রুশ অস্ত্রের দিকে ঝুঁকছে আরব দেশগুলো

এমএকেএস-ইন্টারন্যাশনাল অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড স্পেস শো - সংগৃহীত

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৮ আগস্ট ২০২১, ১৫:৩৭

আধুনিক সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা। এই অঞ্চলের ধনী দেশগুলোর নিজেরা উৎপাদন করতে না পারলেও সুপার পাওয়ারগুলোর কাছ থেকে কেনে কোটি কোটি ডলারের সমরাস্ত্র। এক্ষেত্রে অনেকদিন ধরেই এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রের ক্রেতা বেশি। তবে এবার এই অস্ত্রের বাজার ধরতে বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে রাশিয়া। সাশ্রয়ী মূল, সর্বাধূনিক প্রযুক্তিসহ বেশ কিছু কারণে ক্রেতা দেশগুলোও আকৃষ্ট হচ্ছে মস্কোর তৈরি অস্ত্রের প্রতি।

গত জুলাইয়ের শেষ দিকে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর বাইরের ছোট্ট শহর জুকোভস্কিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে এমএকেএস-ইন্টারন্যাশনাল অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড স্পেস শো। ছয় দিনের ওই প্রদর্শনীতে রাশিয়ার তৈরি কমব্যাট এয়ারক্রাফট, হেলিকপ্টার, ড্রোন, এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইলসহ অত্যাধুনিক কিছু সামরিক সরঞ্জাম প্রদর্শন করা হয়েছে। প্রদর্শনীতে বিভিন্ন দেশের ক্রেতাদের সাথে আয়োজকদের সাড়ে তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কেনাবেচার চুক্তি হয়েছে বলেও জানা গেছে।

এই প্রদর্শনীতে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় স্বার্থ ছিল তার সর্বাধুনিক ট্যাকটিক্যাল ফাইটারের জন্য ক্রেতা বাছাই করা। সুখোই এলটিএস নামের ফাইটারটি ইতোমধ্যেই অনানুষ্ঠানিকভাবে সু-সেভেন্টি ফাইভ নামে পরিচিতি পেয়েছে। এটির জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে সম্ভাব্য ক্রেতা হিসেবে টার্গেট করেছে মস্কো। বৈশিষ্ট ও দক্ষতার দিক থেকে বিমানটিকে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার এফ-থার্টিফাইভের বিকল্প।

ওই প্রদর্শনীতে কোন কোন দেশের সাথে রাশিয়ার সমরাস্ত্র নিয়ে চুক্তি হয়েছে সেটি প্রকাশ করা হয়নি। শুধুমাত্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে বেসামরিক হেলিকপ্টার নিয়ে একটি চুক্তির কথা জানা গেলেও, সামরিক এয়ারক্রাফট বা অন্যান্য প্রতিরক্ষা সামগ্রী নিয়ে কিছু বলছে না মস্কো।

সুখোই এলটিএস ফাইটারটিকে রাশিয়া ব্যাপকভাবে রফতানি করতে চাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে, বিমানটি পুরোপুরি প্রস্তুত হতে সময় লাগবে সাড়ে ৫ বছর। বিদেশি ক্রেতাদের জন্য এর দাম হবে ৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আনুসাঙ্গিক অন্যান্য বিষয়সহ এর দাম হতে পারে ৫৫ থেকে ৭০ মিলিয়ন ডলার। দামের দিক থেকে এটি যুক্তরাষ্ট্রের এফ-থার্টিফাইভ-ই শুধু নয়, ফোর প্লাস জেনারেশনের এফ-সিক্সটিন ফাইটারের চেয়েও সাশ্রয়ী।

সু-সেভেন্টি ফাইভ নিয়ে রাশিয়ার উদ্দেশ্য বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর বাজার ধরা। সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে, এখানে অনেক দেশেরই উন্নত প্রযুক্তির ফাইটার জেটের প্রয়োজন রয়েছে, তারা কিনতেও আগ্রহী। আর তাদের কাছে এগুলোর বিক্রির চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। এই অঞ্চলের সবগুলো দেশেরই পর্যাপ্ত আর্থিক সামর্থ আছে যেকোন সর্বাধূনিক ফাইটার কেনার। তবুও আপাতত তাদের ফোর প্লাস জেনারেশনের ফাইটার নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। এই অঞ্চলে ইসরাইল একমাত্র দেশ, যাদেরকে এফ-থার্টিফাইভ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর কাউকে নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের একেবারে শেষের দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে এফ-থার্টিফাইভ বিক্রির চুক্তি হলেও সেটি নিয়ে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে জো বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব নেয়ার পর। এমনকি এখন পর্যন্ত এ বিমান সরবরাহের কোন সম্ভাব্য সময়সীমাও নির্ধারিত হয়নি।

যে কারণে রাশিয়া এই দেশগুলোর এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে ফাইটার জেটের রফতানি বৃদ্ধি করতে চাইছে। এতদিন রাশিয়ার কোন পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার জেট না থাকায় মুসলিম প্রধান এই দেশগুলো খুব একটা রাশিয়ামুখী হয়নি; কিন্তু তাদের সু-সেভেন্টি ফাইভ প্রস্তুত হয়ে গেলে, সেই সঙ্কট কেটে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র তার এফ-থার্টি ফাইভ নিয়ে যতটা রক্ষণশীল ও কড়াকড়ির বিধান রেখেছে, রাশিয়া তার চেয়ে অনেক সহজ করবে ফাইটার রফতানির প্রক্রিয়া। আবার মার্কিন বিমানগুলোর চেয়ে দামেও অনেক সাশ্রয়ী হবে রাশিয়ার বিমানগলো, যেটি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করবে।

এর আগেও এই অঞ্চলে রাশিয়া কিছু প্রতিরক্ষা সামগ্রী বিক্রি করেছে। যেমন ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্র তুরস্কের কাছে তাদের এস-ফোর হান্ড্রেড বিক্রয় ছিল মস্কোর বড় একটি কৌশলগত সাফল্য। বিষয়টি নিয়ে আঙ্কারার সাথে ওয়াশিংটনের বৈরীতা এতটাই প্রবল যে, তুরস্ককে এফ-৩৫ প্রকল্প থেকে বাদ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক বৈরীতার সর্বোচ্চ সুবিধা রাশিয়া নিতে পারেনি, কারণ তাদের পঞ্চম প্রজন্মের কোন যুদ্ধবিমান নেই। যদি তারা এফ-থার্টি ফাইভের বিকল্প হিসেবে তুরস্ককে একই ধরনের বিমান দিতে পারতো, সেটি রাশিয়াকে এই অঞ্চলে বড় ধরনের কৌশলগত সুবিধা এনে দিত।

স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রির্চাস ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র আমদানি বেড়েছে ২৫ শতাংশ। সৌদি আরব নিজেদের আগের আমদানির তুলনায় বৃদ্ধি করেছে ৬১ শতাংশ, মিসর আমদানি বৃদ্ধি করেছে দ্বিগুণেরও বেশি। এবং কাতার করেছে প্রায় চারগুন। মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র রফতানিতে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য অনেকদিন ধরেই। গত চার বছরে এই অঞ্চলে যত অস্ত্র বিক্রি হয়েছে তার ৪৭ শতাংশই করেছে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

বিশ্বব্যাপী অস্ত্র রফতানিতে রাশিয়ার অবস্থা দুই নম্বরে; কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে তাদের মার্কেট শেয়ার যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া গত এক দশকে তাদের অস্ত্র রফতানি কমেছে ২২ শতাংশ। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সময়েও রাশিয়ার অস্ত্র রফতানি কমেছিল প্রায় একই হারে। অর্থাৎ ক্রমশই তাদের অস্ত্র বাণিজ্যের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। এই ঘাঁটতি পুষিয়ে নিতেই তারা টার্গেট করেছে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলকে। এই অঞ্চলে গত কয়েক বছর ধরে অস্ত্র প্রতিযোগতা বেশ জমে উঠেছে; কিন্তু অঞ্চলটিতে একমাত্র ইরান ছাড়া আর কেউ অস্ত্র উৎপাদন করে না। যে কারণে তাদের নির্ভর করতে হয় সুপার পাওয়ারগুলোর ওপর।

মধ্যপ্রাচ্যে সমরাস্ত্র রফতানিতে বিশেষ করে উপসাগরীয় দেশগুলোতে রাশিয়ার পিছিয়ে থাকার একটি কারণ তাদের আধুনিক সমরাস্ত্রগুলোর পুরোমাত্রায় উৎপাদন না থাকা। গত তিন দশকে তারা মূলত রফতানি করেছে সোভিয়েত যুগের অস্ত্রগুলোর আধুনিক সংস্করণ।

১৯৯০ এর দশকে উপসাগরীয় বেশ কয়েকটি দেশের সাথে রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য সামরিক-প্রযুক্তিগত সম্পর্ক ছিলো। এর কারণ সোভিয়েত আমলে নির্মিতি অস্ত্রগুলোই সে সময়ে ছিল আধুনিক, যার কারণে আরব শাসকরা পেতে চাইতেন সেসব অস্ত্র। ওই সময় অস্ত্রের বাজারে দাপট ছিল রাশিয়ার তৈরি বিএমপি-৩ ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকেল, স্মার্চ ও ইউরাগান মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেম, প্যান্টসার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের। সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েতসহ কয়েকটি দেশ এগুলো আমাদানিও করেছিলো। কিন্তু আজকের দিনে সেগুলো সেকেলে হয়ে গেছে, আর তাই পিছিয়ে পড়েছে রাশিয়া।

রাশিয়ার নির্মাণাধীন পঞ্চম প্রজন্মের সু-৫৭ ফাইটার নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো কাটেনি। এটির ফুল স্কেলে উৎপাদন কবে শুরু হবে সেটিও কেউ বলতে পারছে না। আবার বিমানটি খুব ব্যয়বহুলও। তাছাড়া কোন বিমান শুরুতে উৎপাদনকারী দেশ ব্যবহার না করলে, সেটি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে পারে না। যে কারণে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে ফাইটার বিক্রিতেও পিছিয়ে পড়ছে দ্রুত।

এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও তাদের চেয়ে এগিয়ে আছে আরেক সুপার পাওয়ার চীন। বেইজিং তার পঞ্চম প্রজন্মের ফাইটার জেটের উৎপাদন পুরোদমে শুরু করেছে, যার কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার একাধিক দেশ তাদের ক্রেতা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। চেংদু জে-টুয়েন্টি ইতোমধ্যেই চীনের বিমান বাহিনীতে যুক্ত হয়েছে। এছাড়া শেনইয়াং এফসি-থার্টিওয়ান নামে আরেকটি হালকা ফাইটার জেট ডেভলমমেন্ট করছে চীন। পঞ্চম প্রজন্মের এই বিমানটি ইতোমধ্যেই বেশ কয়েক ধাপের ফ্লাইট টেস্ট সম্পন্ন করেছে। পাশাপাশি তুরস্কও প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে। কারণ গত দুই দশকে তুরস্ক অস্ত্র রফতানি অনেকাংশে বৃদ্ধি করেছে। তাদের তৈরি ড্রোন ইতোমধ্যেই বিশ্ববাজারে সাড়া ফেলেছে। উপসাগরীয় দেশগুলোতে তুর্কি অস্ত্রের বড় বাজারও আছে।

তবে এসব দেশকে টপকেই রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ধরার জোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ২০০০ সালের পর থেকে তারা আবার সময়োপযোগী অস্ত্র উৎপাদন ও রফতানিতে মনোযোগী হয়েছে। ফাইটার জেট ছাড়াও রফতানি তালিকায় রাশিয়া রেখেছে টি-ফোরটিন আরমাটা ট্যাংক, টি-ফিফটিন ও কুরগানেটস ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিলেক, বুমেরাং হুইল আর্মার্ড ভেহিলেক, কোয়ালিশন আর্টিলারি সিস্টেম ইত্যাদি। যার ফলে দেখা গেছে ২০১১ সালের পর থেকে আলজেরিয়া ও মিসরের কাছে তাদের অস্ত্র রফতানি বেড়েছে অনেকাংশে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ঘোষণা করেছে মিসরকে ৫টি সু-৩৫ মাল্টিরোল ফাইটার সরবরাহের কথা। ২ বিলিয়ন ডলারের ওই চুক্তিতে মোট ২৪ টি সু-৩৫ কিনছে মিসর।

তবে এ অঞ্চলে আরো বিক্রি বাড়াতে তাদের দরকার হবে, এসব অস্ত্রের ফুল স্কেল উৎপাদন শুরু করা। ইতোমধ্যেই রাশিয়ার নতুন বেশ কিছু অস্ত্র সিরিয়া যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে। যেগুলোর সাফল্য ক্রেতাদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করবে। পরীক্ষামূলক ব্যবহার আর যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারের মধ্যে যে রাত-দিন পার্থক্য সেটিই এখানে ব্যবধান গড়ে দেবে বলে বিশ্বাস করছে রাশিয়া।

বলা হচ্ছে, সিরিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার অস্ত্রগুলোর সফলতা দেখেই মিসর বিশাল অঙ্কের সমরাস্ত্র কিনেছে। মিসর একে একে কিনেছে মিগ টুয়েন্টি নাইন ও সু-থার্টিফাইভ ফাইটার জেট, কে-ফিফটি টু অ্যাটাক হেলিকপ্টার, এস-থ্রি হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, টি-নাইনটি ট্যাংকসহ অনেক সমরাস্ত্র। ২০১৪ সালের পর থেকে তারা ইরাকের কাছে ফাইটার, অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও ট্যাংক বিক্রি করেছে।

অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্য রফতানির মতো প্রতিরক্ষা সামগ্রী রফতানি মানে শুধুই বিক্রি নয়। প্রতিরক্ষা পণ্য রফতানির সাথে সাথে ওই দেশে অনেক প্রযুক্তিগত সুবিধাও স্থানান্তর করা হয়। যেটি রফতানিকারক দেশকে অনেক কৌশলগত সুবিধা দেয়। তাই মধ্যেপ্রাচ্যের অস্ত্রের বাজার ধরতে পারলে সেটি রাশিয়ার জন্য এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের উপলক্ষও হয়ে উঠবে তাতে সন্দেহ নেই।