তুরস্কের সঙ্গে বড় সামরিক মহড়ায় নামছে আজারবাইজান


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ২৬ জানুয়ারি ২০২১, ০৬:৩৬

আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের পর মাত্র দুই মাসের মাথায় আজারবাইজান তুরস্কের পূর্বাঞ্চলীয় কার্স প্রদেশে তুরস্কের সাথে যৌথভাবে একটি বড় আকারের সামরিক মহড়া শুরু করতে যাচ্ছে। তুরস্ক ও আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছে। এ মহড়াটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও সামগ্রিক কৌশল নিয়েই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তুরস্কের সেনাবাহিনী এই মহড়ায় তুরস্কে নির্মিত অস্ত্র ও সরঞ্জামগুলো প্রদর্শন করবে। ২০২১ সালের শীতকালীন এ মহড়ায় তুরস্কের ট্যাঙ্ক, কামান, স্নাইপার টিম, স্পেশাল ফোর্স কমান্ডো, হেলিকপ্টারও অংশ নিতে যাচ্ছে।

১২ দিনব্যাপী এ মহড়া শুরু হবে ফেব্রুয়ারির শুরুতে। প্রচণ্ড শীতের মাঝেও কীভাবে একটি সেনাবাহিনী তার কার্যকারিতা অব্যাহত রাখতে পারে, সে বিষয়টি প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে। এ মহড়াটি কার্স নামের যে অঞ্চলে অনুষ্ঠিত হবে তা আর্মেনিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র ২৫ মাইল দূরে। তুরস্ক ও আজারবাইজানের সেনারা এই মহড়ায় আশ্রয় নির্মাণ, ব্যবস্থাপনা, সেনা সদস্যদের পুনরায় মোতায়েন ও শক্তি বৃদ্ধি, পদাতিক বাহিনী ও বিমান বাহিনীর আক্রমণ এবং অন্যান্য লজিস্টিক সাপোর্টের বিষয়ে অনুশীলন করবে। এই মহড়ায় অংশ নিতে তুরস্কের সেনারা এরই মধ্যে কার্সে পৌঁছেছে। অন্যদিকে যে আজারি সেনার এই মহড়ায় অংশ নেবে তারাও নাখচিভান শহর ছেড়ে এরই মধ্যে সাদারেক সীমান্তের দিকে অগ্রসর হয়েছে। সেখান থেকে তারা উমিদ ব্রিজের ওপর দিয়ে আরাজ নদী পার হয়ে কার্স প্রদেশে পৌঁছে যাবে।

আজারবাইজানের মহড়ায় অংশ নেয়া সেনাদের উদ্দেশ্য দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তা মেজর জেনারেল ফাজিল আগালারভ আজারবাইজান ও তুরস্কের মধ্যকার সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতার ওপর গুরুত্ব দেন। কয়েক বছর ধরে কার্স এবং নাখচিভানে দু দেশের মধ্যে যে সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে তা অব্যহত রাখার আশ্বাস দেন।

আগালারভ মূলত আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভের ভাষণই পুনর্ব্যক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ বলেছিলেন, তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যকার বড় আকারের সামরিক মহড়া মূলত তুরস্ক ও আজারিদের মধ্যকার সংহতি ও ভাতৃত্বের অনুপম নিদর্শন।

গত বছরের জুলাই মাসে তুরস্ক ও আজারবাইজানের সেনারা মিলে এরকম আরেকটি মহড়ায় অংশ নিয়েছিল। মূলত আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার আগ দিয়ে সেই মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। এই মহড়ায় আর্টিলারি, সশস্ত্র সমরযান, এবং মর্টারের অনুশীলন চালানো হয়। তুরস্ক সীমান্তের পাশ দিয়ে আজারবাইজানের স্বায়ত্বশাসিত এলাকায় এ মহড়াটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই মহড়ায় যুদ্ধবিমান, জেট বিমান এবং হেলিকপ্টারও অংশ নেয়। ১০ আগষ্ট অবধি এ সকল বিমানযানকে বাকু, নাখচিভান, গানজা, কুরদামির এবং ইয়েভলাখের ওপর দিয়ে নিয়মিতভাবে উড়তেও দেখা গেছে।

আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে ২৭ সেপ্টেম্বর রক্তক্ষয়ী সংঘাত শুরু হয়। দেড়মাস স্থায়ী যুদ্ধে প্রায় ৭ হাজার সেনা, সামরিক কাঠামো ও সমরাস্ত্র এবং অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। আজারবাইজান এ যুদ্ধে চুড়ান্ত জয়ী হয়। তারা ৯০ এর দশকে আর্মেনিয়ার হাতে দখল হয়ে যাওয়া নাগরনো-কারাবাখ অঞ্চলটি পুনরায় উদ্ধার করে। এ অঞ্চলে থাকা বেশ অনেকগুলো করিডোরও বাকুর কাছে আত্মসমর্পন করে। এ যুদ্ধে সফল্যর ফল হিসাবে আজারবাইজান নাখচিভান ছিটমহলের মধ্য দিয়ে আর্মেনিয়াতে যাতায়াতের অবাধ সুযোগও পেয়ে যায়।

তুরস্ক এ যুদ্ধে প্রকাশ্যে আজারবাইজানকে সহায়তা করে। তুরস্কের সহযোগিতায় বিশেষ করে তুরস্কের ড্রোন ব্যবহারের কারণেই আজারবাইজান এ যুদ্ধে সফলতা পায়। ৪৪দিন স্থায়ী এ যুদ্ধে আজারবাইজান বেশ কয়েকটি শহর এবং ৩ শতাধিক গ্রামকে আর্মেনিয়ার দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। অবশেষে নভেম্বর মাসের ১০ তারিখে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় দু দেশ একটি ত্রিদেশীয় চুক্তি হয় এবং এ যুদ্ধের আপাত সমাপ্তি রচনা হয়।

রাশিয়া ও তুরস্কের সেনাদের সমন্বয়ে এরই মধ্যে দুদেশের কর্তৃপক্ষ একটি শান্তিরক্ষী বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছে যারা সর্বশেষ সাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করছে। স্পষ্টভাবে কোনো জয় বা পরাজয় নির্ধারিত না হলেও আজারবাইজানকে এ যুদ্ধে বিজয়ী মনে করা হয় কারণ যুদ্ধের ফলশ্রুতিতেই আর্মেনিয়াকে দখলকৃত সব এলাকাই ছেড়ে দিতে হয়েছে।

সম্প্রতি আজারবাইজানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এক প্রতিবেদনে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ নভেম্বর পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নাগরনো-কারাবাখের যুদ্ধে নিহত সকল সেনার ছবি, নাম, পদবি, তাদের সামরিক অবস্থান এবং জন্ম তারিখ প্রকাশ করেছে।

রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যুদ্ধ আপাতত শেষ হলেও বেশ কিছু প্রশ্নের সুরাহা এখনো হয়নি। যারা কারাগারে বন্দী আছেন এমন ব্যক্তিদের মুক্তি পাওয়ার প্রক্রিয়া খুব একটা অগ্রসর হয়নি। ৯ নভেম্বর যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরও ৬২জন ব্যক্তির আটক হওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশিও হতে পারে। এ ধোঁয়াশা সৃষ্টির মূল কারণ হলো আর্মেনিয়ান কর্তৃপক্ষ এখনো তাদের হাতে বন্দী ব্যক্তিদের সংখ্যা ও বিস্তারিত তথ্য এখনো জানায়নি।

বর্তমানে কারাবাখ অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্টায় রাশিয়া ও তুরস্কের শান্তিরক্ষীরা তদারকি করলেও স্থানীয় পর্যায়েও বেশ কিছু সমস্যাও রয়ে গেছে। আর্তসাখের মার্টাকেট অঞ্চলের ড্রামবোন গ্রামের বাসিন্দারা শান্তিরক্ষী বাহিনীর কাছে আবেদন জানিয়েছে যাতে তাদেরকে মার্টাকেট এবং ভারডেনিস সড়ক দিয়ে যাতায়াতের সুযোগ দেয়া হয়। এই সড়কটি আর্তসাখকে আর্মেনিয়ার সাথে সংযুক্ত করেছে। কিন্তু শান্তিরক্ষী কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারেনি। ফলে যুদ্ধ শেষ হলেও স্থানীয় জনগনের যাতায়াতে কিছু সমস্যা রয়েই গেছে।

কারাবাখ যুদ্ধ জয়ের পর আজারবাইজান ক্রমশ আঞ্চলিক একটি শক্তিধর রাষ্ট্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যেই আজারবাইজান প্রতিবেশি দেশ তুর্কমেনিস্তানের সাথে কাস্পিয়ান সাগরে গ্যাসের যৌথ অনুসন্ধান করার জন্য একটি সমঝোতা স্মারক সাক্ষর করেছে। তুরস্ক আজারবাইজানের এ উদ্যেগকে স্বাগত জানিয়েছে।

আজারবাইজান জানিয়েছে তারা গত বছরের জানুয়ারী থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ২৬ হাজার টন তেল রফতানি করেছে। কারাবাখের যুদ্ধের কারণে বিগত সময়ের একই সময়ের তুলনায় এ বছর রফতানির পরিমান ৮ দশমিক ৭ শতাংশ কমে গেছে। এ বছর আজারি কর্তৃপক্ষ যে পরিমান তেল রফতানি করেছে তার মুল্য হবে ৭ দশমিক ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার যা পূববর্তী বছরের তুলনায় ২১ দশমিক ৩ শতাংশ কম।

তুর্কমেনিস্তানের পর ইরানও আজারবাইজানের সাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বানিজ্য মিশন শুরুর আগ্রহের কথা জানিয়েছে। ইরানের গিলান প্রদেশের শুধু বানিজ্যিক প্রতিনিধি দলই নয়, আজারবাইজানের এ অগ্রযাত্রায় অংশীদার হতে ইরান সরকারীভাবেও তোড়জোড় শুরু করেছে।

রাশিয়ার মধ্যস্থতায় রাশিয়া, আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে যে শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে তার আলোকে ইরান কীভাবে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থাগুলোতে অংশগ্রহণ করবে তার একটি কর্মপন্থাও এ সফরের মধ্য দিয়ে নিশ্চিত হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে।

নাগরনো-কারাবাখের যে অঞ্চলগুলো এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দখলমুক্ত হলো ইরান তার উন্নয়ন কাজে শরীক হতে চায়। পাশাপাশি, আজারবাইজানের উত্তর দক্ষিণ করিডোরের ওপর দিয়ে ইরান -আজারবাইজান-রাশিয়ার ত্রিপক্ষীয় বানিজ্য ও সামরিক কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়েও এই সফরে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

নাগরনো কারভাখের যুদ্ধে জয়ের পর আজারবাইজ মধ্যএশিয়া কেন্দ্রিক প্রভাব বলয়ে শক্তিশালী এক দেশ হিসাবে আর্বিভুত হয়েছে। ইরান এখন এর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করছে। আজারবাইজান সফরের পর জাভেদ জারিফ রাশিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া এবং তুরস্ক সফর করবেন বলে তেহরান জানিয়েছে। আজারবাইজানকে ঘিরে এ অঞ্চলে প্রভাবশালী দেশগুলোর নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে।