আবার শক্তির মহড়া উত্তর কোরিয়ার


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৬:০৭

আবার শক্তি দেখাল উত্তর কোরিয়া। এক সামরিক কুচকাওয়াজে দেশটির সেনাবাহিনী প্রদর্শন করেছে নতুন একটি ব্যালেস্টিক মিসাইল। এছাড়া নতুন আরও অনেক অস্ত্রের নির্মাণকাজ চলছে বলেও জানিয়েছেন দেশটির সর্বোচ্চ নেতা।

গত অক্টোবরে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন ও একমাত্র রাজনৈতিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সামরিক কুচকাওয়াজে প্রদর্শন করা হয়েছিল তাদের নতুন আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র। ২২ চাকার একটি সামরিক ট্রাকের ওপর ছিল বিশাল ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি। যেটিকে অনেকেই বিশে^র সবচেয়ে বড় ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর একটি হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এবং সেটি যে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না বিশেষজ্ঞদের।

সেই ঘটনার তিন মাস পার হতে না হতেই ১৪ জানুয়ারি রাতে নতুন আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করেছে উত্তর কোরিয়া। এটি ছিল সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য একটি ব্যালেস্টিক মিসাইল বা এসএলবিএম। দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে এ তথ্য। এদিন ছিল উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন ওয়ার্কার্স পার্টির আটদিন ব্যাপী অষ্টম কংগ্রেসের শেষ দিন। কংগ্রেসের সমাপনী অনুষ্ঠানের সবশেষ আয়োজন ছিল রাতে ফ্ল্যাড লাইটের আলোতে সামরিক কুচাকওয়াজ। এই কুচাকাওয়াজেই নতুন অস্ত্রটি প্রদর্শন করে কিম জং উনের সামরিক বাহিনী।

প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা গেছে রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ের কিম ইল সং স্কয়ারে গায়ে কালো রংয়ের চামড়ার জ্যাকেট, হাতে দস্তানা মাথায় পশমের টুপি পরে হাসি মুখে কুচকাওয়াজে উপস্থিত সৈন্য ও ওয়ার্কার্স পার্টির সদস্যদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ছেন কিম জং উন।বরাবরের মতোই এবারের বক্তৃতায়ও উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা তার দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির অঙ্গীকার পূর্ণব্যক্ত করেছেন। তবে তিনি এদিন সাম্প্রতিক সময়ে তার দেশের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কথাও স্বীকার করেছেন।

উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা কেসিএনএ’র খবরে বলা হয়েছে, এরপর বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র- সাবমেরিন থেকে উৎক্ষেপণযোগ্য ব্যালেস্টিক মিসাইলগুলো একে একে কুচকাওয়াজ স্থলে প্রবেশ করে। যা দেশটির বিপ্লবী সশস্ত্র বাহিনীতের শক্তিমত্তাকেই তুলে ধরে।

দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে ব্যালেস্টিক মিসাইলগুলোর গায়ে লেখা পুকগুকসং-ফাইভ, সম্ভবত গত অক্টোবরের সামরিক কুচাকাওয়াজে যে পুকগুকসং-ফোর মিসাইল প্রদর্শন করা হয়েছিল, এটি তারই উন্নত সংস্করণ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জেমস মার্টিন সেন্টার ফল ননপ্রোলিফিরেশন স্টাডিজ বা সিএনএসের গবেষক মাইকেল ডুইটসম্যান এক টুইটার পোস্টে লিখেছেন, নতুন মিসাইলটি নিশ্চিতভাবেই দেখতে অনেক বড় মনে হয়েছে।

কার্নেগি এনডোমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিচ-এর নিউক্লিয়ার পলিসি প্রোগ্রামের সিনিয়র ফেলো অঙ্কিত পান্ডা উত্তর কোরিয়ার নতুন অস্ত্র সম্পর্কে জানিয়েছেন, নতুন এবং আগে কখনো দেখা যায়নি এমন স্বল্প পাল্লার ব্যালেস্টিক মিসাইল এটি।আর উত্তর কোরীয় সংবাদ মাধ্যম কেসিএনএ লিখেছে, বড় ধরনের আঘাত হানার ক্ষমতাসহ এই রকেট আমাদের অঞ্চলের বাইরেও শত্রুকে পুরোপুরি ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে।

যদিও এবারের মিসাইলটির পাল্লা বা বিধ্বংসী ক্ষমতা সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে নতুন এই মিসাইলটির এখনো পরীক্ষা চালায়নি পিয়ংইয়ংয়ের ক্ষেপণাস্ত্র বিজ্ঞানীরা। তবে আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, দেশটির সংবাদ মাধ্যমের ভাষ্য থেকে বোঝা যায় এই অস্ত্রটির পাল্লা কোরীয় উপদ্বীপ ছাড়িয়ে যাবে এবং অন্তত জাপান পর্যন্ত পৌছতে পারবে।

গত বছরের অক্টোবরের উত্তর কোরিয়া যে আন্তমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করেছিল, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আঘাত হানতে সক্ষম বলে মনে করা হয়। এবারের কুচকাওয়াজে অবশ্য সেই ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রদর্শন করা হয়নি।

২০১৬ সালের পর এবারই প্রথম উত্তর কোরিয়ার ওয়ার্কার্স পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলো, যার শুরু হয়েছিল গত ৫ জানুয়ারি।এবারের কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কিম জং উন গত ৫টি বছরকে তার দেশের জন্য খারাপের মধ্যেও খারাপ সময় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে, সরকারের অর্থনৈতিক নীতি ও ব্যবস্থাপনা ব্যর্থ হয়েছে। তবে তা সত্ত্বেও সামরিক শক্তিবৃদ্ধিতে তার দেশের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ দুই প্রতিবেশী দেশ দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতি।

উত্তর কোরিয়া এমন একটি সময়ে এই নতুন ক্ষেপণাস্ত্রটি প্রদর্শন করলো, যখন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণে মাত্র ৬দিন বাকি। যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কিম জং উনের সম্পর্ক ছিল অম্ল-মধুর। দুজনে যেমন পরস্পরকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন, যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন- আবার দুই দফা মুখোমুখি বৈঠকও করেছেন। অবশ্য সেসব বৈঠকে কোনো অগ্রগতি হয়নি কোরীয় উপদ্বীপের উত্তেজনা প্রশমনে।

অনেক দিন ধরেই পারমাণবিক ও ব্যালেস্টিক মিসাইল কর্মসূচির জন্য বিভিন্ন ধরণের আন্তর্জাতিক অবরোধ রয়েছে উত্তর কোরিয়ার ওপর। নুতন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও উত্তর কোরিয়া বিষয়ে কঠোর পররাষ্ট্রনীতি অবলম্বন করবেন বলেই মনে করা হচ্ছে। আর কিম জং উনের সরকার যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ে যে আগের অবস্থানেই আছে সেটি বলা বাহুল্য।

এবারের কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তৃতায়ওউত্তর কোরিয়ার নেতা যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধান শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন এবং পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আরো বিস্তৃত করার অঙ্গীকার করেছিলেন।এবারের কংগ্রেসে সারা দেশ থেকে দলটির ৭ হাজার প্রতিনিধি অংশ নিয়েছে।কিম জং উন তার বক্তৃতায় জানান, আরো নতুন অস্ত্র তৈরির কাজ চলছে। এর মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো ওয়ারহেড যুক্ত রকেট, সলিড ফুয়েলের আন্তমহাদেশীয় ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, সুপারসনিক গ্লাইডিং ফ্লাইট ওয়ারহেড এবং একটি পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন।

উত্তর কোরিয়ার নেতা বলেন, ১৫ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত দূরত্বের যে কোনো শত্রু অবস্থান পারমাণবিক হামলায় গুড়িয়ে দিতে আমাদের এসব কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।কিম দলের প্রতিনিধিদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল ফোকাস যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিহত করা- যারা আমাদের প্রধান শত্রু এবং উত্তর কোরিয়ার উন্নয়নের প্রধান বাধা। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিরক্ষা সামর্থ বৃদ্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি মোকাবেলা করতে পারলেই আমরা কোরীয় উপদ্বীপে শান্তি আনতে পারব।

কিম জং উনের নয় বছরের শাসনে দেশটি সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেছে অনেক গুণ। এই সময়ে উত্তর কোরিয়া হাইড্রোজেন বোমা, ব্যালেস্টিক মিসাইলসহ অনেক অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে।আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটির সমরাস্ত্র শিল্পের এই উন্নতি বিস্ময়কর। দেশটির কাছে এমন অস্ত্র রয়েছে যা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের ভূখণ্ডে আঘাত হানতেও সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের হুমকি এড়াতেই এসব জরুরী বলে মনে করছে কিম জং উনের দেশ।

দেশটির রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থার খবরে বলা হয় মহড়ায় পদাতিক সৈন্য ছাড়াও অংশ নিয়েছে কামান ও ট্যাঙ্ক বহর। এছাড়াযুদ্ধ বিমানের প্রদর্শনীও ছিল। ওয়ার্কার্স পার্টির অষ্টম কংগ্রেস উপলক্ষে এদিন পিয়ংইয়ংয়ের আকাশে অনেকগুলো বিমান এইট সংখ্যার ডিসপ্লে করেছে। কিম জং উনের সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কিম জং গোয়ান কুচাকাওয়াজের আগে এক বক্তৃতায় বলেছেন, আমাদের রাষ্ট্রীয় এলিট বাহিনীগুলো নিজদের শক্তির জানান দিতে একে একে কিম ইল সুং স্কয়ারেরকুচাকওয়াজে অংশ নেবে।

মাত্র তিন মাস আগেই একটি আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শনের পর এই সময়ে কেন উত্তর কোরিয়া নতুন ক্ষেপণাস্ত্র সামনে আনলো তার একটি জবাব খুজে পেয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের টুফটস ইউনিভার্সিটির কোরিয়ান স্টাডিজ বিভাগের প্রফেসর লি সাং-ইয়ুন। তিনি মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রে যখন ক্ষমতার পালাবদলের প্রক্রিয়া চলছে সেই সময়টিকে কোরিয়া তার শক্তি প্রদর্শনের জন্য বেছে নিয়েছে। এটি মূলত দায়িত্ব গ্রহণের অপেক্ষায় থাকা বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি বার্তা।

এই অধ্যাপক বলেন, ইতিহাস বলছে উত্তর কোরিয়া এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনে রাজনৈতিক শূন্যতার সুবিধা নিতে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড চালিয়েছে। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দায়িত্ব নেয়ার কয়েকদিন পরেই তারা ভূগর্ভে দ্বিতীয় পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেয়ার কিছুদিন পরেই তারা প্রথমবারের মতো আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে।

অবশ্য এ বিষয়ে কিছুটা ভিন্ন মতদক্ষিণ কোরিয়ার ভিত্তিক আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক লেইফ এরিক ইসলের। তিনি মনে করেন, উত্তর কোরিয়া কোনো উস্কানি হিসেবে এই ক্ষেপণাস্ত্র প্রদর্শন করেনি, তবে পিয়ংইয়ং যে সামরিক বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটি স্পষ্ট। সিউলের ইউহা ইউনিভার্সিটির এই প্রফেসর বলেন, করোনার কারণে সীমান্ত বন্ধ থাকা, ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি খুব খারপা অবস্থায় আছে। তা সত্ত্বেও কিম জং উন হয়তো ভেবেছেন আরো একটি রাজনৈতিক-সামরিক প্রদর্শনী তার দেশের জন্য ভালো হবে।