ভারতের নৌবাহিনীর জন্য জাহাজ বানাবে তুরস্ক


  • মেহেদী হাসান
  • ০১ মার্চ ২০২১, ০৮:৩৪

অ্যান্টি ব্যালেস্টিক মিসাইল সিস্টেম উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে তুরস্ক। অপরদিকে তুরস্কের সহযোগিতায় ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য নির্মিত হতে যাচ্ছে পাঁচটি বড় আকারের সাপোর্ট জাহাজ। তুরস্কের বহুল আলোচিত গেম চেঞ্জার ড্রোন বেয়ারকাত ড্রোন ৩ লাখ মাইল অপারেশন ফ্লাইট পরিচালনার রেকর্ড স্থাপন করেছে।

ভারতীয় নৌ বাহিনীকে ৫টি বড় আকারের জাহাজ নির্মান করে দেবে তুরস্ক। এসব জাহাজ ভারতেই নির্মিত হবে এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় প্রযুক্তি ভারতের কাছে হস্তান্তর করবে তুরস্ক ।

তুরস্কের সার্বিক সহায়তায় ভারতের হিন্দুস্তান শিপইয়ার্ড লিমিটেড নির্মাণ করবে এ জাহাজ। ভারতীয় নৌ বাহিনীর জন্য ব্যবহার করা হবে এসব জাহাজ। এর নাম ফ্লিট সার্পোট ভেসেল বা এফএসভি। প্রতিটি এফএসভির দৈর্ঘ্য ২৩০ ফিট। ডিসপ্লেসমেন্ট ক্ষমতা ৪৫ হাজার টন। এসব সাপোর্ট জাহাজ থেকে যুদ্ধ জাহাজে তেল এবং অন্যান্য রসদ যোগান দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হয়।

ভারতীয় গণমাধ্যমে ৫টি জাহাজ নির্মানের জন্য ১ দশমিক ৫ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার খরচের কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তুরস্ক গত বছর ভারতীয় এ জাহাজ নির্মানের কাজ পেয়েছে ।

তুরস্কের ৫টি শীর্ষ জাহাজ নির্মান শিল্প মিলে গঠিত টি এ আই এস কনসোর্টিয়াম। এ কনসোর্টিয়াম পেয়েছে ভারতীয় জাহাজ নির্মানের এ কাজ। ২০১৯ সালের জুন মাসে টি এ আই এস জানায় ভারতীয় নৌ বাহিনীর জন্য ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে ৫টি ফ্লিট সাপোর্ট ভেসেল নির্মানের কাজ পেয়েছে তারা।

হিন্দুস্তান শিপইয়ার্ড লিমিটেড বিসাখাপত্তনভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান । এ বছরের শেষ নাগাদ ভারতীয় নেভির ৫টি সাপোর্ট ভেসেল নির্মানের অর্ডার পাওয়ার কথা রয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি বছর অক্টোবর মাসে শুরু হতে পারে জাহাজ নির্মান কাজ। ২০২৪ সাল নাগাদ ভারতীয় নৌ বাহিনীর কাছে প্রথম জাহাজ হস্তারের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপর প্রতি বছর একটি করে বাকী চারটি জাহাজ নির্মান কাজ শেষ হবে।

হিব্দুস্তান শিপইয়ার্ড লিমিটেডকে এসব জাহাজ নির্মান প্রযুক্তি হস্তান্তর করবে আনাদলু শিপইয়ার্ড। আনাদলু শিপইর্য়াড টি এ আইএস কনসোর্টিয়ামের একটি প্রতিষ্ঠান। তুরস্কের এ জাহাজ নির্মানের কাজ পাওয়া বিষয়ে ভারতীয় কর্মকর্তরা জানিয়েছেন, প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া অন্য সব প্রতিষ্ঠান শর্ত দেয় ভারতের বাইরে কমপক্ষে একটি জাহাজ নির্মানের। কিন্তু তুরস্ক সব কটি জাহাজই ভারতে নির্মানের প্রস্তাব দিয়েছে এবং তারা মেড ইন ইন্ডিয়া উদ্যোগকেও সহায়তা করতে রাজি। তা ছাড়া জাহাজ নির্মানের সম্পূর্ণ প্রযুক্তি হস্তান্তর করায় ভারতীয় জাহাজ নির্মান শিল্পও ভবিষ্যতে দক্ষতা লাভ করতে পারবে। আর দরদাতাদের মধ্যে তুরস্ক ছিল সর্বনিম্ন।

তুরস্কের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন প্রযুক্তি হস্তান্তরে তাদের কোনো সমস্যা নেই। কারন আগামী কয়েক বছরের জন্য তাদের সব শীর্ষ জাহাজ নির্মান প্রতিষ্ঠানের জন্য বুকিং রয়েছে। তাদের কাজের অভাব নেই। সুতরাং সব জাহাজ ভারতে নির্মান করতে তাদের কোনো অসুবিধা নেই। তুরস্কের ইঞ্জিনিয়াররা নিয়মিতভাবে ভারতে যাবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। জাহাজের নকশা প্রনয়ন, পরিকল্পনা, ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস থেকে শুরু করে যাবতীয় বিষয়ে সহায়তা দেবে তুরস্ক।

তবে তুরস্ক পাকিস্তান ঘণিষ্ঠ সম্পর্ক এবং কাশ্মীর ইস্যুতে তুরস্ক প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়্যেপ এরদোয়ানের মন্তব্যের পর জাহাজ নির্মান চুক্তি মাঝখানে বেশ হুমকিতে পড়ে। তবে আপাতত সে আশঙ্কা কেটে গেছে বলে জানিয়েছেন উভয় দেশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ এট গেটওয়ে হাউজের গবেষক সমির পাতিল ভারতের হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, নৌ ক্ষেত্রে ভারত তাদের নিজস্ব দক্ষতা অর্জন করতে চায়। এ ক্ষেত্রে তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প বর্তমানে অনেক এডভান্সড। তারা যদি আমাদের প্রযুক্তি হস্তান্তর করতে চায় আমরা তা গ্রহণ করব না কেন? সমির পাতিল বলেন, এর আগে তুরস্কের সাভ্রোনিক কোম্পানী হিমাচল প্রদেশে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ অতল টানেল নির্মানে সাব-কনট্রাক্টস পেয়েছিল।

তুরস্কের ডেইলি সাবাহ জানিয়েছে টি এ আই এস তুরস্ক নৌ বাহিনীর জন্য ৮টি ল্যান্ডিং শিপ নির্মান করেছে। প্রতিটি ল্যান্ডিং শিপ ২০টি করে ট্যাঙ্ক বহন করতে পারে। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠান নির্মান করছে ল্যান্ডিং হেলিকপ্টার ডক টাইপ এমফিভিয়াস এসল্ট শিপ। এছাড়া গত বছর অক্টোবর এবং ডিসেম্বর মাসে শুরু করেছে কাতারের জন্য দুটি ক্যাডেট ট্রেনিং শিপ নির্মানের কাজ।

অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম উদ্ভাবনের চেষ্টা করছে তুরস্ক। এ লক্ষ্যে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। তুরস্কের শীর্ষ স্থানীয় সমরাস্ত্র নির্মান প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় রেকটসান এ জন্য কাজ করে যাচ্ছে। রকেটসান চেয়ারম্যান ফারুক ইজিত ডেইলি সাবাহকে বলেছেন, এর মাধ্যমে তুরস্কের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যেমন শক্তিশালী হবে তেমিন কমবে পরনির্ভরশীলতা। হিসার এবং সাইপার মিসাইল সিস্টেম এর কথা উল্লেখ করে তিনি, নকশা এবং প্রযুুক্তি ক্ষেত্রে উন্নতির জন্য আমারা আমাদের গবেষণা চালিয়ে যাব। আর এটা আমাদের ব্যালিস্টিক মিসাইল আক্রমনের হুমকি থেকে রক্ষা করবে।

ব্যালেস্টিক মিসাইল হলো এমন মিসাইল সিস্টেম যাতে থাকে শক্তিশালী বোমা বহন ব্যবস্থা, কন্ট্রোল ইউনিট, ফুয়েল ট্যাংক, পাখা, ইঞ্জিন এবং গাইডেন্স ইলেকট্রনিক্স। স্বল্প পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে এবং আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক মিসাইল উপ-কক্ষপথের ট্রাজেক্টরি অনুসরন করে।

ব্যালিস্টিক মিসাইল পৃথিবীর বায়ুমন্ডল অতিক্রম করে মহাশূন্যে প্রবেশ করে আবার বায়ু মন্ডলে ফিরে আসে এবং দ্রুত গতিতে লক্ষ্য বস্তুর দিকে ছুটে চলতে পারে। দ্রুত মহাশূন্যে প্রবেশের ফলে ব্যালিস্টিক মিসাইল সনাক্ত করে ধ্বংস করা অনেক কঠিন। একে ধ্বংস করতে উন্নত এবং শক্তিশালী অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম প্রয়োজন। ব্যালিস্টিক মিসাইল ধ্বংস করতে হলে নিক্ষেপের পর থেকেই এর গতি বিধি অনুসরণ করতে হয়।

কিছু কিছু সিস্টেম টেকটিক্যাল ব্যালিস্টিক মিসাইল এবং অন্যান্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ধ্বংস করতে পারে কিন্তু দীর্ঘ পাল্লার মিসাইল আক্রমন প্রতিহত করার জন্য ব্যয়বহুল স্পেশাল সেন্সর নেটওয়ার্ক এবং ইন্টারসেপ্টর সিস্টেম অপরিহার্য।

অ্যান্টি ব্যালিস্টিক সিস্টেম উদ্ভাবন উন্নত প্রযুক্তি এবং সময় সাপেক্ষ বিষয়। তুরস্কের আশঙ্কা যুদ্ধ বিধ্বস্ত প্রতিবেশি সিরিয়ায় বিভিন্ন গ্রুপের কাছে স্বল্প পাল্লার ব্যালিস্টিক মিসাইল চলে আসতে পারে। আর সেটি তুরস্কের জন্য বড় ধরনের হুমকি। সে কারনে তুরস্কের জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম উদ্ভাবন করা।

রকেটসান ছাড়াও তুরস্কের আরো কিছু প্রতিষ্ঠান এক সাথে কাজ করছে অ্যান্টি ব্যালিস্টিক মিসাইল সিস্টেম উদ্ভাবনে। যেমন আসেলসান অংশগ্রহণ করবে সেন্সর উদ্ভাবনে।

তুরস্কের মানুষবিহীন সশস্ত্র কমব্যাট ড্রোন বায়রাকতার টিবি২ ড্রোন ৩ লাখ ঘন্টা অপারেশন ফ্লাইট পরিচালনার রেকর্ড স্থাপন করেছে। তুরস্কের এভিয়েশন ইতিহাসে দেশীয় কোনো ড্রোন হিসেবে এটিই এখন পর্যন্ত তাদের সর্বোচ্চ উডডয়নের রেকর্ড।

বায়রাকতারের প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা সেলজুক বায়রাকতার জানিয়েছেন, ইরাকের ক্রস বর্ডার কাউন্টার টেরোরিজম, সিরিয়া যুদ্ধ , পিকেকে ও আইসিস দমন , পূর্ব ভূমধ্যসাগর, অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা এবং ত্রান কার্যক্রমসহ বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করেছে বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন।

২০১৪ সালে তুর্কি আর্মিতে যুক্ত হয় বায়রাকটার টিবি২ ড্রোন। বর্তমানে জাতীয় গোয়েন্দাসংস্থাসহ তুর্কি আর্মির বিভিন্ন শাখায় ব্যবহার করা হচ্ছে এ ড্রোন।

তুরস্ক ছাড়া ইউক্রেন, আজারবাইজান এবং কাতারের কাছে রয়েছে বর্তমানে শক্তিশালী এ ড্রোন। ২০২০ সালে বায়রাকটার ৩৬০ মিলিয়ন ডলারের ড্রোন রপ্তানি করেছে।

নাগরনো-কারাবাখ নিয়ে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধে আজারাবাইজান ব্যাপক মাত্রায় ব্যবহার করেছে তুরস্কের তৈরি বায়রাকতার টিবি-২ ড্রোন। আর্মেনিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, রাডার সিস্টেম, ট্যাঙ্ক, সাজোয়া যান, ট্রাক, অস্ত্র গুদাম এবং বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা আজারবাইজান গুড়িয়ে দিয়েছে বায়রাকটার টিবি২ ড্রোনের মাধ্যমে। এ ড্রোনের মাধ্যমে আজারবাইজানের ব্যাপক সফলতার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ ড্রোন ক্রয়ের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

২০১৯ সালে কুয়েতে এক মহড়ায় টানা ২৭ ঘণ্টা আকাশে অবস্থানের রেকর্ড স্থাপন করেছে বায়রাকটার ড্রোন। ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপামাত্রা আর বালুঝড়ের মধ্যে পরিচালিতা এ মহড়ার সময় ১৭ হাজার ফিট উচ্চতায় ওড়ে ড্রোনটি। ২৭ ঘণ্টায় কুয়েতের চার দিকে চারবার ঘুরে ৪ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এসময়।

আর্ন্তজাতিক সমরাস্ত্র বিশেষজ্ঞরা তুরস্কের বায়রাকতার ড্রোনকে গেম চেঞ্জার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। বায়রাকটার ড্রোন এর পাখায় তুরস্কের তৈরি চারটি স্মার্ট মিসাইর বহন করতে পারে। বিশ্বে ৬টি দেশ রয়েছে যারা তাদের নিজস্ব তৈরি ড্রোনে নিজস্ব তৈরি অস্ত্র বহন করতে পারে। তুরস্ক তার মধ্যে একটি।