মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অনৈতিক বাণিজ্য

-

  • মোতালেব জামালী
  • ১৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৩:৩৮

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় আরাকান বা রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের গণহত্যার জন্য সারাবিশ্বে নিন্দিত ও ধিকৃত হয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। জাতিগত নিধন ও দেশ থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হয়েছে মিয়ানমার। জাতিসংঘ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে কোনো ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য না করতে সব দেশের প্রতি আহবান জানিয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের এই আহ্বান উপেক্ষা করে পশ্চিমা বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশের অনেক কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করে আসছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী একটি সেনাবাহিনীর সাথে এ ধরনের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উৎসাহিত করারই নামান্তর এবং সম্পূর্ণ অনৈতিক কাজ বলে জাতিসংঘ মন্তব্য করেছে।

মিয়ানমারে ২০১০ সালে দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের সামরিক শাসনের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে। এ সময় কথিত গণতান্ত্রিক নেত্রী অং সান সু চি ও তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)-এর অনেক নেতাকর্মীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। শুরু হয় সামরিক শাসন থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় রূপান্তরের পালা। সামরিক জান্তার শাসন চলাকালে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারের ওপর যে কঠোর অথনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল তা তুলে নেওয়া হয়। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে সু চি’র দল।

মিয়ামারের সেনাবাহিনী যা তাতমাদো নামে পরিচিত। এখনও তাদের হাতে অনেক ক্ষমতা রয়েছে। তারা দেশটির ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিরাট অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করে। এসব প্রতিষ্ঠানে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে সীমাহীন দুর্নীতি। এখনো পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসন সেনাবাহিনীর নিযুক্ত কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।

মিয়ামারের সেনাবাহিনী দেশটির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকদের উপর দীর্ঘদিন ধরেই ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়ে আসছে। এর সর্বশেষ বহি:প্রকাশ ঘটে দেশটির রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর চরম নির্যাতন ও তাদের বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিয়ে দেশ থেকে বিতাড়নের ঘটনায়। ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে চলে আসতে বাধ্য করা হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে মিয়ানমার ও তার সেনাবাহিনী।

মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী সেনাবাহিনীর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করছে বিভিন্ন দেশের অনেক কোম্পানী ও প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্যে প্রায়ই নানা ধরনের চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন গত মাসে এসব কোম্পানীকে সতর্ক করলেও তারা তাতে কেউ কান দিচ্ছে না।

দু’টি ব্রিটিশ ব্যাংক এইচএসবিসি ও ষ্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ভিয়েতনামের একটি কোম্পানীকে ৬ কোটি ডলার লোন দিয়েছে মিয়ানমারে মোবাইল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ কাজ করার জন্য। মাইটেল নামে পরিচিত এই মোবাইল নেটওয়ার্কের ২৮ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার ইকোনোমিক কর্পোরেশন। ইসরাইলের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গিলাত স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কও মাইটেল এর সাথে ব্যবসা করছে।

অষ্ট্রেলিয়ার সরকারও পরোক্ষভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে ব্যবসা করছে। দেশটির সরকারি প্রতিষ্ঠান ফিউচার ফান্ড ভারতীয় বহুজাতিক কোম্পানী আদানী তে ২৫ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আদানী আবার ব্যবসা করছে মিয়ানমার ইকোনোমিক কর্পোরেশনের সাথে। আদানী ইয়াঙ্গুনে মিয়ানমার ইকোনোমিক কর্পোরেশনের মালিকানাধীন জমিতে একটি কন্টেইনার পোর্ট নির্মান করছে। এদের সাথে ব্যবসা করা অন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- জাপানের কিরিন হোল্ডিংস, দক্ষিন কোরিয়ার পোসকো ষ্টিল, ভারতের ইনফোসিস, হংকংয়ের ইউনিভার্সাল অ্যাপারেল ইত্যাদি।

মিয়ানমার সেনাবাহিনী ২০১৬ সালে দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মিকে দমনের নামে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযান চালায়। তারা সেখানে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করে সাধারণ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশুদেরকে নির্বচারে হত্যা ও বাড়ীঘর জ¦ালিয়ে দেয়। এতে ঐ এলাকার মানবাধিকার পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। তখন থেকেই জাতিসংঘ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে কেন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য না করার জন্য সব দেশের প্রতি আহবান জানিয়ে আসছে।

