সুদানে সামরিক উপস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া প্রতিযোগিতা


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৭ এপ্রিল ২০২১, ১২:০৫

আফ্রিকার দেশ সুদান ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আফ্রিকায় আধিপত্য বিস্তারে কয়েকটি দেশ সুদানের মাটিতে সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর চেষ্টা করছে। সুদানি কর্তৃপক্ষ এখন রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এই দুই পরাশক্তি সুদানে লোহিত সাগরের কোল ঘেঁষে নৌঘাঁটি গড়ে তুলতে চায়। দুই দেশই সুদান সরকারের কাছে এ নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছে। সুদানি কর্তৃপক্ষ দুটো প্রস্তাব যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনা করছে।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে তিনটি রাশিয়ান যুদ্ধজাহাজ এবং মার্চ মাসে একটি মার্কিন যুদ্ধজাহাজ সুদানের উপকূলীয় শহর পোর্ট সুদানের বন্দরে নোঙর ফেলেছিল। এই ঘটনায় সুদানের মাটিতে সামরিক উপস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে গোপন প্রতিযোগিতার বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। লোহিত সাগরের একটি বড় অংশ সুদানের সীমানায় পড়ায় এ এলাকায় সামরিক প্রভাব বিস্তারের জন্য সুদানের ভূমি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। দেশটি দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড আর্থিক সংকট ও জাতিগত সংঘাতে জর্জরিত হয়ে আছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশিরের ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকে সুদানের পরিস্থিতি যেন আরো ঘোলাটে হয়ে যায়। এ অবস্থায় সুদানও পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায়। কারণ ওমর আল বাশীরকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দেশগুলো সুদানের ওপর যে অবরোধ আরোপ করেছিল, তা দেশটিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সুদানের ক্ষমতাসীন সামরিক-বেসামরিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত অন্তবর্তীকালীন সরকার এরই মাঝে ইসরাইলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছে। পাশাপাশি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সুদান ১৯৯০ সালে আফ্রিকায় থাকা মার্কিন দূতাবাসে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত ও আহতদের পরিবারকে ৩শ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণও প্রদান করেছে।

২০১৯ সালে জনবিক্ষোভের মুখে ওমর আল বাশীরের বিদায়ঘণ্টা বাজার পর দেশটির সেনাবাহিনী ওমরের বিরোধী বেসামরিক নেতা ও বিরোধী দলগুলোর সাথে জোট করে ক্ষমতায় আসীন হয়। এই সরকার আফ্রিকায় মার্কিন ও রাশিয়ার সেনাদের ব্যবহারের লক্ষ্যে নানামুখী কৌশলও গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই কৌশল নিতে গিয়ে দেশটির অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতিনিধিদের মধ্যে সমস্যা দেখা দিয়েছে।

সুদান সরকারের সামরিক ও বেসামরিক প্রতিনিধিদের মধ্যে মতবিরোধ বাড়ছে। বেসামরিক প্রতিনিধিরা সরকারের ভেতরেই অনেকটা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে। তারা অভিযোগ করছে, সামরিক বাহিনী পশ্চিমাদেরকে খুশি করার জন্য নানামুখী যেসব উদ্যোগ নিয়েছে তাতে দেশটি ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়বে। তাছাড়া পররাষ্ট্রনীতি, প্রতিরক্ষাসহ অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণেও বেসরকারী প্রতিনিধিদের মতামত নেয়া হচ্ছে না বলেও তারা অভিযোগ করেছেন।

গত নভেম্বরে সুদানের সেনাবাহিনী রাশিয়ার সাথে একটি চুক্তি করে। এর আওতায় মস্কোকে সুদানের উপকূলে একটি নৌঘাঁটি স্থাপন করার অনুমতি দেয়। সুদানের উপকূলে রাশিয়ার এই নৌ ঘাঁটি স্থাপনের মধ্য দিয়ে শুধু সুদান নয় লোহিত সাগরের আশপাশের পুরো এলাকা এবং আফ্রিকা জুড়ে রাশিয়ার উপস্থিতির ইংগিত পাওয়া যায়। এই নৌ ঘাঁটিতে ৩শ জন সামরিক কর্মকর্তা থাকবেন। এ ঘাঁটি আফ্রিকায় মস্কোর নৌপথের মূল লজিস্টিক সেন্টার হিসেবেও কাজ করবে বলে জানা গেছে। এই চুক্তি সাক্ষরের ৩ মাস পর এডমিরাল গ্রিগোরোভিচ নামের রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজটি ফেব্রুয়ারিতে পোর্ট সুদানে নোঙ্গর ফেলে। রাশিয়ার এই উপস্থিতিতে বসে ছিলো না যুক্তরাষ্ট্র।

এর আগে জানুয়ারী মাসে সুদানের কর্মকর্তাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্মকর্তারা। তারা সুদানের সাথে মার্কিন সহযোগিতা ও সমন্বয় বৃদ্ধির ওপর তাগিদ দেন। গত বছরের ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের মদদদাতা ও পৃষ্ঠপোষক দেশের তালিকা থেকেও সুদানকে বাদ দিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা যখন সুদান সফর চলছে, তখনও সুদানের বন্দরে রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ নোঙ্গর করে আছে। রাশিয়ার এই জাহাজটি চলে যাওয়ার পর সেখানে মার্কিন গাইডেড মিসাইল ধ্বংসকারী ইউএসএস উইন্সটন চার্চিল যুদ্ধজাহাজ এবং ট্রান্সপোর্ট শিপ ইউএসএসএস কার্সন সিটি পোর্ট সুদানে আগমন করে। রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজটির মতো এই জাহাজগুলো সুদানে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে।

সুদানের বেসরকারী থিংক ট্যাংক মেরিটাইম সিকিউরিটি সার্র্ভিসেস কোম্পানী দীর্ঘদিন ধরে লোহিত সাগর এলাকাকে তাদের পর্যবেক্ষন চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা মনে করছেন, রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজগুলো কাছাকাছি সময়ে পোর্ট সুদানে নোঙ্গর ফেলায় দুই পরাশক্তির মধ্যে স্বার্থের সংঘাতও দেখা দিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র সুদানে রাশিয়ার উপস্থিতিকে কমিয়ে আনতে চায়। এ কারণে তারা সুদানের অন্তবর্তীকালীন সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। লোহিত সাগরে রাশিয়ার প্রভাবকে কমিয়ে আনতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সুদানের সেনাবাহিনীর সহায়তার দরকার হবে। কারণ অন্তবর্তীকালীন সরকারের নেপথ্যে মূলত দেশটির সেনাবাহিনীই কাজ করে যাচ্ছে। বেসামরিক শক্তিগুলো দুই বছরের জন্য ক্ষমতাসীন সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া পর্যন্ত এ সরকারকেই তারা ক্ষমতায় রাখতে চায়।

সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ক্যামেরন হাডসনের মতে, ওয়াশিংটন এবং মস্কো- ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুদানের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সামরিক দিক থেকে চিন্তা করলে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র উভয়ই লোহিত সাগরে নিজেদের পদচারণা নিশ্চিত করতে চাইছে। কিন্তু এর চেয়ে বড়ো বাস্তবতা হলো, এই দুই সুপার পাওয়ার রাষ্ট্র মূলত এমন একটি দেশে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে যে দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের জন্য নিজেকে অবমুক্ত করে দিয়েছে।

আমেরিকা ও রাশিয়া উভয়েরই সুদানে নিরাপত্তা স্বার্থ রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুদানের বিষয়ে এমনভাবে অগ্রসর হতে চায় যাতে দেশটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবেও ভালো অবস্থানে যেতে পারে। দেশটিতে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তর ঘটতে পারে। রাশিয়া সুদানের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য। তারা সুদানকে মার্কিন বলয় থেকে বের করে নিয়ে আসতে চায়।

সুদানের শিক্ষাবিদ এবং রেড সি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুবকর বাখিত মনে করেন, মূলত লোহিত সাগরের নিরাপত্তাকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্যই দুই পরাশক্তি জোর প্রতিদ্বন্দিতায় লিপ্ত হয়েছে। তিনি সুদানের নীতি নির্ধারকদের প্রতি আহবান জানান যাতে তারা পরাশক্তিগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপের মুখেও অটল থাকতে পারেন। তিনি মনে করেন ছোট দেশ হিসেবে সুদানের উচিত নয়, বড়ো পরাশক্তিগুলোর সাথে এমন কোনো ডাবল গেইম খেলা যার মধ্য দিয়ে সুদানের সার্বভৌমত্ব আর স্বার্থ হুমকির মুখে পড়ে। কোনো একপেশে নীতি নয়, বরং ভারসাম্যপূর্ণ কৌশল নিয়ে সুদানের পররাষ্ট্র নীতি প্রনীত হওয়া উচিত।

সন্ত্রাসের পৃষ্ঠপোষকতার তালিকা থেকে বাদ দেয়ায় সুদানের সেনাবাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। সরকারের সামরিক ও বেসামরিক প্রতিনিধিদের প্রায় সকলেই মার্কিনীদের সাথেই সম্পর্ক উন্নয়নে বেশি আগ্রহী। যদিও এর আগে রাশিয়ার সাথে সুদানের যে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে, সেক্ষেত্রে সুদানের সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন জেনারেলরাই মূল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় বেসামরিক প্রতিনিধিদেরকে সম্পৃক্ত না করায় ইতোমধ্যেই সুদানের ক্ষমতাসীন সরকারের সদস্যদের মধ্যেই এক ধরনের টানাপোড়েনের জন্ম হয়েছে।

সুদানের সেনাবাহিনী অবশ্য দাবি করছে, তারা রাশিয়ার সাথে নতুন করে কোনো চুক্তিতে যায়নি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশির রাশিয়ার সাথে যে দূতিয়ালি শুরু করেছিলেন , তারই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনী রাশিয়ার সাথে নৌঘাঁটি স্থাপন সংক্রান্ত চুক্তিটি করেছে। ধারণা করা হয়, ২০১৭ সালে সুদানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চক্রান্তের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ওমর আল বশির সরাসরি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমিরি পুতিনের সহায়তাও কামনা করেছিলেন।

পশ্চিমা পরাশক্তিগুলোর নানামুখী কর্মতৎপরতার বিষয়ে সুদানের নীতি নির্ধারকেরা পর্যাপ্ত মনোযোগ দিতে পারছেন না, কারণ এখনও সুদানের অনেকটা অংশ জুড়ে সেনাবাহিনীর সাথে বেসামরিক নাগরিকদের সংঘাত চলছে। বিশেষ করে দেশটির পূর্বাঞ্চলের গৃহযুদ্ধ ও সংঘাত ঠেকাতেও সেনাবাহিনীকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে। তবে, ক্ষমতাসীন সরকারের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠা বিভাজন ইংগিত দিচ্ছে যে, সরকারের মধ্যে থাকা সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিরা সাবেক প্রেসিডেন্ট ওমর আল বাশিরের রাশিয়া সরকারের সাথে করা চুক্তিকে এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে বেশি আন্তরিক। অন্যদিকে সরকারে থাকা বেসামরিক প্রতিনিধিরা যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে মিত্রতা করতে বেশি আগ্রহী।