যেভাবে সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছে ইন্দোনেশিয়া


  • মোতালেব জামালী
  • ০৬ মার্চ ২০২১, ০৭:০৪

বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া সামরিক শক্তি বাড়াতে বিপুল অংকের অর্থ বরাদ্দ করেছে বাজেটে। দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রভু সুবিয়ান্তো নতুন প্রজন্মের অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সমরাস্ত্র কিনতে করোনা মহামারির মধ্যেই বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনি ফ্রান্সের কাছ থেকে অত্যাধুনিক ডাসল্ট রাফাল ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৫ যুদ্ধবিমান কেনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছেন। এছাড়াও রাডার, ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামও কেনা হচ্ছে।

দক্ষিণ চীন সাগরে ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় চীনা বাহিনীর অনুপ্রবেশ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার বিপুল অঙ্কের টাকার সমরাস্ত্র ক্রয় তাৎপর্যপূর্ণ হিসাবে দেখা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রভু সুবিয়ান্তো প্রথমে অস্ট্রিয়ার কাছ থেকে তাদের ব্যবহৃত ১৫টি সেকেন্ড হ্যান্ড ইউরো ফাইটার টাইফুন যুদ্ধবিমান কেনার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। অস্ট্রিয়ার বিমান বাহিনী এসব বিমানের দামও অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা কেনা হয়নি।

সুবিয়ান্তো সব সময়ই বলে আসছেন যে, তারা নতুন প্রজন্মের যুদ্ধ বিমান কিনতে চান যেগুলো সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এবং যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় হবে সক্ষম হবে। এরপরই তিনি রাফাল যুদ্ধ বিমান কেনার বিষয়ে আগ্রহ দেখান। গত বছর অক্টোবর ও চলতি বছর জানুয়ারিতে তিনি ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেন।

ইন্দোনেশিয়ার কাছে বর্তমানে দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট ১৬টি এসইউ-২৭ ও এসইউ-৩০ যুদ্ধ বিমান রয়েছে। বিমান প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে দেশটি রাশিয়ার কাছ থেকে আরো ১১টি এস ইইউ-৩৫ যুদ্ধ বিমান কেনার চুক্তি চুড়ান্ত করেছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে সেই উদ্যোগ থেকে সরে আসে ইন্দোনেশিয়া।

এরপর তারা সমরাস্ত্র বিক্রেতা অন্য দেশগুলোর সাথে আলোচনা শুরু করে। শেষ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়া ফ্রান্সের কাছ থেকে ডাসল্ট রাফাল যুদ্ধ বিমান এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৫ইএক্স যুদ্ধ বিমান কেনার চুক্তি চুড়ান্ত করেছে। বিমান বাহিনীর ফ্রন্টলাইন প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বাড়াতে ইন্দোনেশিয়া সরকার অত্যাধুনিক এসব যুদ্ধবিমান কিনছে। আগামী তিন বছরের মধ্যে এসব যুদ্ধ বিমান সরবরাহ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পূর্ব এশিয়ায় ইন্দোনেশিয়াই হচ্ছে প্রথম দেশ যারা ফ্রান্সের কাছ থেকে ৩৬টি অত্যাধুনিক ডাসল্ট রাফাল যুদ্ধবিমান কিনছে। এর সাথে আরো কেনা হচ্ছে তিনটি লকহিড মার্টিন সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস পরিবহন বিমান, আকাশে জ¦ালানী সরবরাহে তিনটি এয়ারবাস এ৩৩০ ট্যাঙ্কার, ৬টি এমকিউ-ওয়ান প্রিডেটর ড্রোন। এছাড়াও ইতালীর কাছ থেকে কেনা হচ্ছে লিওনার্দো পূর্ব সতর্কতামূলক রাডার সিস্টেম।

সমরাস্ত্র কেনার সবকিছু ঠিকঠাক মতো এগিয়ে যায় তাহলে ইন্দোনেশিয়ার সমরাস্ত্র সংগ্রহের ইতিহাসে এটাই হচ্ছে বৃহত্তম কেনাকাটা। ঋণ ভারে জর্জরিত ইন্দোনেশিয়াকে কেবল যুদ্ধ বিমান কেনার জন্যই ব্যয় করতে হবে ১১ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্টের কাছ থেকে এফ-১৫ যুদ্ধবিমান কেনার যে অর্ডার দেয়া হয়েছে তার মধ্যে মাত্র দুটি বিমানের নির্মাণকাজ এ পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে।

চলতি বছর ইন্দোনেশিয়ার প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৯দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার যা গত বছরের চেয়ে কিছ বেশি। গত বছর প্রথমে বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ছিলো ৯ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার রাখা হলেও পরে তা ৮ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। করোনা মহামারির আর্থিক সংকটের কারণে বাজেট কমানো হয়। চলতি বছর যে বরাদ্দ রাখা হয়েছে তার মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হবে সশস্ত্র বাহিনীর আধুনিকায়নের জন্য।

ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো তার প্রথম সরকারের মেয়াদে আশা প্রকাশ করেছিলেন যে, ২০১৯ সালের মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ তিনি ২০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করবেন। তবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি যদি বছরে ৭ শতাংশ করে হয় তাহলেই কেবল এই টার্গেট পূরন করা সম্ভব হতো। কিন্তু গত ৫ বছরে দেশটির প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ শতাংশ হারে। এ কারণে প্রতিরক্ষা বাজেটের লক্ষ্যও অর্জিত হয়নি। আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠতে দেশটি বিদেশি বিনিয়োগ আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে প্রতিরক্ষা খাতে বড় ব্যয় করতে হচ্ছে দেশটিকে।

ফ্রান্স ২০০১ সালে রাফাল যুদ্ধ বিমান তৈরি সম্পন্ন করে এবং তার বিমান ও নৌ বাহিনীতে এটিকে যুক্ত করা হয়। দুই ইঞ্জিন বিশিষ্ট অত্যাধুনিক এই যুদ্ধ বিমানটি যুদ্ধ ক্ষেত্রে বহুমুখি ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। বর্তমানে ফ্রান্স ছাড়াও মিসর, কাতার এবং ভারত তার বিমান বাহিনীতে এই যুদ্ধ বিমানটি যুক্ত করেছে।

ইন্দোনেশিয়ার বিমান বাহিনীতে রাফাল যুদ্ধ বিমান যুক্ত হলে দেশটির বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠবে। কেননা আগে থেকেই তাদের বিমান বহরে সুখোই ও লকহিড মার্টিনের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান রয়েছে। সুখোই ও এফ-১৬ যুদ্ধবিমান গুলোকে ইন্দোনেশিয়া সম্প্রতি তার দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্তের দক্ষিণ চীন সাগরের জলসীমায় টহলে মোতায়েন করেছে। এখানে চীনের কোষ্টগার্ডের টহল নৌযানগুলো প্রায়ই ইন্দোনেশিয়ার জলসীমায় অনুপ্রবেশ করে বলে বলে জাকার্তা অভিযোগ করে আসছে।

চীনা কোস্টগার্ডের এই অনুপ্রবেশ বন্ধ ও যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেই দেশটি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম কিনছে।

চীন সম্প্রতি আইন পাশ করেছে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে অন্য কোন দেশের জাহাজ বা নৌযান অনুপ্রবেশকারি হিসেবে বিবেচনা করে চীনা কোষ্টগার্ড সেই নৌযানকে লক্ষ্য করে গুলি করতে পারবে। ইন্দোনেশিয়া ধারণা করছে, দক্ষিণ চীন সাগরে নাতুনা দ্বীপের উত্তর পাশে তাদের যে ইকোনোমিক এক্সক্লুশন জোন আছে সেটার উপর নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতেই চীন এ ধরণের আইন পাশ করেছে।

ইন্দোনেশিয়ার রাফাল যুদ্ধবিমান কেনার আগ্রহের কারণ হচ্ছে দ্রুত গতির এই বিমানের চমৎকার যুদ্ধ সক্ষমতা। বিমানটি আকাশ তেকে আকাশে এবং আকাশ থেকে মাটিতে ক্ষেপনাস্ত্র হমলা চালাতে সক্ষম। প্রতি ঘন্টায় বিমানটি ২২০০ কিলোমিটার চলতে পারে। এবং যুদ্ধকালে এর রেঞ্জ হচ্ছে ১৮৫০ কিলোমিটার। আকাশে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় রাফালের জুড়ি নেই। এটি শত্রুপক্ষের নৌবাহিনীর জাহাজেও দ্রুত গতিতে হামলা চালাতে সক্ষম।

ইন্দোনেশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রথমে এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান কেনার আলোচনা চুড়ান্ত করলেও পরে তা থেকে পিছিয়ে আসে। কারণ তাদেরকে এই বিমানের সরবরাহ পাওয়ার জন্য অন্তত এক যুগ অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর এই বিমান কেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করেছে। তাদেরকে সরবরাহ করার পরই কেবল ইন্দোনেশিয়ার পালা আসবে। এ বিষয়টি বিবেচনা করেই পরে জাকার্তা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এফ-১৫ যুদ্ধ বিমান কেনার চুক্তি চুড়ান্ত করে।

এফ-৩৫ যুদ্ধ বিমান অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অর্ধেক ব্যয়েই এফ-১৫ যুদ্ধ বিমানের রক্ষনাবেক্ষন করা সম্ভব। এ কারণেও ইন্দোনেশিয়া এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনা থেকে পিছিয়ে আসে এবং এফ-১৫ বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়। এই বিমানের প্রতিটির জন্য ইন্দোনেশিয়াকে অন্তত ১৩০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হতে পারে। দেশটির কর্মকর্তারা দাবি করছেন যে, ২০২২ সালের মধ্যে ৬টি এফ-১৫ তাদের হাতে এসে পৌছতে পারে।

এছাড়া ইতালির ভ্রাম্যমান লিওনার্ডো রাডার সিস্টেম কেনা হলে ইন্দোনেশিয়ার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরো জোরদার করবে। দক্ষিণ চীন সাগরে এই রাডার মোতায়েন করা হলে তা নতুনা বেসার ও সেবাতিক দ্বীপ থেকে সমুদ্র ও আকাশ সীমায় অন্তত ৫০০ কিলোমিটার দূরত্বেও নজর রাখতে পারেবে।

এছাড়া গত তিন বছর ধরে দেশটি নজরদারির জন্য চীন, ইসরাইল ও ফ্রান্সের তৈরি ড্রোন ব্যবহার করছে । ইন্দেনেশিয়ার এজেন্সি ফর এসেসমেন্ট এন্ড অ্যাপলিকেশন অব টেকনোলজি তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে একটি ড্রোন নির্মাণ করছে। এটির নাম দেয়া হয়েছে ব্ল্যাক ঈগল।

ইন্দোনেশিয়া একদিকে তার সামরিক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে অন্যদিকে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের যে কোন উস্কানীমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান শক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের তৎপরতার উপর নজর রাখতে কালিমান্তানে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ড্রোন ঘাটি নির্মাণের প্রক্রিয়াও এগিয়ে চলেছে। যেটা চীনের বিরুদ্ধে ইন্দোনেশিয়াকে জোরালো সমর্থন জোগাবে।