পালন ও এর প্রশিক্ষণ স্থানীয়দের একটি ঐতিহ্যবাহী ক্রিয়াকলাপ। বাজপাখির হাসপাতালগুলো যে-কোনো পাঁচ তারকা হাসপাতালকে টেক্কা দিতে সক্ষম।

কাতারে আরামদায়ক ভ্রমণের জন্য আদর্শ জায়গা ফুওয়াইরিত সৈকত। নির্জন এক সমুদ্র সৈকত। দোহা থেকে ৯১ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এই সাদা বালির প্রশস্ত সৈকতে দর্শনার্থীরা কাঁচের নীল পানি এবং হাজারও রঙিন ঝিনুকের উপকূলরেখা উপভোগ করতে পারেন। তবে আশপাশে কোনো খাবারের দোকান না থাকায় এখানে আসার সময় ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েই আসতে হবে।

দৌড়বিদ অথবা সাইক্লিস্টদের জন্য প্রিয় জায়গা হতে পারে সমুদ্র তীরবর্তী ‘দোহা কর্নিশ’। ১৯৭০ দশকের শেষ এবং ১৯৮০ দশকের শুরুতে দোহার উপকূলকে নতুন করে তৈরি করা হয়েছিল। এখান থেকে দিনের বেলায় দোহা উপসাগরের স্বর্গীয় রঙ; সন্ধ্যায় চমৎকার সূর্যাস্ত আর রাতে শান্ত পানিতে আলোকিত শহরের প্রতিফলন থেকে চোখ ফেরানো যায় না।

দোহা মরুভূমি উপভোগ না করলে কাতার ভ্রমণ অর্থহীন। মনোরম সৌন্দর্যে বিমোহিত হওয়ার জন্য এই অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপের বিশালতাই যথেষ্ট। তবে রোমাঞ্চকর মরুভূমি সাফারি উপভোগের সময় মানিয়ে নিতে হবে উটের ঝাঁকুনির সঙ্গে। মরুভূমির আবহাওয়া সাধারণত প্রতিকূল থাকে। এর ভেতর দিয়ে মাইলের পর মাইল আদিম ও চকচকে বালির সাগরকে উপভোগ করতে হলে সঙ্গে রাখতে হবে উপযোগী কাপড়। সেই সঙ্গে শরীরকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও পানীয় নেওয়ার কথা মনে রাখতে হবে।

কাতার গেলে পার্ল দ্বীপের কথা কখনও ভুলবেন না। প্রায় চার বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত জায়গাটি মূলত বিলিয়ন ডলারের এক কৃত্রিম দ্বীপ। এটি পশ্চিম দোহার উপসাগরের উপহ্রদ থেকে ৩৫০ মিটার দূরে অবস্থিত, যার অবয়বটি মুক্তার রজ্জুসদৃশ। পার্লের রয়েছে ১২টি এলাকা, যার প্রতিটি স্বতন্ত্র ভূমধ্যসাগরীয় বায়ুমণ্ডলের বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। এখানে পাওয়া যাবে উপকূলবর্তী ভিলা, পথচারী-বান্ধব বাগান এবং আলফ্রেস্কো ক্যাফে। দ্বীপের সবচেয়ে জনপ্রিয় এলাকাটি হলো মেডিনা সেন্ট্রাল। এর বর্গাকার নৈসর্গে আছে পাম গাছের বুলেভার্ড এবং ঝর্ণা ভবন। মনোরম কানাত কোয়ার্টিয়ার দ্বীপের আরেকটি বিখ্যাত অংশ, যা ভেনিসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এর আঁকাবাকা খাল, রঙিন ভিলা এবং খিলানযুক্ত সেতু দারুণ কিছু সময়ের জন্য পর্যটকদের লোভাতুর করে তোলে।

ভ্রমণের আরেক আকর্ষণ অ্যাসপায়ার পার্ক। পার্কটি ২১৭ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। রাজধানীর সবচেয়ে বড় এই সবুজ স্থানে ম্যানিকিউর করা লন, অপূর্ব পায়ে হাঁটা পথ, অ্যাসপায়ার ডোম, ব্যায়ামের সরঞ্জাম, শপিং মল, শিশুদের খেলার মাঠ, সুন্দর ফোয়ারা, ক্যাফে এবং খাবারের জায়গা রয়েছে। এখানে দেখা মিলবে বিখ্যাত বাওবাব গাছের। পার্কের কেন্দ্রস্থলে দোহার একমাত্র হ্রদে প্রচণ্ড গরম থেকে আশ্রয় নিতে আসে বিভিন্ন ধরনের পাখি।

এসব আয়োজনই পর্যটকদের বারবার কাতারে টেনে নিচ্ছে। দেশটির পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অনুমান, ২০২২ সালে যেখানে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা ছিল ২৬ লাখ, এ-বছর এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৬০ থেকে ৭০ লাখ।

কাতারকে বলা হয় বিশে^র সবচেয়ে নিরাপদ দেশ। অবকাঠামোর নান্দনিক সৌন্দর্য তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এত নিখুঁত মিশেল অন্য দেশে পাওয়া যায় না। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার তো আছেই; দেশটির প্রতিটি অঙ্গ পর্যটন-বান্ধব। সুসভ্য মানুষ বলে স্থানীয়দের খ্যাতি রয়েছে। সুশাসনের জন্য ক্ষমতাসীনরা বিশ^ব্যাপী সমাদৃত। এই দেশে তো পর্যটকদের ভিড় হবেই।