সেনাবাহিনীর নৃশংসতা তদন্ত করে দেখার জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল ২০১৭ সালের মার্চে একটি স্বাধীন তথ্যানুসন্ধানী মিশন নিয়োগ দেয়। এতে অষ্ট্রেলিয়ার সাবেক মানবাধিকার কমিশনার ক্রিস সিদোতি, ইন্দোনেশিয়ার সাবেক প্রসিকিউটর জেনারেল মারজুকি দারুসমান ও শ্রীলঙ্কার মানবাধিকর কর্মী রাধিকা কুমারাস্বামীকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

এই তথ্যানুসন্ধানী মিশন ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাদের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তারা বলেন, সেনাবাহিনী হাজার হাজার সাধারণ রোহিঙ্গাকে হত্যা ও গুম করেছে। তাদের বাড়ীঘর ও সহায়-সম্পদ ধ্বংস করেছে। নারীদেরকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে গণহত্যার দায়ে সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং ও ৫ জন সেনা কমান্ডারের বিচার করার সুপারিশ করা হয়।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ের উপর একটি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশন। এতে বিভিন্ন দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করার সুপারিশ করা হয়। একইসঙ্গে তাদের নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে ব্যবসা না করারও আহবান জানানো হয়। তথ্যানুসন্ধানী মিশন বিভিন্ন দেশের সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) কে অনুরোধ জানায় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীকে অর্থনৈতিকভাবে বিচিছন্ন করে ফেলতে।

প্রতিবেদনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় মিয়ানমার ইকোনোমিক কর্পোরেশন ও মিয়ানমার ইকেনোমিক হোল্ডিংস লিমিটেডের উপর। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণে থেকে ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মান, রিয়েল এষ্টেট, ইনডাষ্ট্রিয়াল জোন, ফিন্যান্স ও ইন্স্যুরেন্স, টেলিযোগাযোগ, খনি ইত্যাদি খাতে একচেটিয়া ব্যবসা হতে প্রচুর মুনাফা করেছে। প্রতিষ্ঠান দুটি ১৯১৬ সালে পাবলিক কোম্পানী করা হলেও এখনো এদের মুনাফার বড় অংশই সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী প্রতিবেদনে ব্রিটিশ কোম্পানীগুলো যেন মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে ব্যবসা না করে সেজন্য তাদের উপর চাপ দিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডমিনিক রাব এর কছে পাঠানো এক চিঠিতে এ আহবান জানানো হয়। চিঠিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার জন্যও ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহবান জানানো হয়। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা চায় না তাদের দেশের কোম্পানী গুলো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করুক।

জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনে মিয়ানমারে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ বন্ধ করার কথা বলা হয়নি। বরং দেশটিতে বিভিন্ন দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বিনিয়োগ করার মাধ্যমে দেশটির অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন তরান্বিত করার কথা বলা হয়েছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অষ্ট্রেলিয়া ও অন্যান্য দেশের মিয়ানমারের উপর দীর্ঘদিন ধরে কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করার ফলে দেশটির অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ে। সম্ভবত সে কারণেই জাতিসংঘের তথ্যানুসন্ধানী মিশনের প্রতিবেদনে বিনিয়োগের এ আহবান জানানো হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে কোন ব্যবসা-বাণিজ্য না করার বা তাদেরকে জড়িত না করতে বলা হয়েছে।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে উপেক্ষা বা অগ্রাহ্য করে সেদেশে বিদেশি কোন কোম্পানীর পক্ষেই ব্যবসা-বাণিজ্য করা সম্ভব নয়। সে কারণে বিদেশি কোম্পানী গুলোও লো প্রোফাইলে থেকে নানা কৌশলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে ব্যবসা করে আসছে। যেমন ভারতের আদানী কোম্পানি দাবি করে থাকে যে বন্দর নির্মাণ বা বন্দরের উন্নয়ন কাজ করার মাধ্যমে তারা মিয়ানমারের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। আবার অষ্ট্রেলিয়া যখন মিয়ানমারের উপর অস্ত্র ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল তখনও তাদের বিভিন্ন কোম্পানী নানা কৌশলে মিয়ানমারের সেনাবহিনীর নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে ব্যবস করেছে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী একটি দেশের সেনাবাহিনীর সাথে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত কোন প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা-বাণিজ্যে করা সমীচিন নয়। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠান এখন নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে তাদের সাথে ব্যবসায়িক চুক্তি করেই যাচ্ছে। যা পরোক্ষভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মানবতা বিরোধী কর্মকাণ্ডকে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে।