হাইপারসনিক অস্ত্রের জন্য মরিয়া যুক্তরাষ্ট্র


  • মেহেদী হাসান
  • ১০ এপ্রিল ২০২১, ০৫:২৩

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করে এখন অবধি বিশ্বব্যাপী সামরিক আধিপত্য বজায় রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সম্প্রতি সমরাস্ত্র প্রযুক্তি উদ্ভাবনে রাশিয়া আর চীনের কাছে বড় রকমের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়েছে এ দুটি দেশের কাছে। বিশেষ করে হাইপারসনিক মিসাইল এবং এআই প্রযুক্তি। যুক্তিরাষ্ট্রের কাছে যেমন নেই হাইপারসনিক মিসাইল, তেমনি নেই এ মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা। সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা একে হাইপারসনিক গ্যাপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ২০১৮ সালে অ্যাভানগার্ড হাইপারসনিক মিসাইলের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন এবং ২০১৯ সালে এ মিসাইল মোতায়েন করে। রাশিয়ার এ হাইপারসনিক মিসাইলের গতি শব্দের চেয়ে ২৭ গুণ বেশি। রাশিয়ার এ মিসাইল উদ্ভাবন এবং মোতায়েনের খবরে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিরক্ষা কৌশলে বড় ধাক্কা লাগে।

রাশিয়া ও চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের হাইপারসনিক গ্যাপ মেনে নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে অসম্ভব। কারণ শব্দের চেয়ে ৫ গুণ বেশি গতিতে ছুটে আসা কোনো হাইপারসনিক মিসাইল যদি বোমা নাও বহন করে, তবু তার আঘাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরী ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। পেন্টাগনের পরিকল্পনাবিদদের আতঙ্কগ্রস্ত করার জন্য এটাই যথেষ্ট।

ইউএস গভমেন্ট একাউন্ট্যাবিলিটি অফিসের সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে হাইপারসনিক অস্ত্র উদ্ভাবনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ৭০টি প্রকল্প রয়েছে। এর জন্য বরাদ্দ রয়েছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এসব প্রকল্পের কার্যক্রম চলবে। তবে হাইপারসনিক অস্ত্র উদ্ভাবন কার্যক্রম সবচেয়ে গতি লাভ করে ২০২০ সালে। এসময় যুক্তরাষ্ট্র এর পেছনে আড়াই বিলিয়ন ডলার খরচ করে। আর এক মাসের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক মিসাইলের পরীক্ষা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হাইপারসনিক অস্ত্র উদ্ভাবনের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখছে প্রতিরক্ষা বিভাগ। এ ছাড়া জ্বালানি বিভাগ এবং নাসার নিজস্ব কর্মসূচী রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নেভি তাদের ফান্ড থেকে ৬ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে । এরপর যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স বরাদ্দ দিয়েছে ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। নেভি এবং এয়ার ফোর্সের এ অর্থ মূলত ব্যয় হবে হাইপারসনিক গ্লাইড ভেহিক্যাল উদ্ভাবনে। যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি হাইপারসনিক গ্লাইড বডি নির্মান করতে চায় যা নেভি, এয়ার ফোর্স এবং ল্যান্ড ফোর্স সব শাখা কমনলি ব্যবহার করতে পারবে।

ডিফেন্স এডভান্সড রিসার্স প্রজেক্টস এজেন্সি ডারপার সাথে যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্স হাইপারসনিক গ্লাইড বডি উদ্ভাবন কর্মসূচী চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এ হাইপারসনিক গ্লাইড বডি নিক্ষেপ করা যাবে বি-৫২ বোমারু বিমান থেকে। অপর দিকে পেন্টাগনও বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে হাইপারসনিক অস্ত্র উদ্ভাবনের পেছনে যাতে এ ক্ষেত্রে তারা রাশিয়া ও চীনের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারে।

হাইপারসনিক উদ্ভাবনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে যে ৭০টি প্রকল্প চলমান রয়েছে তার মধ্যে ৫টি প্রকল্প এ অস্ত্র উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে। অপর ৬৫টি প্রকল্প গুলো আছে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পর্যায়ে।

যুক্তরাষ্ট্র বিমান বাহিনীর এয়ার লঞ্চড রেপিড রেসপন্স উইপন বা এরো হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম হাইপারসনিক অস্ত্র। এটি উৎপাদনের পর্যায়ে প্রবেশ করছে। ২০২২ সালের শেষ নাগাদ এ অস্ত্র ব্যবহারে সক্ষম হবে যুক্তরাষ্ট্র।

এছাড়া আগামী এক মাসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র হাইপারসনিক মিসাইল পরীক্ষা চালাতে যাচ্ছে । এ হাইপারসনিক মিসাইল বি-৫২ বোমারু বিমান থেকে ছোড়া হবে। ইতোমধ্যে একটি প্রটোটাইপ মিসাইল বিমানের বসানো হয়েছে বি-৫২ বিমানে । বি-৫২ বিমান ৫০ হাজার ফিট উচ্চতায় ওঠার পর এ মিসাইল ছোড়া হবে। এটি একটি এয়ার লঞ্চড রেপিড রেসপন্স হাইপারসনিক মিসাইল। এয়ার লঞ্চড হাইপারসনিক মিসাইল উদ্ভাবন করেছে বিশ্বের শীর্ষ সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের লকহিড মার্টিন।

এলগিন বিমান ঘাটির এয়ারফোর্স আর্মামেন্ট অধিদপ্তর থেকে মার্চের শেষের দিকে হাইপারসনিক মিসাইল টেস্টের কথা জানানো হয়েছে । মিসাইলটির পুরো নাম এজিএম-১৮৩ এ এয়ার লঞ্চড রেপিড রেসপন্স উইপন। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য হাইপারসনিক মিসাইলের গ্লাইড ভিহিক্যাল এর সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের হাইপারসনিক অস্ত্র বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গেম চেঞ্জার হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে হাইপারসনিক মিসাইল। এটা অপ্রতিরোধ্য এবং বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে মাত্র আধা ঘন্টার মধ্যে নির্খুত হামলা পরিচালনায় সক্ষম।

বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক আর অবিশ্বাস্য ক্ষমতাসম্পন্ন মিসাইলের অধিকারী রাশিয়া। ভয়ঙ্কর এ মিসাইলের নাম অভ্যানগার্ড হাইপারসনিক মিসাইল। এটি রাশিয়ার অরেনবার্গ অঞ্চলে দক্ষিন উরাল পর্বত এলাকায় মোতায়েন করা হয়েছে। পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম এ মিসাইলের গতি শব্দের গতির চেয়ে ২৭ গুণ বেশি। রাশিয়া চাইলে এটি এখন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো সময় নিক্ষেপ করতে পারে। অর্থাৎ কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়া গোটা পৃথিবী এখন রাশিয়ার পারমাণবিক বোমার আওতায়।

রাশিয়ান হাইপারসনিক এ মিসাইল এত দ্রত গতির যে, রাডারের মাধ্যমে তাকে সনাক্ত করা সম্ভব নয়। ২০১৬ সালে যখন এটির পরীক্ষা চালানো হয় তখন ঘন্টায় ৭ হাজার মাইল অতিক্রম করে লক্ষ্য বস্তুতে সফলভাবে আঘাত করে এ মিসাইল। ২০১৫ সাল থেকে ক্রমাগত পরীক্ষা চালানোর পর ২০১৮ সালে এ মিসাইল উদ্ভাবনের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা দেন রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এ মিসাইল আক্রমন থেকে রক্ষা পেতে হলে একমাত্র পথ হচ্ছে রাশিয়ার সাথে মিসাইল নিয়ন্ত্রন চুক্তি করা। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে বর্তমান সম্পর্ক মোটেই ভাল নয়। সুতরাং এ ধরনের মিসাইল নিয়ন্ত্রন চুক্তির সম্ভাবনা নেই। রাশিয়ার হাইপারসনিক মিসাইল মোতয়েনের ফলে বর্তমান সকল অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি যেমন অকার্যকর হয়ে গেছে তেমনি পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পৃথিবী নতুন ঝুকির মুখে পড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন রাশিয়ার এ মিসাইল সমরাস্ত্র জগত, রাজনৈতিক ও ভূকৌশলগত আধিপত্য বিস্তারের ক্ষেত্রে গেম চেঞ্জারের ভূমিকায় অবর্তীণ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র দেশ যেমন জাপান, দক্ষিন কোরিয়া, তাইওয়ান, পোল্যান্ড, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ইসরালের কাছে মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরবরাহ করেছে। কিন্তু এগুলো মোটেই দূর পাল্লার ও তীব্র গতির ক্ষেপনাস্ত্র হামলা প্রতিহত করতে সক্ষম নয়। এগুলো কেবল মাত্র ক্ষুদ্র আক্রমন বা টারমিনাল প্রতিরক্ষামূলক।

অ্যাভানগার্ড মিসাইলের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক দিক হলো রাশিয়া এর সাহায্যে প্রথমে হামলা করলে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের যুদ্ধে তারা জয়ী হবে। কারণ এ হামলা ঠেকানোর ব্যবস্থা নেই অন্যদের কাছে।

রাশিয়ার এ হাইপারসনিক মিসাইল মোতায়েন সকল কৌশলগত অস্ত্র চুক্তিকে হতাশ করে । বিশেষ করে এ মিসাইল মোতায়েন যুক্তরাষ্ট্রের সকল মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার প্রতি সরাসরি হুমকি এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের সকল অস্ত্র চুক্তিও অসাড় হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন রাশিয়া প্রথমে ন্যাটো সদস্যদের ওপর সীমিত আকারের পারমাণবিক বোমার হামলা চালাতে পারে। সেটা যাতে রাশিয়া করতে না পারে সেজন্য ট্রাম্প প্রশাসন গত বছর স্বল্প ক্ষমতার নতুন একটি পারমাণবিক বোমা তৈরি করেছে। এই পারমাণবিক বোমা সাবমেরিনে মোতায়েন করেছে।

রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন অ্যাভানগার্ডকে রাশিয়ার প্রযুক্তির জন্য যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একে তিনি ১৯৫৭ সালে মহকাশে প্রথম সোভিয়েত স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের ঘটনার সাথে তুলনা করেছেন।

বর্তমানে রাশিয়া ছাড়া চীনের কাছে রয়েছে হাইপারসনিক মিসাইল। ২০১৯ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত জাকমকপূর্ণ রাষ্ট্রীয় উৎসবের দিন প্রদর্শন করা হয়েছে হাইপারসনিক ক্ষেপনাস্ত্র। তবে এর গতি বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

রাশিয়া ও চীনের হাইপারসনিক অস্ত্র ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন চীনের রেলগান, ডাইরেক্টেড এনার্জি ইউপন এবং এআই টেকনোলজি নিয়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের অনেকে মনে করে হাইপারসনিক মিসাইলের গতি এবং এটি অপ্রতিরোধ্য হিসেবে যেসব তথ্য রাশিয়া প্রচার করছে তা যুক্তিরাষ্ট্রকে ভয় দেখানোর প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছু নয়। আসলে এটা কোনো বিস্মরয়কর অস্ত্র নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সমর বিশেষজ্ঞ হাইপারসনিক অস্ত্রের পেছনে অর্থ ঢালার পক্ষে নন। তাদের মতে বর্তমানে মহাকাশে স্যাটেলাইট থাকার কারণে হাইপারসনিক মিসাইলের বেশির ভাগ গতি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব । তাছাড়া পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর ভূমির কাছাকাছি পৌঁছালে এটি ধরা পড়বে রাডারে এবং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের আওতায় আসবে। হাইপারসনিক অস্ত্র নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক থাকলেও একে বড় হুমকি হিসাবে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র।