সামরিক বাহিনীতে কুকুর কতটা জরুরি


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০২ আগস্ট ২০২১, ১৫:১৬

সেনাবাহিনীতে কুকুরের ব্যবহার নতুন নয়। মিসরীয়, গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যের ইতিহাসে কুকুরের ব্যবহারের কথা জানা যায়। দুটি বিশ্বযুদ্ধেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বেশ কিছু কুকুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে কুকুরের ব্যবহার আনুষ্ঠানিকতা পেতে শুরু করে। বর্তমানে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতেই কাজ করছে বিভিন্ন প্রজাতির আড়াই হাজার কুকুর। এদের মধ্যে আবার ৭০০টি নিয়োজিত আছে বিদেশের সামরিক অভিযানে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে মার্কিন বাহিনীর যে দলটি আইএস নেতা আবু বকর আল বাগদাদিকে আটক করেছিল, সেই দলটির সাথে ছিল একটি কুকুর। ‘কোনান’ নামের ওই কুকুরটি সেই অভিযানে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতটাই যে, ওই অভিযানের পর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কোনো সৈনিক বা কমান্ডারের ছবি শেয়ার না করে টুইটারে কোনানের ছবি শেয়ার করেছিলেন। এরপর রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে যায় মার্কিন সেনাবাহিনীর ডেল্টা ফোর্সের ওই কুকুরটি।

গ্রেফতার এড়াতে বাগদাদি আত্মঘাতি হওয়ার চেষ্টায় যে সুইসাইড ভেস্টের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন, তাতে আহত হয়েছিল ওই কুকুরটিও। ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার অভিযানেও মার্কিন বাহিনীর সাথে অংশ নিয়েছিল কায়রো নামের একটি কুকুর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়ে মার্কিন বাহিনীতে কমিশন পেয়েছিল সার্জেন্ট স্টাবি নামের একটি কুকুর।

অনেক দিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী তাদের বিশেষ অভিযানে কুকুর ব্যবহার করে আসছে। এসব অভিযানে উন্নত প্রশিক্ষণ পাওয়া এই কুকুরগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও সাহসী ভূমিকা রাখে। মার্কিন নেভী সিল, আর্মি রেঞ্জার্সের মত স্পেশাল ইউনিটগুলোর অবিচ্ছেদ্য অংশ এখন মিলিটারি ডগ হিসেবে পরিচিত এসব কুকুর। বিস্ফোরক খুঁজে বের করা, টার্গেটকৃত লোককে কাবু করা, গোপন হুমকি চিহ্নিত করার কাজে ব্যবহৃত হয় এসব কুকুর। যে কারণে এদের ডাকা হয় মাল্টিপারপাস ক্যানাইনস বা এমপিসি নামে। হেলিকপ্টার থেকে দড়ি বেয়ে ভূমিতে নামা কিংবা সৈনিকদের কোলে চড়ে প্যারাস্যুট জাম্প করার প্রশিক্ষণও দেয়া হয় এই প্রাণীগুলোকে।

এই কুকুরগুলোকে বিশেষভাবে বাছাই করা হয় এবং অনেক কঠিন প্রশিক্ষণের পর পাস মার্ক পেয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। সেসব প্রশিক্ষণ হয় যেমন কঠিন, তেমনি উন্নতমানের। তবে কী কী উপায় এসব প্রাণীকে সেনাবহিনীর সাথে কাজ করা শেখানো হয় সেগুলো কখনো প্রকাশ করা হয় না। এর জন্য রয়েছে সব সব দেশের সামরিক বাহিনীর নিজস্ব সিলেবাস। দ্রুত গতি সম্পন্ন, নিঃশব্দে কাজ করা এবং প্রয়োজনের সময় ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা এগুলোর অন্যতম যোগ্যতা। চির পরিচিত ঘেউ ঘেউ ডাক ভুলেই যেতে হয় এসব কুকুরকে।

যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর মিলিটারি ওয়ার্কিং ডগ প্রোগ্রামটি বাস্তবায়িত হয় টেক্সাসের লেকল্যান্ড বিমান ঘাঁটিতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এসব কুকুর সংগ্রহ করা হয়। তবে বেশির ভাগই আসে জার্মানি অথবা নেদারল্যান্ড থেকে। বছরে চারবার মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর প্রশিক্ষক, লালন-পালনকারী ও প্রাণী চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত টিম বিভিন্ন দেশে যায় মার্কিন বাহিনীর জন্য কুকুর কিনতে। অত্যন্ত নিখুতভাবে প্রতিটি কুকুর সংগ্রহ করে এই টিম। কুকুর পছন্দ হলে সব ধরণের মেডিকেল টেস্ট করে প্রথমে কুকুরে সুস্থ্যতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়। এর মধ্যে শরীরের ভেতরের বিভিন্ন দিক যাচাই ছাড়াও দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণ শক্তি ও ঘ্রাণ শক্তি পরীক্ষা করা হয়। প্রতিটি কুকুর যাতে অন্তত ১০ বছর সার্ভিস দিতে পারে সে বিষয়টি মাথায় রেখেই পছন্দ করা হয়।

স্বাস্থ্যপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর কুকুরের স্বভাব-চরিত্র যাচাই করা হয়। এই পর্যায়ে বিশেষজ্ঞরা ১০ দিন ধরে প্রাণীগুলোর পোষ মানার সম্ভাব্যতা, কোন কিছু খুঁজে পাওয়ার ক্ষমতা এবং কতটা আগ্রাসী তা যাচাই করেন। এরপর কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কেনার পর শুরু হয় প্রশিক্ষণ। তবে প্রশিক্ষণ নেয়া সব কুকুরই সার্ভিসে যোগ দিতে পারে না। মার্কিন সেনা কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা যায়, ৫ মাসের প্রশিক্ষণ শেষে প্রায় অর্ধেক কুকুরকে বাদ দেয়া হয়, সঠিক যোগ্যতা অর্জন করতে না পারার কারণে।

সামরিক বাহিনীতে ব্যবহারের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে বেলজিয়ান মেলিনয়েস। এছাড়া ল্যাবরাডর, রিট্রেইভার্স, জ্যাক রাসেল ও জার্মান শেফার্ডও আছে অনেক। বুদ্ধিমত্ত্বা, প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক্ষমতা- ইত্যাদি কারণে এসব কুকুর পছন্দ করা হয় এই কাজে। বেলজিয়ান মেলিনয়েস তার গতি, আগ্রাসী মনোভাব ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও টিকে থাকতে পারার কারণে সেনা কর্মকর্তাদের কাছে সবচেয়ে বেশি পছন্দের।

বিস্ফোরক কিংবা মাদকদ্রব সন্ধান করা শেখানো হয় এসব কুকুরকে। গন্ধ শুকে শুকে এসব পাওয়া গেলে হ্যান্ডলারকে জানিয়ে দেয় দ্রুত। কোন ব্যক্তিকে টার্গেট করা হলে, তার হাতে কী ধরণের অস্ত্র থাকলে কিভাবে আক্রমণ করতে হলে সে সম্পর্কেও প্রশিক্ষণ পায় কুকুরগুলো। যে কারণে দাম ও প্রশিক্ষণ ব্যয়সহ মার্কিন সেবাহিনীর প্রতিটি কুকুরের পেছনে ব্যয় হয় ৪০ হাজার ডলারের বেশি। বাংলাদেশী টাকায় যা প্রায় ৩৪ লাখ। তবে তীক্ষè বুদ্ধিমত্ত্বা আর উন্নত প্রশিক্ষণের ফলে এসব কুকুর এতটাই চৌকশ হয়ে ওঠে যে, সেগুলো বাহিনীর জন্য হয়ে ওঠে অমূল্য সম্পদ।

মার্কিন সেনাবাহিনী যেসব কুকুর ব্যবহার করে সেগুলোকে যে কোন কম্পাউন্ডের মধ্যে ছেড়ে দিলে লুকিয়ে থাকা টার্গেটকৃত ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে পারে। কোন ব্যক্তির ব্যবহৃত কাপড়ের গন্ধ শুকে তাকে খুঁজে বের করতে পারে নির্ভুলভাবে। ওই ব্যক্তি কোন রুমের ভেতর দরজা বন্ধ করে থাকলেও দরজার কাছে পৌছে যেতে পারে। যে কারণে একজন সিরীয় গুপ্তচরের চুরি করে আনা আইএস নেতা বাগদাদীর দুটো আন্ডারওয়ারের গন্ধ শুকেই তাকে চিহ্নিত করেছিল কোনান নামের কুকুরটি। আবার ১০ বা তার বেশি গাড়ির বহরের মধ্যে কোন একটিতে বিস্ফোরক লুকানো থাকলে দুই মিনিটের মাঝে তা চিহ্নিত করতে পারে।

টার্গেট খুঁজে পাওয়ার পর দ্রুত আক্রমণ চালায় কুকুর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সে টার্গেটকৃত ব্যক্তির গায়ে সর্বশক্তি দিয়ে কামড় বসায়। যা ছোটানো প্রায় অসম্ভব। আবার প্রায় ৩০ কেজি ওজনের কুকুরটিকে নিয়ে দৌড়ে পালানোও সম্ভব নয়। হ্যান্ডলার এসে ছেড়ে দিতে না বলা পর্যন্ত টার্গেটের গায়ের সাথেই ঝুলে থাকে কুকুর। বলা হয়ে থাকে, বিশ্বের দ্রুততম মানব উসাইন বোল্টও গতিতে হারাতে পারবে না এই কুকুরগুলোকে। অরনল্ড শোয়ার্জেনেগরের সাথে লড়তেও ভয় পাবে না এরা।

প্রতিটি কুকুর একজন সৈনিকের তত্ত্বাবধানে থাকে। তাকে বলা হয় হ্যান্ডলার। হ্যাান্ডলারের কমান্ড শুনেই কাজ করে তারা। তার কথা কিংবা ইশারা শুনেই বুঝতে পারে কী করতে হবে। কুকুরের পরিচর্যা ছাড়াও এর চিকিৎসা বিষয়ক প্রশিক্ষণও দেয়া হয় হ্যান্ডলারকে।

সামরিক বাহিনীতে কুকুরগুলো সাধারণত নন কমিশন্ড অফিসার হিসেবে থাকে। তবে বিশেষ নৈপুণ্য দেখিয়ে কোন কোনটি কমিশন অর্জন করে। একটি সামরিক কুকুর যে, র‌্যাংক অনুযায়ী নিয়োগ পায়- সাধারণত তার নিচের পদের কোন সৈনিকের কাছে তাকে পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়। অর্থাৎ প্রতিটি কুকুর তার হ্যান্ডলারের চেয়ে উচ্চপদস্থ হয়ে থাকে। হ্যান্ডলার যাতে কুকুরের প্রতি অবহেলা, অবজ্ঞা না করতে পারে সে জন্য এই ব্যবস্থা নেয়া হয়।

যুদ্ধক্ষেত্রে কুকুরের গায়ে পরানো থাকে বুলেট প্রুফ ভেস্ট। এর সাথে থাকে টর্চ লাইট, ক্যামেরা, সেন্সর ও কয়েক ধরনের কমিউনিকেশন ইকুইপমেন্ট। যে কারণে হ্যান্ডলার তার কুকুরকে হেলিকপ্টার থেকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ক্যামেরায় কুকুরের চলাফেরা দেখে রেডিওর মধ্যেমে তাকে কমান্ড করতে পারেন। রেডিও সিগন্যালের মাধ্যমে এক মাইল দূর থেকেও এগুলোকে অপারেট করা যায়। কোন এলাকায় সেনারা প্রবেশের আগে সেখানকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য আগে কুকুর পাঠানো হয়। কুকুর বলে দিতে পারবে জায়গাটি কতটা নিরাপদ। ২০১৮ সালের নভেম্বরে আফগানিস্তানে আল কায়েদার একটি ঘাঁটিতে ঢুকে গুলিতে নিহত হয় মাইকো নামের একটি কুকুর। কুকুরটিকে আগে না পাঠিয়ে সৈন্যরা সেখানে ঢুকলে অনেক সেনার প্রাণহানী হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে মাস্টার্ড গ্যাস আক্রমণ সম্পর্কে মিত্র বাহিনীর সৈন্যদের আগে ভাগেই সতর্ক করেছিল সার্জেন্ট স্টাবি নামের কুকুরটি।

সৈনিকদের মতো যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরা কুকুরদের মাঝেও অবসাদ বা আতঙ্ক কাজ করে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তখন বেশি শব্দ শুনলে ভয় পাওয়া, অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠা, কাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলাসহ বিভিন্ন অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখা দেয় তাদের মাঝে। এসব ক্ষেত্রে কুকুরদের নন কমব্যাট জবে পাঠিয়ে দেয়া কিংবা অবসর দেয়া হয়।

দীর্ঘদিন এক সাথে থাকার ফলে হ্যান্ডলারের সাথে দারুণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে কুকুরটির। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রর সরকার আইন করেছে, কোন কুকুরকে সার্ভিস থেকে অবসরে পাঠানোর পর সেটি দত্তক নেয়ার ক্ষেত্রে তার হ্যান্ডলার অথবা তার পরিবারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার।