রাশিয়ার হাতে মনুষ্যবিহীন যুদ্ধ ট্যাঙ্ক


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ১৫:১৯

বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের ঝনঝনানি আর নিত্য নতুন প্রযুক্তির সর্বাধুনিক অস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা বেড়েই চলেছে। চলমান মহামারির মাঝেও সমরাস্ত্র আর প্রতিরক্ষা খাতে পরাশক্তিগুলোর ব্যয় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে। সমরাস্ত্র প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় নতুন এক অবস্থানে পৌঁছানোর জন্য রাশিয়াও জোর কদমে এগিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া ‘উদার’ নামক একটি মনুষ্যবিহীন ট্যাঙ্ক আবিষ্কার করতে যাচ্ছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে কারও সহযোগিতা ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলাচল করতে পারবে এবং আকাশে ভাসমান ড্রোনের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করতে সক্ষম হবে।

২০১৫ সালে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্ভাবন দিবসে মনুষ্যবিহীন ট্যাঙ্ক তৈরির কথা প্রথম প্রকাশ্যে আসে। উদার নামের মনুষ্যবিহীন গ্রাউন্ড ভেহিকেল বা ইউজিভি ট্যাঙ্কটি বিএমপি-থ্রি-এর ট্র্যাকড চেসিসের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হচ্ছে। এ সমরযানের কেন্দ্রে ঘূর্ণায়মান কামানের মঞ্চ থাকবে যা দূর থেকে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে পরিচালনা করা যাবে। পাশাপাশি থাকবে ডিইউবিএম-থার্টি সংস্করণের ঘূর্ণিযন্ত্র, এর সাথে থাকছে টুএফোরটু ধরনের সশস্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় কামান। ৭ দশমিক ৬২ মিলিমিটারের পিকেএমটি মেশিনগান এবং এম-এটিজিএম সংস্করণের একটি কর্নেট।

অল রাশিয়ান সায়েন্টিফিক রিসার্চ ইন্সটিটিউট এই ট্যাঙ্কটির অপারেশনাল প্রোটোটাইপ প্রস্তুত করেছে। পাশাপাশি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন রোসটেক গ্রুপও এ সমরযান নির্মাণ প্রক্রিয়ায় অবদান রাখছে। রোসটেকের আর্মামেন্ট ক্লাস্টারের শিল্প বিষয়ক পরিচালক বেখান ওজদোয়েভ রাশিয়ান বার্তা সংস্থা তাসকে জানান, “উদার নির্মানের সময় এর উদ্যেক্তরা ট্যাঙ্কটি স্বয়ংক্রিয় মুডে থাকা অবস্থায় এর ভেতরে রোবটের চলাফেরা করার বিষয়েও পরীক্ষা চালিয়েছে।

এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ট্যাঙ্কটিতে সেন্সর ও পরিমাপক যন্ত্রের আলোকে একটি মোশন প্ল্যানিং সিস্টেমও সংযুক্ত করা হয়েছে। সেন্সরের মাধ্যমে যেসব তথ্য আসবে সেগুলোকে বিশ্লেষণ করে পাশাপাশি যে ভূমির ওপর দিয়ে ট্যাঙ্কটি চলছে তার বৈশিষ্ট্য মুল্যায়ন করতে পারবে। সম্ভাব্য সংঘাত ও যুদ্ধের প্যারামিটারগুলোর আলোকে রোবটটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার চলাচলের পথকে নির্ধারন করে নিতে পারবে।

সিগনাল রিসার্চ ইন্সটিটিউট একটি সমন্বিত রোবটিক নীতিমালা এবং বিদ্যমান সমরাস্ত্র নির্মান হার্ডওয়ারের সাথে সমন্বয় করে বেশ কিছু যন্ত্রপাতি তৈরি করেছে। মূলত রোবট চালিত যুদ্ধযান নির্মানের উদ্দেশ্যেই রাশিয়া মনুষ্যবিহীন প্রযুক্তির ওপর জোর দিচ্ছে। উদার ট্যাঙ্কের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি ভাসমান ড্রোনের সাথেও সমন্বয় করতে পারবে।

রাশিয়া দাবি করছে, তারা উদারের সাথে ড্রোনের সমন্বিত কার্যক্রমের বিষয়ে একটি পরীক্ষণ চালিয়েছে। এ পরীক্ষা বেশ ভালো সাড়াও পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, রোবট থেকেই টিথারের মাধ্যমে ড্রোনে ইলেকট্রিক পাওয়ার সরবরাহ করাও সম্ভব হয়েছে। রোবটের সহায়তায় পরিচালিত এ ড্রোনগুলো দিয়ে পরিদর্শন, নজরদারি এবং রেডিও চ্যানেলগুলো রিলে করা সম্ভব হবে।

রোবটিক এ সমরযানগুলোকে হালকা ওজনের রোবটের সাথেও সমন্বয় করেও চালানো যাবে। হালকা ওজনের রোবটগুলো শত্রুপক্ষের নানা টার্গেট ধ্বংস, কার্গো পরিবহন এবং আহতদেরকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উদ্ধার করার কাজে ব্যবহৃত হয়। হালকা ওজনের এ রোবটগুলো উদার ট্যাঙ্কের স্টিয়ারিংয়ে বসিয়ে দিলে তারা ক্যারিয়ার থেকে রোবটগুলোকে আনডক করতে পারবে।

আনডক হওয়ার পর উদার ট্যাঙ্কটি নিজের মূল মিশনে চলে যেতে পারবে। অর্থাৎ উদার ট্যাঙ্কগুলোর আনডক হওয়া থেকে শুরু করে মূল যুদ্ধমিশনে যাওয়া অবধি মানুষের কোনো সক্রিয় অংশগ্রহনের প্রয়োজন পড়বে।

এদিকে, রাশিয়ান নৌবাহিনী জানিয়েছে তারা নতুন নির্মিত ডুমসডে উইপনগুলো নিক্ষেপ করার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। ডুমসডে উইপন হলো পানির নীচে থাকা একটি ড্রোন যা পারমানবিক বোমা বহন করতে পারবে। বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, হিরোশিমায় যে পারমানবিক বোমা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার তুলনায় ১৩৩ গুন বেশি শক্তিশালী বোমা এই ড্রোনগুলো বহন করতে পারবে।

রাশিয়ার পত্রিকা ইজভেসতিয়া জানিয়েছে, প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন এর আগে রাশিয়ান ফেডারেশনের জন্য ৬টি নতুন প্রজন্মের অস্ত্র নির্মানের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন তার আওতায় এ ড্রোনটি নির্মিত হয়েছে। রাশিয়ার নৌ বাহিনী খুব শীঘ্রই পানির নীচে ভাসমান এ ড্রোনটিকে নিক্ষেপ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এ ড্রোনটির নাম দেয়া হয়েছে পোজেইডন। রাশিয়ান নৌ বাহিনী এর পরীক্ষা চালানোর সময় প্রোজেক্ট জিরো নাইন এইট ফাইভ টু ধরনের পারমানবিক শক্তি সম্পন্ন সাবমেরিন বেলগোরোদ থেকে এ ড্রোনটি নিক্ষেপ করতে যাচ্ছে। এ সাবমেরিনটিই প্রথমবারের মতো পোজেইডনকে বহন করতে যাচ্ছে।

মস্কো টাইমস জানিয়েছে, ২০২২ সালের মধ্যে নতুন অস্ত্রগুলো সংরক্ষন ও অপারেশন পরিচালনা করার মতো অবকাঠামো নির্মিত হয়ে যাবে। এর আগে ধারণা করা হয়েছিল যে, ২০২০ সালের মধ্যেই ড্রোন সাবমেরিনটি অবমুক্ত গতে পারবে। কিন্তু পরবর্তী করোনা মহামারিসহ বেশ কিছু কারণে এই প্রকল্পের সময় এক বছর বৃদ্ধি করা হয়। পানির নীচে স্বয়ংক্রিয় সমরযান তথা অটোনোমাস আন্ডার ওয়াটার ভেইকল বা ইউইউভির সমুদ্রে গতিসীমা সর্বোচ্চ কতদূর পর্যন্ত হতে পারে এরই মধ্যে অবশ্য এর পরীক্ষা শেষ হয়েছে। একটি ডিজেল চালিত সাবমেরিনের মাধ্যমে এ পরীক্ষা চালানো হয়।

রাশিয়ার রুবিন ডিজাইন ব্যুরো এই ইউইউভি প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। পোজেইডন নৌযানটি উন্নতমানের পারমানবিক টর্পেডো দিয়ে পরিচালিত হবে। যা ২ থেকে ১০০ মেট্রিক টন ওজনের ক্লাসিফাইড বোমার বিস্ফোরন ঘটাতে পারবে। পাশাপাশি, এ ড্রোন সাবমেরিনগুলো প্রথাগত পে-লোডও সরবরাহ করতে পারবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি এমন সমরযান হতে যাচ্ছে যা সম্বন্ধে কারো কাছেই পরিস্কার কোনো তথ্য নেই। কয়েকদিন পর পর আমরা পোজেইডন সম্পর্কে যেসব তথ্য ও ছবি পাওয়া যাচ্ছে তা আগের ধারণাকে ছাপিয়ে যাচ্ছে। এতে এমন সব অস্ত্র থাকবে যা দিয়ে উপকূলীয় শহরগুলোকে হিরোশিমার ওপর নিক্ষিপ্ত বোমার চেয়েও অনেক শক্তিশালী বোমা দিয়ে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হবে।

রাশিয়ার সহায়ক নৌ যান প্রোজেক্ট টুজিরোওয়ান এইট জিরো দিয়ে এই পোজেইডনের পরীক্ষা চালানো হবে। তেমনটা হলে, নতুন এ সাবমেরিন দিয়ে ড্রোনের সিবেড সংস্করণগুলো প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তার আলোকে বলা যায়, পোজেইডন টর্পেডো আকৃতির একটি ছোট রোবটিক সাবমেরিন হতে যাচ্ছে। যা ঘন্টায় ১৮৫ কিলোমিটার বেগে পানির ১০০০ মিটার বা তিন হাজার ৩শ ফিট নীচে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটতে পারে। সাধারণভাবে পানির নীচে যেসব ড্রোন চলাচল করে তা সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ১০০ মিটার নীচ দিয়ে চলাচল করে। এর নীচে নামলে নৌ ড্রোনগুলোর স্টেলথ বৈশিষ্ট্য সেভাবে আর কাজ করে না।

স্টেলথ বৈশিষ্ট্যর কারনে রেডিয়াস কম নির্গত হয় ফলে প্রতিপক্ষ সনাক্ত করতে পারে না। রাশিয়ার নতুন এ ড্রোন সাবমেরিনে স্টেলথ বৈশিষ্ট্য তো থাকছেই, সংগে সাইলেন্ট মুডে চলাচল করারও অপশন থাকছে। তাই সার্বিকভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী রাশিয়া যদি ড্রোন সাবমেরিনটি নির্মাণ করতে পারে তাহলে তারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিতে পারবে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।