চ্যালেঞ্জের মুখে রুশ-মার্কিন প্রতিরক্ষা শিল্প


  • মোতালেব জামালী
  • ২২ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:৫৩

প্রতিরক্ষা শিল্পে উদীয়মান দেশগুলোর দিক থেকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে পশ্চিমা ও রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ও সমরাস্ত্র নির্মাতা কোম্পানিগুলো। এক সময় যেসব দেশের প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে পশ্চিমা ও রুশ কোম্পানিগুলো সহায়তা দিয়েছে, সেসব দেশ এখন বহু ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদন করছে। যদিও উদীয়মান এসব দেশ এখনও প্রতিরক্ষা খাতের নানা প্রযুক্তির জন্য রুশ ও মার্কিন কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভর করে থাকে।

গত এক দশকে তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল ও পোল্যান্ড সরকার তাদের প্রতিরক্ষা শিল্পখাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। এসব দেশ বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও সমরাস্ত্র তৈরিতে সক্ষমতা বহুগুণ বাড়িয়েছে। গড়ে তুলেছে অনেক কারখানা ও প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটি শুরুর দিকে কেবলমাত্র রুশ ও পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স নিয়ে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও সমরাস্ত্র সংযোজন করত। যেমন তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া শত শত এফ-১৬ যুদ্ধবিমান সংযোজন করেছে। এছাড়া জার্মানির সাবমেরিনও সংযোজন করেছে দেশ দুটি। এ কাজে অবশ্য ব্রাজিলও যুক্ত ছিল। পরে নিজেরাই প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করা শুরু করে।

এসব দেশ পশ্চিমা ও রুশ প্রযুক্তি এবং যন্ত্রাংশ ব্যবহারের লাইসেন্স নিয়েছে। তবে এসব কোম্পানিকে অবশ্য আরও বেশ কিছু দিন যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তির জন্য পশ্চিমা ও রুশ প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীল থাকতে হবে। এ থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, প্রতিরক্ষা শিল্পের উদীয়মান দেশগুলো এ খাতে উন্নতি করলেও এখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠতে পারেনি।

কিন্তু তারপরও এসব দেশ প্রতিরক্ষা শিল্পে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে এই শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। এখন তারা আগের চেয়ে অনেক বেশি ও উন্নত প্রযুক্তির সমরাস্ত্র তৈরি করতে সক্ষম।

উদীয়মান এসব দেশ এখন পশ্চিমা ও রুশ সমরাস্ত্রের ডিজাইন অনুযায়ী অবিকল প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করতে পারে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়া যন্ত্রাংশ সংযোজনের মাধ্যমে এফ-১৬ যুদ্ধ বিমান উৎপাদনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এখন নিজেরাই টি-৫০ গোল্ডেন ঈগল নামে একটি প্রশিক্ষণ ও হালকা যুদ্ধ বিমান তৈরি করেছে। এ কাজে তারা দুই দেশের প্রযুক্তি ও নিজেদের সংযোজন অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছে।

পোল্যান্ড প্রথমে লাইসেন্স গ্রহনের মাধ্যমে ফিনল্যান্ডের আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার তৈরি করেছে। এখন দেশটি নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্থানীয়ভাবে একই ডিজাইনের কয়েক ধরনের আর্মার্ড পার্সোনাল ক্যারিয়ার তৈরি করছে। তুরস্ক প্রথমে ইতালীর ডিজাইনে টি-১২৯ অ্যাটাক হেলিকপ্টার সংযোজন করতে শুরু করে। পরে সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের প্রযুক্তিতে নতুন একটি অ্যাটাক হেলিকপ্টার বানিয়েছে।

এসব কাজের মাধ্যমে এই দেশগুলো একদিকে প্রযুক্তি ও যন্ত্রাংশ সংগ্রহ করার পাশাপাশি নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্পের সংস্কার করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া তাদের প্রতিরক্ষা শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে ২০০৬ সালে একটি আলাদা প্রশাসন গড়ে তোলে যাদের কাজ ছিল প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম সংগ্রহ করা। পোল্যান্ডও ২০১৫ সালে একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করে। এজন্য তারা পিজিজেড হোল্ডিং কোম্পানি নামে একটি কোম্পানি করে তাদের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে এর অধীনে ন্যস্ত করে।

গত এক দশকে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানী বেড়েছে তিনগুন। বর্তমানে দেশটির কোম্পানিগুলো পশ্চিমা ও রুশ কোম্পানির সাথে প্রতিযোগিতা করে জিতে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম রপ্তানী করছে। তাদের টি-৫০ যুদ্ধ ও প্রশিক্ষণ বিমান কিনছে ইরাক, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ড। দেশটি পশ্চিমা ও রুশ প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর সাথে দরপত্রের প্রতিযোগিতায় জিতে এসব দেশে বিমানগুলো সরবরাহ করছে।

এছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার শিপইয়ার্ডগুলো যুক্তরাজ্য ও থাইল্যান্ডে ফ্রিগেট ও ট্যাঙ্কার সরবরাহের চুক্তি করছে।

জার্মান কোম্পানিকে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় সাবমেরিন সরবরাহ করার অর্ডার পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার শিপইয়ার্ড। অথচ ১৯৮০’র দশকে এই জার্মান কোম্পানির লাইসেন্স নিয়ে তাদের সাবমেরিন সংযোজন করেছে দক্ষিণ কোরিয়া। এখন তারা সেই কোম্পানিকেই আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় হারিয়ে ঠিকাদারি জিতছে।

সমরাস্ত্রের ক্ষেত্রে সারা বিশ্বে চমক দেখিয়েছে তুরস্ক। যদিও দেশটির বিষয় একটু আলাদা। তুরস্ক আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় জেতার পরিবর্তে রাজনৈতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের সমরাস্ত্র বিক্রি করছে। গত এক দশকে তাদের সমরাস্ত্র বিক্রির পরিমান তিনগুন বেড়েছে। ২০১৯ সালে তাদের বিক্রির পরিমান দাড়িয়েছে ২ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

ব্রাজিল ২০১৯ সালে ১দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের প্রতিরক্ষা ও সমরাস্ত্র বিক্রি করেছে। দেশটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ-২৯ সুপার টুকানো প্রশিক্ষণ ও হালকা যুদ্ধবিমান বিক্রি করেছে। বিভিন্ন দেশ তাদের এই বিমানটি কিনছে। সম্প্রতি দেশটি প্রথমবারের মতো তাদের তৈরি করা কেসি-৩৯০ পরিবহন বিমান বিক্রি করার চুক্তিও করেছে।

উদীয়মান এসব দেশ প্রতিরক্ষা খাতে তাদের উৎপাদন সক্ষমতা বহুগুন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষ করে তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া এব্যাপারে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে। কিন্তু তার পরও এসব দেশ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ইলেকট্রনিক সামগ্রি, ইঞ্জিন ও অন্যান্য সাব-সিস্টেমের জন্য পশ্চিমা ও রাশিয়ার কোম্পানিগুলোর সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল।

যেমন দক্ষিণ কোরিয়া তার কে-২ ব্ল্যাক প্যান্থার মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্কের জন্য নিজেদের ডিজাইন করা পাওয়ার প্যাক ব্যবহার করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। এ সমস্যা সমাধানে তারা জার্মান কোম্পানির স্মরণাপন্ন হয়। সেখান থেকে তারা অতিরিক্ত ইঞ্জিন ও ট্যান্সমিশন সংগ্রহ করে।

একই ভাবে পোল্যান্ড তার ক্র্যাব হাউইটজার উৎপাদন করতে গিয়ে এর ইঞ্জিন ও চ্যাসিস নিয়ে কারিগরি সমস্যায় পড়ে। পরে তারা জার্মানী ও দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানির কাছ থেকে এগুলোর বিকল্প সংগ্রহ করে উৎপাদন সম্পন্ন করে।

যন্ত্রাংশ ও প্রযুক্তির জন্য রুশ ও পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরতা অনেক সময় উৎপাদন কাজ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত করে তার বড় প্রমান হচ্ছে তুরস্ক। কারণ সেসব দেশও চায় না আন্তর্জাতিক বাজারে তাদের প্রতিযোগি তৈরি হোক। ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে তুরস্কের আলটাই মেইন ব্যাটল ট্যাঙ্ক এর উৎপাদন মসৃনভাবে এগিয়ে চলেছে। কারণ এই ট্যাঙ্কের জন্য জার্মানীর পাওয়ার প্যাক ছিল যুতসই একটি উপাদান। এর আগে ২০১৬ সাল থেকে তুরস্কের ওপর আরোপিত অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার কারণে এই ট্যাঙ্কের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।

স্থানীয়ভাবে একটি প্রোপালশন সিষ্টেম উন্নয়নের জন্য ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত একটি চুক্তি বাতিল করতে হয় তুরস্ককে। কারণ এটি করতে সহায়তার জন্য অষ্ট্রিয়ার যে কোম্পানিকে নির্বাচন করা হয়েছিল তারা কাজ ফেলে চলে যায়। ফলে প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। একই ধরনের ঘটনায় পাকিস্তানে অ্যাটাক হেলিকপ্টার বিক্রি ও আর্মড ইউএভি উৎপাদনের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। ইতালীয় ডিজাইনে যুক্তরাষ্ট্রের ইঞ্জিন ব্যবহার করে হেলিকপ্টারটি তৈরির কথা ছিল। অন্যদিকে আর্মড ইউএভিতে কানাডার সেন্সর ও ইঞ্জিন ব্যবহার করার কথা ছিল।

তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল ও পোল্যান্ড ছাড়াও আরো কিছু দেশ আন্তর্জাতিক বাজারে পশ্চিমা ও রুশ প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোর জন্য ক্রমশ বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছে।

জাপান ১৯৯০ এর দশক থেকেই আধুনিক প্রতিরক্ষা ও সামরিক সরঞ্জাম তৈরিতে মনোনিবেশ করায় তারাও এক্ষেত্রে অনেক অগ্রসর হয়েছে। ভারতও তার প্রতিরক্ষা শিল্পে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করছে। যদিও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং কারিগরি সমস্যা ভারতকে এ ক্ষেত্রে বেশি দূর অগ্রসর হতে দেয়নি। সেজন্য দেশটি নিজেদের অভ্যন্তরীন প্রয়োজন মেটাতেই এখনো হিমসিম খাচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতও সাম্প্রতিক সময়ে কিছু প্রতিরক্ষা ও নিম্ন স্তরের কারিগরি সামগ্রী রপ্তানী শুরু করেছে।

কোভিড-১৯ মহামারির কারণে অর্থনৈতিক মন্দা এসব দেশকে বেশিদূর এগিয়ে যেতে দেবে না বলে মনে করছেন এ খাতের বিশ্লেষকরা। কারণ কোভিড-১৯ সৃষ্ট পরিস্থিতির কারণে সরকারি ব্যয়ে লাগাম টানছে অনেক দেশ। প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও সমরাস্ত্র নির্মাতা ও সরবরাহকারি দেশগুলো আর্থিক সংকটের কারণে তাদের অনেক প্রকল্প বাতিল বা স্থগিত করেছে।